আমার কবিতা পাঠের আবাল্যের সঙ্গী, গুটিকয় সংস্কার। প্রথমেই বইটির ১২ পৃষ্ঠার কবিতা ; পাখি ওই ডালে বসে গেল তো গেলই–কাব্যগ্রন্থটি ফেরৎ দিতে দেরি হয়ে যায়। ফিরে ফিরে বারংবার পড়ি , ওই ১২-কেই। তারপর একদা দুম্ করে দিয়ে দিতে বাধ্য হই গ্রন্থটি ! এ ভাবেই বহু কাব্যগ্রন্থের ১২ পৃষ্ঠার সঙ্গে আবাল্য প্রেম। কে যেন বলেছেন — যে প্রেমে অভিশাপ থাকে ! মূল কাব্যগ্রন্থটির সঙ্গে জীবনেও আর বসা হয়না মুখোমুখি। ভাগ্যিস ডাইরির পৃষ্ঠায় লেগে থাকে লাকি টু-এলভ !
মৃদুল দাশগুপ্ত\’র \’জলপাই কাঠের এসরাজ\’ — যার ১২ পৃষ্ঠায় ছিল \’বিবাহপ্রস্তাব\’ :
\’বাড়িটি থাকবে নদীর কিনারে, চৌকো,
থাকবে শ্যাওলা রাঙানো একটি নৌকো
ফিরে এসে খুব আলতো ডাকবো,বউ কই…
রাজি ?
তবে এসো এসো, জানাও তুমিও প্রস্তুত,
আত্মগোপন পর্বে তুমি এ দস্যুর
ক্ষতে দেবে মধু দুব্বো চিবিয়ে, আস্তে
তোমাকে চেনাবো তারাগুলি, আর নৈঋত
দিক থেকে নেমে হঠাৎ আসবে দেবদূত
পুকুরে ভাসবে দুটি রাজহাঁস, চই চই…
লুঠে নেব হ্রদ, টিলাগুলি, আমি জঙ্গি
দূর বনপথে ঝরে ঝরে যাবে রঙ্গন…
ছোটাবো তুফান ঘোড়াটি, যাবে না সঙ্গে?
তোলো মুখ, এসো, ধরো হাত, চলো সঙ্গে\’
আমার তখন যূনিভার্সিটি-পর্ব : ১৯৮০-৮১ । তৎসমশব্দে কী যেন বলে?–স্নাতকোত্তর। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত \’গোলাপবাগ\’। যৌবনের যূথিকাভান্ডারীদের যাকে দেখি , ডেকে ডেকে এইপ্রস্তাব দেবার বাসনা জাগে ! ভূগোলের পৃষ্ঠা থেকে ভালো জল, মিষ্টি নাম দেখে-শুনে শুরু হয় অন্বেষণ—নদীর : কৃষ্ণা,কাবেরী…পছন্দ আর হয় না। থাক, নদীর নামই যখন হল না–নারী, বাড়ি। নিজস্ব নৌকায় ভাসতে ভাসতে , অনর্গল উঠতে থাকে ঢেউ–ছন্দের। অজান্তেই যেন জড়িয়ে যাই কবিতার লতাতন্তুতে।
\’জলপাই কাঠের এসরাজ\’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ
চিত্র ঋণ : লেখক
আচ্ছা , কবিতাটির –প্রথম , চতুর্থ-স্তবক এবং অন্তিম পঙক্তিতেই : ৮+৬=১৪ মাত্রার পয়ার ছন্দ কেন ? কেনই বা নয় , বাকি সব-এ ? তবে কী, বিবাহের মতো প্রস্তাব তো সেই বৈদিক যুগের ; তাই পুরাতন-পয়ারের চাল!
১ +১+১ +২ +১ ১ +২ ১ +১ ১ +১+১=১৪
বা ড়ি টি থাক্ বে ন দী | র্ কি না রে, চৌ কো,
[ ৮+৬=১৪ ]
২+ ১ + ২+ ১+১+১ +১+ ২+ ১ +১ +১=১৪
থাক্ বে শ্যাও লা রা ঙা | নো এক্ টি নৌ কো
[ ৮+৬=১৪ ]
\’চৌকো\’-র সঙ্গে \’নৌকো\’-র –কতো নৈকট্য—অথচ শিহরণময় কী চকিত মিল ! চৌ-নৌ-বৌ(বউ) ; অদ্ভুতভাবে স্টিয়ারিং মুঠোবন্দি করলেন কবি : \’কই… রাজি?\’ বাংলা অন্ত্যমিলের কানানিচু চারকোনা সেপ্ যেন একলাথে, গোলাকার বস্ততে পরিণত হল ; অনেকদিন পর , বাস্তবিক \’গোল\’ বলে চিৎকার করতে লজ্জা পেলাম না আমি।
কিন্তু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পঙক্তিতেই ১৪ মাত্রার অনাচার ঘটল কেন? –কিছুতেই বুড়ি ছুঁতে পারছি না! একটা আত্মধিক্কার ছিঁড়ছে আমাকে। তখন মাথায় দুটো নয় , ৯–১০টা শিং নাড়া দিচ্ছে : অমূল্যধন, নীলরতন সেন, প্রবোধচন্দ্র, শঙ্খ ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখের ছন্দ-বিষয়ক বই বগলদাবা করে চলছে আমাদের \’কবিতার ক্লাস\’। গ্যালারি গড়িয়ে গোলাপবাগের টানা বারান্দা দিয়ে , ঝানু অধ্যাপকের দমাদ্দম ঝাড় দৌড়াচ্ছে গোলপোস্টের দিকে । কিন্তু যা হয় গড়পড়তা বাঙালি-প্লেয়ারের! পোস্টের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে — বল ; মধ্যে-মাঝে বড়জোর কেঁপে উঠছে, কাঠের ফাঁপা বার। গোলের দেখা নাই !
\’বাড়িটি\’ তো থাকার কথা \’নদীর কিনারে\’, তবে তৃতীয় পঙক্তির অন্তিমে কেন : \’পুকুরে ভাসবে দুটি রাজহাঁস, চই চই…\’
নদী-তীরবর্তী বাড়ি থাকার প্রস্তাব, পুকুরে এসে ডুবে মরল ; –ভেসে উঠল, হুডিনির ম্যাজিকের মতো : \’রাজহাঁস\’ হয়ে! কবিতার লতাতন্তুময় জট নিজেই মনেমনে খুলে ফেলি–সপাটে। আরে, কবিতাটির সব কিছুই তো প্রস্তাবাকারে উত্থাপিত ! : \’থাকবে\’, \’দেবে\’, \’বাসবে\’, \’ভাসবে\’– এইসব ক্রিয়াপদের-ব্যানারে স্বপ্ন দেখার দূরবিন– দেখছ না!
শৈশবের ছবি
চিত্র ঋণ : ফেসবুক
\’বিবাহপ্রস্তাব\’-উত্থাপনকারী যুবকের স্বপ্ন হয়ত পছন্দসই হয়নি সখীর ; \’রাজি?\’—প্রশ্নবোধক চিহ্নটি, আমাদের পাঠকের মাথায় খড়্গবৎ ঝুলিয়ে দিয়ে কবিও খুব \’আস্তে\’ তাদের \’ক্ষতে\’ : \’মধু\’ \’দুব্বো\’—জাতীয় বনৌষধির প্রলেপ বুলিয়ে দিচ্ছেন। কেননা, কোন্ নারীই বা রাজি হবেন নদী তীরবর্তী বাড়ি বানানোর প্রস্তাবে–নদী আর ভাঙন যে জমজভাই।
অথবা, যতই শ্যাওলা-রঙা চিরসবুজ নৌকা হোক, –কে নারী চায়,–তার পুরুষটি ঠাকুর কৃষ্ণের দোসর হোক? মেতে থাক নৌকাবিলাসে সারাদিন! এহেন কোনো দোয়া-ই প্রার্থনা করবেন না– দয়িতারা। তাই নদীর প্রস্তাব খারিজ। এবং পুকুরের সীমাবদ্ধতাই স্বাগত–এ কবিতায় :
\’পুকুরে ভাসবে দুটি রাজহাঁস, চই চই…\’
তারচেয়ে বরং চুপ , দেখছ না–চলছে \’আত্মগোপন-পর্ব\’ ! ৬/৭ বেডের, গার্হস্থ গরিমায় ভাসছে মরাল-মরালী। দিনভর। মরাল-মৈথুন চলছে–যখন-তখন ! চলছে, লুঠতরাজ : দম্ভ-হ্রদ, আর টিলাদ্বয়। যার প্রফুল্ল ফলশ্রুতি?নৈঋত কোণ থেকে নেমে এসেছেন–শিশু দেবদূত ! :
\’তোমাকে চেনাবো তারাগুলি, আর নৈঋত
দিক থেকে নেমে হঠাৎ আসবে দেবদূত\’
এখন , প্রাক-বিবাহ পর্বে, (\’বিবাহপ্রস্তাব\’) এতো ভালো ফ্লিম ? পাঠক হিসাবে মনে হচ্ছে আমার — ক্যুরোসোয়াও কি দিতে পারতেন , দর্শককে ?
আজ আবার বসেছি–১০ম বার। হাতে \’জলপাই কাঠের এসরাজ\’। সেই দ্বাদশ পৃষ্ঠার-দয়ালু-দৈত্য ! ঘাড় থেকে নামতে নারাজ যিনি। কালও– প্রাক-বিবাহ পর্বের এই \’প্রস্তাব\’, শরীরে আনছিল শিহরণময় চাঞ্চল্য।
হঠাৎ আজ,কবিতাটির ভিন্ন আর এক রহস্যময় টিলা আবিষ্কার করলাম যেন! প্রথম স্তবকের স্তাবকতাময়,আবেগ আবিষ্ট :
\’বউ কই…
রাজি? \’
— এরপর, তৃতীয় স্তবকের :
\’পুকুরে ভাসবে দুটি রাজহাঁস, চই চই…\’
মিলিয়ে পড়তেই , কানে ধরা পড়ছে –পাড়ে তোলার আন্তরিক, হার্দ্য আহ্বান। মরাল-মরালী নয়–মনে হচ্ছে : মা এবং তার শাবকের ইংগিত।
নিয়মিত ছন্দ-নৈকট্যের নেশা কবি তাই বুঝি ভেঙে দিয়েছেন ? \’প্রস্তত\’–\’দেবদূত\’-এর স্বাভাবিক মিল ; বাকি পঙক্তি গুলিতে মিল হতে হতেও, এই যে সরে সরে যাওয়া—-কবিতাটিকে বগিচ্যুত করেনি মোটেও, বাজিমাৎ করেছে! আবার , \’বউ কই \’—\’চই চই\’-এর সুদূর মিল এনেছে চারিত্রিক নৈকট্য। যে নারী আজ অধরা নদীর মতো, সেই তো ধরা পড়ে–গৃহপালিত পুকুরের ফ্রেমে !
একটি কবিতাকে ঘিরে এই যে অনন্ত জিজ্ঞাসার উস্কানি—পাঠককে উদবেজিত করে। চোখে তার \’অক্ষম পিঁচুটি\’র পরিবর্তে, লাগিয়ে দেয় পরাগ-অঞ্জন। যা থেকে জন্ম নেয়–অনুসৃষ্টির স্ফুলিঙ্গ ; কবি-মনের \’না বলা বাণীর ঘন-যামিনীর মাঝে\’ জন্ম দেয়–শুকতারার। দেয় না ?
বরং নিজস্ব বুকসেলফে্ তোলা থাক এ বই আরও ত্রিশ বছর।তারপর যদি দেখা হয় পুনরায়? দেখা যাবে পড়ে — দ্রৌপদীর শাড়ির আঁচলে, বাঁধা পড়ে গেছে এ বইয়ের কবিতার অনন্ত খুঁট !
2 comments on “প্রবন্ধ : চন্দ্রনাথ শেঠ”
Unknown
সম্বৃদ্ধ হলাম…
arh1967
খুব কাছের প্রিয় কবিদের মধ্যে একজন।কবির কবিতার এ আলোচনা অত্যন্ত মনোজ্ঞ ও হৃদয়গ্রাহী।