হারানো হিয়ার কুঞ্জ
লাবণ্যলক্ষ্মী বিরাজে…
বুদ্ধদেব বসু’র অনুবাদ ও টিকা-সহ ‘মেঘদূত’ নিয়ে বসেছিলাম, পূর্বমেঘের আঠারো নম্বর শ্লোকে কালিদাস লিখছেন,
‘প্রান্ত ছেয়ে আছে আম্রবনরাজি, ঝলক দেয় তাতে পক্ব ফল,
বর্ণে চিক্বন বেণীর মতো তুমি আরূঢ় হ’লে সেই শৃঙ্গে-
দৃশ্য হবে যেন ধরার স্তনতট, অমরমিথুনের ভোগ্য,
গর্ভসূচনায় মধ্যে কালো আর প্রান্তে পাণ্ডুর ছড়ানো’।
-ভারতবর্ষের বুকের ভেতর, মাটি আর আকাশের ভেতর বর্ষা আছে, এ মেঘের প্রবাহ ভারতকে বেঁধে রেখেছে। মেঘের যাত্রা আসলে ভারত-আত্মার যাত্রা। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত ঋতুকেন্দ্রিক-গানের মধ্যে বর্ষার স্থান পৃথক।
রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানের কাছে এসে প্রথমেই যে দুটি গানের ভেতর প্রবেশ করেছিলাম সে দুটি হল, ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে’ ও ‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল…।’
একবার চেয়ে ছিলাম কালিদাসের সেই শব্দগুলির দিকে, ‘শ্যামঃ স্তন ইব ভুবঃ শেষবিস্তারপাণ্ডুঃ।’ বুদ্ধদেব তাকে করলেন ‘ধরার স্তনতট।’ শিল্পের সব থেকে আশ্চর্য প্রবণতা লুকিয়ে রয়েছে বোধহয় এখানেই – সে নিমেষে নিষ্প্রাণের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করতে পারে। ফলে বর্ষার আগমনে ধরার স্তনতট’কে কল্পনা করতে আমাদের অসুবিধা হয় না।
রবীন্দ্রনাথ বর্ষার ভিতর দাঁড়িয়ে লিখছেন, ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে’। এর পরের পঙক্তি’তে তিনি লিখলেন, ‘শত বরনের ভাব-উচ্ছ্বাস কলাপের মতো করেছে বিকাশ।’ এ ভাব উচ্ছ্বাস যে কবির সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই; বর্ষার তার সব রূপ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করেছে কবির মধ্যে। এবার তার বিস্ফোরণের পালা, সে ময়ূরের মতো কলাপ মেলে দিয়েছে। কোন এক হাহাকার দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বকুলের শাখা, করবীর ডাল। তবে এই গানটিতে আমাদের প্রতারিত ক’রে দুটি ‘নিরীহ’ পঙক্তি’র কয়েকটি শব্দ বয়ে চলে যায়, যেন বৃষ্টিতে ভাসানো কেয়াপাতার নৌকা। কেউ লক্ষ করছে না, অথচ ভেসে যাচ্ছে। সে জানে এই দুলে দুলে ভেসে যাবার মধ্যেই তার রাজকীয় প্রভা লুকিয়ে রয়েছে। যে প্রভা নিজেকে লুকিয়ে রাখার, নিজেকে গোপন রাখার।
আমরা প্রায় লক্ষ করি না, রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘ওগো, নির্জনে বকুলশাখায় কে আজি দুলিছে, দোদুল দুলিছে।’ আমরা কথাগুলি পড়ি, কিন্তু গানটির প্রথম পঙক্তি’তে ওই যে তিনি লিখলেন, ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে’, সেখানে আমাদের মনোযোগ এতটাই সমুৎকীর্ণ হয়ে থাকে যে গানটির অপরাপর পঙক্তিগুলি আমাদের মনোযোগ এড়িয়ে যায়।
বর্ষায় নির্জন হয়ে এসেছে বকুলশাখা, সেখানে কেউ দুলছে, দোদুল দুলছে।
সে দোল কি সেই ময়ূরের? যে ময়ূর কবির মনে মধ্যে শত-বর্ণে কলাপ বিছিয়ে দিয়েছিল, সেই কি বকুলশাখায় দুলছে?
নিজের ভেতর দিয়ে জগত’কে দেখা, জগৎ ও আত্ম’কে অভেদ কল্পনা করার এটিই কি অনিবার্য ইশারা? বর্ষা মনের ময়ূর ও বনের ময়ূরের মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়ে দিচ্ছে, তাদের একাধারে নিয়ে এসে বসাচ্ছে।
এর পরের পঙক্তি’তে আরও মারাত্মক টানেলের মধ্যে প্রবেশ করতে হয়, তিনি লিখলেন, ‘ঝরকে ঝরকে ঝরিছে বকুল, আঁচল আকাশে হতেছে আকুল।’পঙক্তিটির প্রথম চারটি শব্দের মধ্যে তিনটিতেই ‘ঝ’ বর্ণ’টি রয়েছে। বৃষ্টি ঝরে পড়বার এর থেকে উৎকৃষ্ট অনুসঙ্গ রচনা আর হয় না। এবার তিনি বুনে দিলেন চরম খেলা, ‘আঁচল আকাশে হতেছে আকুল।’ কী আশ্চর্য, এতদিন পর এক বৃষ্টির দিনে আমার ‘চোখে পড়ল’ এই কথাগুলি। এর আগে বহুবার পড়েছি; কিন্তু এভাবে ধরা দেয়নি।
বকুল ঝরে পড়ছে এবং আঁচল আকুল হচ্ছে আকাশে। কার আঁচল? সে আঁচল কি কোনও ধরিত্রীকন্যার? না, সে সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়েছে ‘ময়ূর’ শব্দটির প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে। এ আঁচল আসলে প্রকৃতির, বৃষ্টি-কন্যার। সে আঁচল উজাড় করে বকুল ঢেলে দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে। এবং বিশেষণ ‘আকুল’ সবিশেষ লক্ষ করার, এ আসলে জলভরা মেঘের হাহাকার। সে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চায় মাটির সঙ্গে। তাপিত ও তৃষিত মানুষের কাছে ঝরে পড়তে চায় সে। এ কারণে সেও একই রকমভাবে আকুল।
অন্য যে গানটির কথা বলেছিলাম সেটির প্রথম পঙক্তি’টি অতি-বিখ্যাত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পরের পঙক্তিটি তুলনামূলকভাবে কম চর্চিত হয়। গানটি গীত হবার সময় নিশ্চয় সেটা হয়ে থাকে, কিন্তু শুধুমাত্র উদ্ধৃতি হিসাবে প্রথম পঙক্তি’টি যত বেশি ব্যবহৃত হয়েছে দ্বিতীয়টি তার এক শতাংশ’ও হয়নি। এর পিছনে নিশ্চয় কারণ আছে, গানটির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে সে কারণের দিকে আমাদের নজর পড়লেও পড়তে পারে।
অথচ প্রথম ও দ্বিতীয় – দুটি পঙক্তি’তেই স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে, দ্বিতীয়টিতে বলা হচ্ছে, ‘আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান’।।
প্রথম পঙক্তিটির মধ্যে যে বিস্ময়কর শিহরণ লুকিয়ে রয়েছে তার নিদর্শন খুব বেশি পাওয়া যায় না, কেউ একজন এসেছেন; খুব কাছের কেউ। তিনি দান করছেন ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।’ কদম ফুলের থেকেও আমাদের সবটুকু বিস্ময় গিয়ে আবদ্ধ হয় ‘প্রথম’ শব্দটিতে।
প্রথম প্রেম, প্রথম সংগমের শিহরণ নিয়ে সেটি যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
বহুদিন এ প্রশ্ন জাগেনি, আজ জাগছে- ফুলটি যে ‘প্রথম’ তা নির্ণয় করছে কে? অদ্ভুতভাবে এ ভাবনার ভেতর প্রবেশ করলে একটি কুহুক তৈরি হয়- ঘুরে ঘুরে মরতে হয় অন্ধকূপের ভেতর। কোনও উত্তর পাওয়া যায় না শুধু এটুকু ছাড়া যে ফুলটি যে প্রথম তা নির্ণয় করছে প্রাপক নিজেই।
আরেকটু সাহসী ও মরিয়া হয়ে বলা যায়, ফুলটির ‘প্রথম’ হয়ে ওঠার জাদু লুকিয়ে রয়েছে প্রাপকের হাতে। সেই ফুলটিকে ‘প্রথম’ হয়ে ওঠার অবিনশ্বর দ্যুতি প্রদান করছে।
বর্ষা ও প্রেমের কাছে ঝরে পড়া প্রতিটি কদম ফুল প্রথম কদম।
সে ফুল দ্বিতীয় হলে বর্ষা ও প্রেম ব্যর্থ হয়ে পড়বে। বারবার ঝরে পড়বার পরেও, (হয়তো বারবার পায়ে পিষে কেউ চলে যাবার পরেও) তাকে নতুন হয়ে উঠতেই হবে, হয়ে উঠতে হবে প্রথম; এখানেই তার সার্থকতা।
যে পেল প্রথম কদম সে দিতে এসেছে শ্রাবণের গান। কিন্তু সে গান একান্ত ব্যক্তিগত, তাকে সর্ব-সমক্ষে আব্রুহীন করার কোনও কারণ নেই। সে গান ঢাকা থাকবে, ‘মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে…।’
আবার গভীর বিস্ময়, আবার এক আবিষ্কারের পালা, শ্রাবণের গান উপহার দিতে এসেছে সে প্রেমিক বা প্রেমিকা তার গানটিও ‘সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান।’
বহুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিলাম, গানটির কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। কথাগুলির ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া আলো-অন্ধকার জাফরি-কাটা বারান্দাটি দেখতে পাচ্ছিলাম।
এর পরের পঙক্তি’টি (পঞ্চম পঙক্তি) প্রেমের ক্ষেত্রে চিরকালের সংশয়- ‘আজ এনে দিলে, হয়তো দিবে না কাল- ।’ আজকের পাওয়াটিকে চিরকালের করে রাখার ক্ষেত্রে মানুষের আকুতি সব থেকে বেশি। কিন্তু ষষ্ঠ পঙক্তি’টি রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীর ক্ষেত্রে অবাক করা, স্তম্ভিত করা। এতটা স্পষ্টভাবে অন্য কোনও গানে এ কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন কি না অনুসন্ধান করা দরকার। সব থেকে বড় কথা, তাঁর গানের যে মূল ভাব তার সঙ্গে পরবর্তী পঙক্তিটির সমান্তরাল চলন দেখে যায় না। তিনি লিখলেন, ‘রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল’।
তবে কি শ্রাবণের মতো প্রেমও transitory! নিজেকে উজাড় করে দিতে দিতে সেও কি একটা সময়ে রিক্ত হয়ে যায়? না কি প্রথম প্রথম কদম দানের পর যা পড়ে থাকে তা নিছক অভ্যাস এবং এখান থেকেই রিক্ততার শুরু? কিন্তু এত স্পষ্টভাবে রিক্ততাকে চিহ্নিত করে তাকে ঘোষণা করে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে অস্বস্তি তৈরি করে তো বটেই।
এ বোধ নিয়ে কি প্রেমের কাছে থিতু হয়ে থাকাও যায়? থাকতে পারে মানুষ? যেখানে রিক্ততার অনিবার্যতা উপলব্ধি করে ফেলা সেখানে প্রেম কি শেষ হয়ে যেতে বাধ্য নয়?
কোন মরিয়া অবস্থান থেকে, কেন তিনি এ কথাটি প্রোথিত করে গেলেন গানটিতে তা সম্পূর্ণভাবে রহস্যময়।
এ গানটির শেষ দুটি পঙক্তি’তে আরেকটি অদ্ভুত বিষয় ছড়িয়ে রয়েছে। কদমের ডাল যে রিক্ত হয়ে যাবে তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিঃসংশয়; কিন্তু তিনি নিজের গানের কুল-ছাপানো বিস্তার নিয়ে সন্দেহাতীত। তাই তিনি লিখতে পারেন, ‘এ গান আমার শ্রাবণে শ্রাবণে তব বিস্মৃতিলোকের প্লাবনে / ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী বহি তব সম্মান।’
প্রতিবার শ্রাবণ আসবে, প্রতিবার ফিরে ফিরে আসবে এই গান। শুধু তাই নয়, তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন, ‘সম্মান’ শব্দটি। প্রথম বকুলের সম্মান আকাশ ছাপিয়ে ওঠা।
রবীন্দ্রনাথের গানে, বর্ষার গানে কতভাবে কতবার যে কদমের কথা ফিরে ফিরে এসেছে! এ মুহূর্তে আরেকটি প্রিয়তম গানের কাছে ফিরে তাকাতে ইচ্ছা করছে, তা শুধু কদমের কারণে নয়। একমাত্র শিল্পই হয়তো পারে আমাদের খুব কাছে হাজার হাজার বছর ধরে পড়ে থাকা বিষয়ের মধ্যে থেকে ভিন্নমাত্রা আবিষ্কার করতে। সে আমাদের স্তম্ভিত করে এমন একটি বিন্দুতে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেয় যেখানে দাঁড়িয়ে শিহরিত হয়ে আমাদের আবিষ্কার করতে হয়, এতদিনের দেখা-শোনার বাইরে আরেকটি জগৎ রয়ে গেছে। সে জগত’ও একই রকম সত্য, বরং বলা চলে অধীক সত্য।
রবীন্দ্রনাথ এ গানটিতে লিখলেন, ‘এই শ্রাবণের বুকের ভেতর আগুন আছে।’ এটি পড়ামাত্র ধক করে জ্বলে ওঠে আচম্বিতের মোমবাতি। বিহ্বল হয়ে আমরা আবিষ্কার করি, দিনের পর দিন কেটে গেছে, বছরের পর বছর কেটে গেছে, শ্রাবণের বুকের মধ্যে যে আগুন লুকিয়ে থাকতে পারে তা আমাদের বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি।
চৈত্রের সঙ্গে আমরা জুড়ে দিয়েছি খ্যাপা বোমভোলার রূপ; শ্রাবণের মধ্যেই যে তার জটা দুলে উঠতে পারে সেটা দেখিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ।
তৃতীয় ও চতুর্থ পঙক্তি’তে তিনি লিখলেন, ‘ও তার শিখার জটা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে ওই দিগন্তরে, / তার কালো আভার কাঁপন দেখো তালবনের ওই গাছে গাছে’।। খুব অবাক লাগে, এমন এক প্রেক্ষাপট নির্মাণ করে তিনি অবলীলায় ‘তালবন’ শব্দটিকে ব্যবহার করলেন। ‘এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে’ থেকে ‘তালবন’ পর্যন্ত চলে যাওয়া বেশ আশ্চর্যজনক। এবং বাদল হাওয়া পাগল হয়ে উঠছে ‘সেই আগুনের হুহুঙ্কারে।’ এরপরে আরও সুস্পষ্টভাবে রুদ্রের রূপ ভেসে উঠছে গানটিতে, ‘দুন্দুভি তার বাজিয়ে বেড়ায় মাঠ হতে কোন মাঠের পারে।’ খ্যাপা শ্রাবণ যে চতুর্দিক ভাসিয়ে অধিকার করে নিচ্ছে পৃথিবী। তার ছন্দ ধারণ করছে পৃথিবী।
গানটির মধ্যে ফুটে উঠতে শুরু করে রক্তমাংসের তীব্র ভালোবাসার কামড়।
সপ্তম পঙক্তি’তে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘ওরে, সেই আগুনের পুলক ফুটে কদম্ববন রঙিয়ে ওঠে,।’ শ্রাবণের আগুন রূপান্তরিত হচ্ছে কদমে। আগুনের বেগ এসে লাগছে ‘আজ আমার গানের পাখার পাছে’।।
এ এক আশ্চর্য গান। এ গানে রবীন্দ্রনাথ শ্রাবণ-আগুনের উৎপত্তিস্থল হিসাবে চিহ্নিত করলেন রুদ্রের জটা। মেঘেদের জলের পৃথিবী জুড়ে যে আগুন ছড়িয়ে থাকতে পারে, সে আগুন যে গানের পাখায় এসে আশ্রয় নিতে পারে, রবীন্দ্রনাথ এ গানটি সৃষ্টি না-হলে তা অনুধাবন করা সহজসাধ্য হত না।
২
এবার আরেকটি গানের কাছে ফিরে আসা যাক, সেটিও বর্ষার গান। রচিত হয়েছিল শিলাইদহে, ১৯০৯-এর বর্ষায়। তারকনাথ লাহিড়ী’র স্মৃতিচারণায় পাওয়া যায় অসামান্য এক ঘটনার কথা,
‘… সেটা ১৯২১ সাল হবে– বর্ষামঙ্গল হবে কলকাতায়।…প্রথম দিন জোড়াসাঁকোতে গুরুদেব তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন।…অনুষ্ঠানের একটি গান যখন সবে শেষ হয়েছে শ্রোতাদের মধ্যে থেকে একজন উঠে দাঁড়ালেন।…জোড়করে তিনি বললেন, ‘আজ এই সুধীজনসমাগমে আমার ভিক্ষার ঝুলি কি পূর্ণ হবে না?? গানের দলে আমরা বসে; মনে করলাম–তখন উত্তরবঙ্গে প্লাবন– বোধহয় সেখানকার দুর্গতদের জন্যই তিনি সাহায্যপ্রার্থী। গুরুদেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনার আবেদন জানতে পারলে, সাধ্যাতীত না হলে আমি তা মেটাবার চেষ্টা করব।’ দর্শক তখন করজোড়ে বললেন, ‘আমি কবির নিজের কণ্ঠে একটি গান শুনতে চাই।’ গুরুদেব বললেন, ‘পশ্চিমে গিয়ে আমার কণ্ঠ এবারে হারিয়ে এসেছি–তবুও আপনার ইচ্ছা পূর্ণ করব।’ তিনি গাইলেন, “আজি ঝড়ের রাতে… । স্তম্ভিত সমস্ত শ্রোতা, এই কি হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠ?…
(গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ/ সমীর সেনগুপ্ত)
-গানটি শুরুই হচ্ছে সুস্পষ্ট ঘোষণার মধ্যে দিয়ে, কোথাও কোনও সংকোচ নেই। অভিসারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গোপন যেন এখানে উন্মুক্ত, অন্তত যিনি ঘোষণা করছেন তাঁর কাছে তো বটেই। ‘ঝড়ের রাত’ শব্দ দুটি ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে অভিসারের গায়ে এসে পড়ছে ঝড়ের অভিঘাত। অভিসার হয়ে উঠছে ঝঞ্ঝাময়। দ্বিতীয় পঙক্তি’টিতে শিল্পের অতিরিক্ততা রয়েছে; এ অতিরিক্ততা শিল্পকে তার চেনা পরিসর থেকে মুক্তি দেয়। সে মুক্তি আনন্দের, সে মুক্তি অনন্তের। যেমন শুধু ‘পরানসখা’ শব্দটি ব্যবহার করাই যথেষ্ট ছিল; কিন্তু সেখানে এসে শেষ হয়ে যেত শিল্পের রহস্য। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে এল অতিরিক্ততা; তিনি পরানসখা’র পর যুক্ত করলেন ‘বন্ধু’ শব্দটি।
কেউ একজন অপেক্ষা করছে দুয়ার বন্ধ করে; প্রিয়তম তার অভিসারে। প্রেমে বা পূজার ধর্ম’ই এই- যে ক্ষণে ক্ষণে উতলা হয়ে ওঠে। অপেক্ষার প্রহরগুলি তার কাছে অতি-দীর্ঘ, অসহ্য। তাই সে বারবার দরজা খুলে চাইছে। ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছে, ‘বাইরে কিছু দেখিতে নাহি পাই / তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।’
তা হলে কি অভিসারে আসা মানুষটি আসলে বাইরের কেউ নয়! তার পথ আসলে বাইরের নয়, ভিতরের। এমনটা ভাবা অসঙ্গত হবে না; কারণ শেষ দুটি পঙক্তি’তে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘সুদূর কোন নদীর পারে গহন কোন বনের ধারে /গভীর কোন অন্ধকারে হতেছ তুমি পার’।।
বারবার গানটির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আবিষ্কার করা যাবে, অভিসারে যে আসছে তার সম্পর্কে অপেক্ষমান মানুষটি অবগত। সে আসছে নিশ্চিত; অথচ কোন অন্ধকারে, কোন নদীর পার ধরে বনের মধ্যে দিয়ে সে পবিত্র অন্ধকার পার হয়ে যাচ্ছে সেটা তার জানা নেই।
এখানে এসে মনে হয়, এই কি প্রথম অভিসার? জীবনে কি আর কোনও দিন দেখা হয়নি তাদের? অপেক্ষমান মানুষটি জানে তার অভিসারে সে আসছে, অথচ তার পথ ও পথের ঠিকানা তার অজানা। কোন পথ কখন সে আসবে তার জন্য অনন্ত অপেক্ষা।
ভয়াবহ একটা শিহরণ খেলে যায়; মনে হয় এমনও তো হতে পারে এ ঝড়ের রাত শেষ হয়ে গেল। অথচ অভিসার সম্পূর্ণ হল না। বারবার দুয়ার খুলে তাকিয়ে থাকার ক্ষণটাই রয়ে গেল শুধু। কী অসহ্য ও ভয়াবহ হয়ে উঠবে তখন প্রতিটি ক্ষণ। হয়তো আবারও প্রস্তুতি নিতে হবে, গোপনে প্রস্তুতি নিতে হবে অভিসারের। হয়তো কোনওদিনই সম্পূর্ণ হবে না অভিসার; শুধু জীবনজুড়ে বারবার এই ব্যর্থতা ও প্রস্তুতি নিয়ে যাবার নামই জীবন।
এ এক আশ্চর্য গান; অভিসারের নিশ্চয়তার পাশাপাশি চলেছে প্রবল অনিশ্চয়তা।
আত্মদীপের নিভু নিভু অথচ অনিবার্য আলোয় দরজা খুলে অপেক্ষা, মুহূর্তে নিভে যেতে পারে সব। চেনা, না-চেনার আট-কুটুরি নয়-দরজার জগৎ যেন।
গানটি শেষ করে মনে হয়, জল-মুকুরে তাকিয়ে রয়েছে একটি পাখি; ছোট্ট পাখি। জলের ভিতর ছায়া পড়েছে। জলোচ্ছ্বাসে ছায়া ভেঙে যাচ্ছে, দুটি পাখিই একে অপরকে ছুঁতে চাইছে, পারছে না।
একটা কূট প্রশ্ন জাগে, অভিসারের পথ হেঁটে চলা সত্তা’টিরও কি একই সংশয় ও অসহ্য অপেক্ষার প্রহর থাকে? অন্তর’কে ছোঁবার জন্য কি অন্তরতমের অপেক্ষাও সমান সুন্দর ও রহস্যময়?
Leave a reply