হা রা নো হি য়া র কু ঞ্জ
গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে…
শান্তিনিকেতনে শীতের বিকেল, কোলাহল থেকে দূরে মহার্ঘ স্বল্প অবসর। যেখানে ছিলাম সেখানে ফুলের মেলা বসেছে; শীত-বিকেলে একসঙ্গে এত পাখির গান শোনা বিরল অভিজ্ঞতা। এ বিকেল ‘জীবন’-এর, ঘাস ও কুয়াশার মধ্যে সংগমের ফলে সৃষ্টি হয়ে চলেছে জীবনের মহাসংগীত। পৃথিবীর সব ব্যর্থ অসফল বিকলাঙ্গ জীব বেঁচে রয়েছে, জীবনের ভেতর থেকে তারা উঁকি মারছে প্রতিদিন। এ যেন শব্দহীন এক জীবনের গান। জীবনের এ গানের সঙ্গে ‘শান্তিনিকেতন’ নামক প্রাতিষ্ঠানিক ধারণার যে কোনও সংযোগ নেই তা নিশ্চয় আর নতুন করে বলে দিতে হবে না। কারণ এ গান বেজে চলেছে ধূলিকণা থেকে ধূলিকণায়।
শান্তিনিকেতনে সেদিন বিকেলবেলায় কোলাহল শান্ত হয়ে এলে গানটি ফুটে উঠতে শুরু করেছিল।এবং পাশাপাশি আরেকটি ঘটনাও ঘটতে শুরু করেছিল, জীবনের মহা-চাঁদোয়ার নীচে দাঁড়িয়ে দেখতে পেয়েছিলাম আমার কাছে ফুটে উঠছে পল সিজান-এর দুটি ছবি ‘পিরামিড অফ স্কালস’ ও ‘স্টিল লাইফ উইথ স্কাল, ক্যান্ডেল এন্ড বুক’।
গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে, খুব স্বাভাবিকভাবে সে সময়ে আমার রবীন্দ্রনাথের গানের দিকে ঝুঁকে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু জীবন এমনই, জীবন অপ্রত্যাশিতের শিল্প। সে আমাকে এনে দাঁড় করিয়েছিল সিজানের ছবি দুটির সামনে। প্রথম ছবিটিতে চারটি নর-করোটি দিয়ে বানানো এক পিরামিড। সামনের তিনটি খুলি অতি-দৃশ্যমান, পিছনের খুলিটি আভাস দিয়ে শুয়ে আছে ফ্রেমের ভেতর।নীচের দুটি খুলির শরীরে ছেয়ে রয়েছে প্রত্ন-প্রাণীর ডিমের কুসুমের হরিদ্রাভা, উপরের খুলিটিকে ছেয়ে রয়েছে শাদা ফ্যাকাসে আলোর সন্ত্রাস। ক্যানভাসে ব্ল্যাক-এর অনেক শেডস, ফ্রেমের নীচের একটি জায়গায় লালাভ বোল্ড স্ট্রোকস। দেখামাত্র রক্তপাত ও ক্ষতের ইশারার কথা মনে পড়বে।
কিন্তু সে সন্ধ্যায় আমাকে সব থেকে বিপন্ন করে তুলেছিল ক্যানভাসের বামদিকের (দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকে) খুলিটি। খুলির চোখের শূন্য থেকে বেরিয়ে আসছে তীর্যক দৃষ্টি। আড়চোখে সে যেন দেখে নিতে চাইছে, বুঝে নিতে চাইছে পরিস্থিতি। মৃত্যুর পরেও খুলির ভেতর জমে থাকা অনন্ত বিস্ময় ও সন্দিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে ক্যানভাসে। যেহেতু ক্যানভাসের ডানদিক থেকে সেটি ছড়িয়ে পড়ছে সেহেতু আমাদের পারসেপশন ও সংস্কারের কারণে তাকে অন্তর্ভেদী বলে মনে হচ্ছে আরও বেশি করে।
শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত নেমে গিয়েছিল, মনে হয়েছিল মৃত্যুর পর খুলিগুলি যেন শূন্যতাকে কামড়ে ধরে বেঁচে উঠতে চাইছে।
দ্বিতীয় ছবিটিতেও রয়েছে খুলির উপস্থিতি, এখানেও খুলির গায়ে এসে পড়েছে হরিদ্রাভ আলো; খুলি ও টেবিলের ডানদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বাতি। লক্ষ করার, বাতিটির মাথা ভাঙা। অর্থাৎ আলোর সম্ভাবনা বিলুপ্ত হয়েছে সে বাতি থেকে। খুলিটির সামনে খুলে রাখা গ্রন্থের পাতায় এসে পড়েছে আলো। এবং তাদের সামনে ছড়িয়ে রয়েছে লালচে রঙের ফুল অথবা মাংসের তাল অথবা উপড়ে আনা হৃৎপিণ্ড।
জ্ঞান ও মৃত্যুর মাঝখানে থমকে রয়েছে রহস্যময় একটি ফ্রেম। মৃত্যু ও জ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক আসলে লুকিয়ে রয়েছে ‘ক্যান্ডেল’-এর উপস্থিতির অনিবার্যতার মধ্যে। মনে পড়ছিল প্রাচ্যদেশীয় এক ‘বিষণ্ণ’ সত্তার সেই উচ্চারণ, ‘জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই’। এই ‘প্রেম’ই কি সমস্ত শিল্পের সারাৎসার? সমস্ত ক্ষতের শেষে এই নীলাভ তারাটিই কি ফুটে থাকে দিগন্তে? আবার ছবিটির সামনে ফিরে আসি, সিজান মোমবাতি’টির মাথা ভেঙে দেবার মধ্যে দিয়ে শিল্পের পবিত্র সন্ত্রাসের আনয়ন করেছেন। ‘আলো’র অভাবে প্রেমের অভাবে মৃত্যু ও জ্ঞান দুটি মেরুর বাস্তবতা নিয়ে অবস্থান করছে। মহূর্তের জন্য আলো জ্বলে উঠলে এই দ্বন্দ্বমূলক অবস্থানের বিলুপ্তি ঘটে যেতে পারে। শান্তিনিকেতনের বিকেলবেলায় মনে হয়েছিল গ্রন্থ ও খুলি – দুই’ই যেন সেই আলো জ্বলে ওঠার অপেক্ষায়। এ অপেক্ষা চিরকালের, আবহমানের।
সেদিন রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কাছে ফিরে আসার জন্য সিজানের ছবি ও জীবনানন্দের কবিতার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে হয়েছিল। এ লেখাটিতে কিছুটা আগেই লিখেছিলাম তিনি ‘বিষণ্ন’; শব্দটি প্রতারক জেনেও রেখে দিলাম একটি বিশেষ কারণে। জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে ভাবনার শুরুতেই আমাদের অন্ধকার জরায়ুর কথা মনে পড়ে, অন্ধ-পেঁচার কথা মনে পড়ে। সিজানের এই ছবি দুটির মতো মৃত্যু-খুলির নির্বাক চেয়ে থাকার কথা মনে পড়ে। এ ধারণা অবচেতনে প্রথিত হয়ে গেছে, এর থেকে মুক্তি পাওয়া বেশ কষ্টকর। ‘বিষণ্ণ’ শব্দটি তারই প্রমাণ, অথচ এ মুহূর্তে আমি পড়ছি,
‘আজো ঢের গ্লানি-কলঙ্কিত হয়ে ভাবি :
রক্তনদীদের পারে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির
শোকাবহ অঙ্ক কঙ্কালে কি মাছি তোমাদের মৌমাছির নীড়
অল্পায়ু সোনালি রৌদ্রে ; প্রেমের প্রেরণা নেই— শুধু নির্ঝরিত শ্বাস
পণ্যজাত শরীরের মৃত্যু-ম্লান পণ্য ভালোবেসে ;
তবুও হয়তো আজ তোমরা উড্ডীন নব সূর্যের উদ্দেশে।
ইতিহাস—সঞ্চারিত হে বিভিন্ন জাতি, মন, মানব-জীবন,
এই পৃথিবীর মুখ যত বেশি চেনা যায়— চলা যায় সময়ের পথে,
তত বেশি উত্তরণ সত্য নয়, জানি ; তবু জ্ঞানের বিষণ্নলোকী আলো
অধিক নির্মল হলে নটীর প্রেমের চেয়ে ভালো
সফল মানব-প্রেমে উৎসারিত হয়, যদি, তবে
নব নদী নব নীড় নগরী নীলিমা সৃষ্টি হবে।
আমরা চলেছি সেই উজ্জ্বল সূর্যের অনুভবে।’ (অন্ধকার থেকে)
-কী আশ্চর্য, সিজানের দ্বিতীয় ছবিটিকে আমি ঘুরে বেড়াতে দেখি এই কবিতাটির মধ্যে। জ্ঞানের বিষণ্ণলোকী আলোর অধিক নির্মল হয়ে ওঠার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সফল মানব-প্রেমের ইশারা। শেষের আগের লাইনে আট’টি শব্দের মধ্যে ছয়’টি শব্দে রয়েছে ‘ন’ বর্ণ’টি, যেন কোথাও শান্ত হয়ে আসছে সমুদ্র, বিক্ষুব্ধ সমুদ্র। এবং শেষ লাইনে এসে জীবনানন্দ স্পষ্ট উচ্চারণ করছেন, ‘আমরা চলেছি সেই উজ্জ্বল সূর্যের অনুভবে’। সেদিন সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনে ছড়িয়ে পড়ছিল তিনটি শব্দ, ‘জ্ঞানের বিষণ্ণলোকী আলো’। এই আলো, যা আদপে ‘ইনফরমেশন’-এর রূপ, ‘নলেজ’-এ রূপান্তরিত হয় ‘অধিক নির্মল’ হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে।
সিজানের ছবি ও জীবনানন্দের কবিতার মধ্যে ‘আলো’র উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি আধুনিক মানুষের বিপন্নতা থেকে উদ্ভুত। সেদিন রবীন্দ্রনাথের যে দুটি গানের কথা বারবার মনে পড়ছিল তা হল, ‘গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে আর কোলাহল নাই’ এবং ‘এই তো তোমার আলোকধেনু সূর্য তারা দলে দলে’। সিজানের ছবিতে একটি না-জ্বলা বাতির ইশারা রয়েছে, জ্ঞানের বিষণ্ণলোকী আলোর কথা বলছেন জীবনানন্দ। এবং রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘প্রদীপ একটি নিভৃত অন্তরে জ্বলিতেছে এই ঠাঁই’।।
তাঁর গানের মধ্যে কী রয়ে গেল যা আধুনিকতার পরিসরটিকে অতিক্রম করে আক্রান্ত করে চলে আমাদের?
রাত্রি নামার সঙ্গে সঙ্গে কোলাহল মুছে যাবার মধ্যে কি রয়ে গেল শান্ত মৃত্যুর শান্তি? নাকি জীবনের মধ্যেই ‘ভিতর পানে’ চলে যাবার গভীর নির্জন পথ?
মাঝে মাঝে সুদূর সিন্ধুর ধ্বনি ভেসে আসছে, জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানের সীমা থেকেও যেন নেই। কিন্তু এর পরের লাইনটি ভাবিয়ে তুলছে, কারণ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘সকল বাসনা চিত্তে এল ফিরে, নিবিড় আঁধার ঘনালো বাহিরে-।’ প্রথম লাইনে যে আঁধার ঘনিয়ে উঠেছিল তা যেন এক রিভার্স প্রক্রিয়ায় ঘনিয়ে উঠল বাইরে’ও। অর্থাৎ বোঝা গেল যে আঁধার, যে শান্তি অন্তরের তা আচ্ছন্ন করছে ‘বাহির’কেও। কিন্তু যে অংশটির সামনে এসে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সেটি হল, ‘সকল বাসনা চিত্তে এল ফিরে।’
এ বাসনা আসলে নিছক ‘প্রাপ্তি’র আকাঙ্ক্ষা নয়, বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো মনে পড়তে বাধ্য টি এস এলিয়টের সেই লাইন দুটি, ‘when the evening is spread out against the sky / Like a patient etherized upon a table…।’
যে সত্তা একদিন নীচু কিমাকার অচেতন stupor-এর মধ্যে ঘুমিয়ে ছিল তা তার ইথারাইজড অবস্থা অতিক্রম করে জেগে উঠছে। যে পথিক একদিন অসাড়-স্নায়ুর উদাসীন তাড়নায় হেঁটে গেছে মাইলের পর মাইল তার গায়ে এসে লাগছে বাসনার রঙ। এ রঙ আসলে সেই আলো-সঞ্জাত, যে আলো উদ্ভুত হয়ে চলেছে একটি প্রদীপ থেকে যা ‘নিভৃত অন্তরে জ্বলিছে’।
রবীন্দ্রনাথের গানে মাঝে মাঝেই আপাত-অনিকেতের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। এই অনিকেত আসলে ‘ঘর’ থেকে ‘গৃহের’ দিকে যাত্রা করা এক সত্তা।
আর একটি বিষয় লক্ষ করে চমকে উঠেছিলাম, ‘পিরামিড অফ স্কালস’ সৃষ্টি হচ্ছে ১৯০১ সালে; রবীন্দ্রনাথের এই গানটি লেখা হচ্ছে ১৯০৩ সালে। সিজানের ছবিতে যেখানে প্রকাশ্য সন্ত্রাস, আধুনিক মানুষের অতৃপ্ত অশান্ত মৃত্যুর রূপ, রবীন্দ্রনাথের গানে সেখানে প্রকাশ্য উচ্চারণ, ‘নীরব মন্ত্রে হৃদয়মাঝে শান্তি শান্তি শান্তি বাজে’। সিজান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শিল্পীদের মধ্যে পড়েন, সন্দেহ নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ’কে সারা বিশ্বের নিরিখে বিচার করলে দেখা যাবে তিনি আধুনিকতার পরিসরটিকেই ছিন্ন করে যাচ্ছেন। আরও একধাপ এগিয়ে বলা চলে, এই ছিন্ন করে চলে যাবার মধ্যে তাঁর কোনও সচেতন অভিপ্রায়’ও কাজ করছে না। এবার গানটির শেষ লাইনের দিকে চাওয়া যাক, তিনি লিখছেন, ‘অরূপকান্তি নিরখি অন্তরে মুদিতলোচনে চাই’। পঞ্চম লাইনে যখন আমরা পেয়েছিলাম, ‘অসীম মঙ্গলে মিলিল মাধুরী, খেলা হল সমাধান’ তখনও পর্যন্ত মনে হয়েছিল এ গান জীবনের প্রসারিত অংশ-রূপে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার গান।
সমস্ত শিল্প ও পূজার কি একটিই লক্ষ্য, জীবনকে মৃত্যুর কোলে শান্ত অর্ঘ্য হিসাবে রেখে যাবার প্রস্তুতি গ্রহণ করা!
শেষ লাইনে এসে গানটি নিজেকে ঈষৎ প্রকাশ্য করছে। সত্তার গভীরতম অংশে যেন ফুটে উঠছে প্রবাল-প্রাচীর। সমুদ্রের ভেতর দোল খাচ্ছে সূর্য। সে প্রবাল-প্রাচীরের সন্ধানে ডুব দেওয়া ডুবুরি ডুবে যেতে যেতে ভুলে যাচ্ছে সমুদ্রের কথা, অতলের কথাও। তার জাগরণ ও নিদ্রার সীমারেখা মুছে গেছে। তার কাছে তখন অরূপকান্তি’ই একমাত্র সত্য।
অবশেষে সে সন্ধান পাচ্ছে প্রবাল-প্রাচীরের। এবং সন্ধান পাবার সঙ্গে সঙ্গে খুলে যাচ্ছে আরেকটি দুয়ার, সে ‘মুদিতলোচনে’ চাইবার যোগ্য হয়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথের এই মহা-আশ্রয়ের ধারণা তাঁকে অন্য গ্যালাক্সি’তে স্থাপন করেছে। এ আশ্রয় যতটা আধ্যাত্মিক আশ্রয় ততটাই জীবন-মৃত্যুর মাঝের সীমারেখা মুছে দেওয়া। জীবন’ও তো আসলে মৃত্যুর কোলে মহা-আশ্রয় খুঁজে পায়।
জীবনে সব থেকে বেশি যে কটি পঙক্তি ‘সামান্য’ ভুল সহযোগে উদ্ধৃত হতে দেখেছি তার মধ্যে দ্বিতীয় গানটির প্রথম পঙক্তি’ট অবশ্যই থাকবে, বহুবার ‘আলোকধেনু’র পরিবর্তে ‘আলোরধেনু’ উচ্চারিত হতে শুনেছি।
গানটির শুরুতে আকস্মিকতার ছোঁয়া রয়েছে; যেন কেউ এই… এইমাত্র আবিষ্কার করল তার ‘আলোকধেনু’। মানুষের সব থেকে কাছে থাকা মহাজাগতিক বিপুলের নিদর্শনগুলির মধ্যে উজ্জ্বলতম সূর্য। রবীন্দ্রনাথ এক লহমায় তার বিপুল-বিস্তার’কে তুচ্ছ করে দিচ্ছেন, তিনি মহাকাশ-চাঁদোয়া খুলে দেখিয়ে দিচ্ছেন দলে দলে চরে বেড়ানো অগণন তারা। তারাও সূর্যের মতো ‘আলোকধেনু’।
গানটির দ্বিতীয় পঙক্তি’টি কোনও এক গোঠের ‘কৃষ্ণ’কে মনে পড়িয়ে দিতে বাধ্য। যদিও রবীন্দ্রনাথ একবারও সে কৃষ্ণের কথা উল্লেখ করেননি, তবু মনে হবেই এই আলোকধেনু চরিয়ে বেড়ানো, বাঁশি বাজিয়ে বসে থাকা অদৃশ্য হাত কি ‘কৃষ্ণ-কর’? এত আলোর পিছনে যে অদৃশ্য প্রণোদনা তা কি অসীম ‘কৃষ্ণ’? অনতিক্রম্য ‘কালো’?
চতুর্থ পঙক্তিতে এসে সেদিন শান্তিনিকেতনে বিদ্যুতচমক খেলে গিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘আলোয়-চরা ধেনু এরা ভিড় করছে ফুলে ফলে।’
যে রবীন্দ্রনাথ প্রথম পঙক্তি’তে সূর্য, তারার দল’কে আলোকধেনু বলে উল্লেখ করলেন তিনি চতুর্থ পঙক্তি’তে এসে তাদেরই বললেন, ‘আলোয়-চরা ধেনু।’ তারা ভিড় করে আসছে ফুলে-ফলে।
রবীন্দ্রনাথ এক মুহুর্তে আলোকধেনু ও আলোয়-চরা ধেনু’র মধ্যে তফাৎ ঘুচিয়ে দিলেন; তিনি দুটি’কে একবিন্দু’তে এনে বসালেন। আলোকধেনু ও আলোয়-চরা ধেনু তাঁর জাদু’তে অভিন্ন হয়ে ফুটে উঠতে শুরু করল।
আরও কিছুটা এগিয়ে আত্মবিপন্নতার কূপ খোঁড়া শুরু করা যায়, চতুর্থ-পঙক্তি’তে আলোয়-চরা ধেনুর পরিবর্তে ‘আলোকধেনু’ শব্দটি ব্যবহার করলে গানটির বাহ্যিক আবেদনের কোনও পরিবর্তন ঘটত না। প্রথম অথবা দ্বিতীয় মাত্রায় অভ্যন্তরের আবেদনেরও ছিঁটেফোঁটা পরিবর্তন অনুভব করা যেত না, হয়তো।
কিন্তু এখানেই রবীন্দ্রনাথের গানের গোপন আক্রমণ, আলোকধেনু’রা যে আলোয়-চরা ধেনু’ও সেটা তিনি জানাতে ভুললেন না।
আলোকধেনু’রা অনন্ত আলোকে ভেসে বেড়াচ্ছে। সে আলো ‘ম্যাক্রো’ থেকে ছুটে এসে প্রবেশ করছে ‘মাইক্রো’র গভীরে। তারা নিজেরাই নিজেদের আলো দিচ্ছে, নিজেরাই আলোয় চরে বেড়াচ্ছে। তারা থেকে ফুল পর্যন্ত তার বিস্তার।
সবিশেষ লক্ষ করার, রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘আঁধার হলে সাঁজের সুরে ফিরিয়ে আন আপন গোঠে’। যে মহাশৃঙ্খলা ব্যতীত ব্রহ্মাণ্ডের বিপুল বিস্তার সম্ভব হত না তাকেই নির্দেশ করছেন রবীন্দ্রনাথ, অথবা জীবনের মহা-কোলাহল শেষে মৃত্যুর শান্তি। আপন গোঠে ফিরে চলেছে সূর্য-তারার দল। এখানে আবারও একটা শান্ত অথচ গভীর খাদের কাছাকাছি এনে ফেললেন আমাদের, তিনি ফিরিয়ে আনছেন; তিনি ফিরিয়ে আনছেন ‘সাঁজের সুরে।’
আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম একবার, বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম কোটি কোটি লাইটইয়ার্স জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এক গান। সে গান স্তব্ধতার, সে গান গতিময়তার।
শেষ দুটি পঙক্তি’র কাছে ফিরে গেলে দেখা যাবে তিনি লিখছেন, ‘আশা তৃষা আমার যত ঘুরে বেড়ায় কোথায় কত- / মোর জীবনের রাখাল ওগো ডাক দেবে কি সন্ধ্যা হলে?।’
জীবনকে মৃত্যুর কোলে শান্ত অর্ঘ্য হিসাবেই দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ, এখানেও তার ছায়া দীর্ঘ। এবং এ পথেই ধীরে মুছে যাচ্ছে জীবন ও মৃত্যুর সীমারেখা। যেন আকূল কোনও তরুণী, পিপাসার্ত বসে আছে প্রিয়’র অপেক্ষায়; সে বাঁশি বাজিয়ে ডাক দেবে তাকে। সেই তো ‘মোর জীবনের রাখাল।’
জীবনে মৃত্যুর থেকে বড় রহস্য আর নেই। সমস্ত জীবন জুড়ে যে মহাপ্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ, যে বিশাল’কে ধারণ করে রাখে তার স্নায়ুতে তার কোনও উত্তর কি পাওয়া সম্ভব? না কি এই প্রশ্নটিই মানুষকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় ও সে ছুটের পরিসমাপ্তি ঘটে মৃত্যু’তে?
সমস্ত খণ্ড-প্রশ্নের মধ্যে এটি মাতৃপ্রশ্ন।
‘আধুনিকতা’ যখন আলো নিভিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর-সন্ধানে রত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ তখন আলো জ্বেলে মহা-অন্ধকারের দিকে চলে গেছেন; তার সন্ধান করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ‘আধুনিক’ নন, তাঁর গান তার সব থেকে বড় প্রমাণ।
তিনি আধুনিকতার পরিসরটিকে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন।
সেদিন শান্তিনিকেতনের সন্ধ্যাবেলা ঠিক এই কথাটিই মনে হয়েছিল।
Leave a reply