সোনা জ্যাঠা
প্রতিদিন ঠিক সকাল আটটা নাগাদ সোনা জ্যাঠা আসতেন। কোনও বিরাম নেই। আমিও এইসময় ঘুম থেকে উঠে চোখেমুখে জল দিয়ে খবরের কাগজ পড়তে বারান্দায় এসে বসতাম। সোনা জ্যাঠাকে দেখলেই আমার মাথায় চড়চড় করে রক্ত উঠে যেত। ভীষণ রাগ হত।
আমাদের বাড়ি থেকে জ্যাঠাদের বাড়ি তিন-চার মিনিটের পথ। জ্যাঠা-বড়মা আর জ্যাঠার বিধবা এক বোন থাকেন এক বাড়িতে। ছেলে, ছেলের বউ, নাতি দোতলায় আলাদা থাকে। নীচতলার খরচখরচার ব্যাপারে তাদের মাথাব্যথা নেই। জ্যাঠার পেনশনের টাকায় সংসার চলে। খুব যে ভালোমতো চলে, তা বলা যায় না। কেননা জ্যাঠার তেমন কোনও রোগব্যাধি না-থাকলেও জ্যাঠিমা নানা রোগে ভোগেন সারাবছরই। সুগার, প্রেশার তো আছেই, সেইসঙ্গে বাতের ব্যথাতেও কাবু। জ্যাঠার বিধবা বোনকে আমরা ডাকি বুলা পিসি। সেই পিসিও খুব-একটা সুস্থ নন। সবমিলিয়ে জ্যাঠা যে পেনশন পান, তাতে ওষুধেই অনেক খরচ হয়ে যায়। এই টাকায় ঠিকমতো কুলিয়ে উঠতে পারেন না। ফলে খবরের কাগজের বাড়তি খরচ মানেই বিলসিতা। অথচ সোনা জ্যাঠার প্রতিদিন কাগজ পড়া চাই। দেশবিদেশের খবরের আদ্যপ্রান্ত জানা চাই। আমার ধারণা, সোনা জ্যাঠা কাগজের বিজ্ঞাপনগুলোও পড়ে ফেলতেন।
আমাদের কাগজ কেনার টাকা আমিই দিই। তাই আমি মনে করি, কাগজটা যখন-তখন পড়াটা আমার হক। অনেকটা আমার নিজের সম্পত্তির মতো। বাড়িতে সবাই জানে আমি যখন কাগজ পড়তে বসব, তখন কেউ সেই কাগজে হাত বাড়াবে না। হয় আগেই পড়ে নেবে, নয়তো আমার পড়া হলে পড়বে। কাগজের ভাঁজ নষ্ট হলেও চলবে না। বাবা তাই আমার পড়ার আগে কাগজ পড়েন না। ভাই কদাচিৎ আমার আগে কাগজ পড়তে নেয় বটে, তবে অতি সন্তর্পণে কাগজ খোলে আর পড়ে। সোনা জ্যাঠার এসবের বালাই ছিল না। আমি পড়ার আগে খবরের কাগজ নিতেন। উল্টেপাল্টে দেখতেন এবং পড়তেন। কাগজের ভাঁজ একেবারে নষ্ট হয়ে যেত। তাই আমার রাগ হওয়াই স্বাভাবিক ছিল।
একদিন বলেই বসলাম, আচ্ছা জ্যাঠা, তুমি একটু দেরিতে আসতে পারো না?
ক্যান? দেরিতে ক্যান? এইসময় আইলে কী হয়?
না, তেমন কিছু নয়। আসলে পরের দিকে এলে নিরিবিলি কাগজ পড়তে পারতে। এই যে আমি কাগজের ভেতরের পাতা চেয়ে নিই, এতে পড়ার ব্যাঘাত হয় না তোমার? সরাসরি বলতে পারছিলাম না বলে একটু ঘুরিয়ে বলতে চাইলাম। সহজ-সরল সোনা জ্যাঠার আমার ইঙ্গিত ধরতে পারার কথা নয়।
নাহ্, তা হইব ক্যান? তুমিও এক লগে সব পাতা পড়ো না। আমিও পড়ি না। অসুবিধা কিছুই হয় না।
কিছুতেই যুক্তি সাজাতে পারছি না। আবার কাগজের ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাবে, এটাও বলা যাচ্ছে না। বললেই হয়তো বলে বসবেন, কাগজের ভাঁজ নষ্ট হইলে কি ল্যাখা নষ্ট হয়? নাকি খবর উইড়া যায়? বলা তো যায় না। সোনা জ্যাঠা এইরকমই পালটা জবাব দেন। আমি যুক্তি হাতড়াতে থাকি। তার মধ্যেই সোনা জ্যাঠা বলে ওঠেন, পরের দিকে আইতে কইলা? ঐ সময় আমি ঠাকুরঘরে আহ্নিক করি।
সেকি! এত দেরিতে? আহ্নিক তো ভোরে করতে হয়।
হ, জানি। কিন্তু সবার সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা কইরা সময় পাল্টাইতে হইছে আরকি।
কার সুবিধা-অসুবিধা?
আহ্নিকের আগে ঘণ্টা বাজাইয়া ঠাকুর তোলা করি। সইন্ধ্যায় ঘণ্টা বাজাইয়া ঘুম পাড়াই তো, তাই ঘণ্টা বাজাইয়াই তোলা লাগে। এইডা নিয়ম কিনা জানি না, আমার বাবায় করতেন, তাই আমিও করি। তা ভোরে ঠাকুর তোলা করলে ঘণ্টার শব্দে পোলা আর পোলার বউয়ের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। নাতিরও অসুবিধা হয়।
এইসব পারিবারিক জটিল ব্যাপারে আমি ঢুকতে চাইনি। তাই এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বললাম, তাহলে আহ্নিক শেষ করেই আসবে। তখন তো কাগজ এমনিই পড়ে থাকে। পড়তে পারবে একা একা।
অ। তা খারাপ কও নাই। কিন্তু আহ্নিকের পরেপরেই নাতিরে লইয়া যাই বড় রাস্তার মোড়ে। অর ইস্কুলের গাড়ি আসে। অপেক্ষা করতে হয় সেইখানে। তারপরে তো ম্যালা কাজ।
বয়স্ক মানুষের কী যে ম্যালা কাজ থাকে বুঝতে পারি না। কিন্তু যেটা বুঝেছি, সোনা জ্যাঠাকে এইসময় কাগজ পড়া থেকে বিরত করা যাবে না। তবু চেষ্টা চালিয়ে যাই আমি। হাল কিছুতেই ছাড়ব না, এমন একটা রোখ চেপে যায় আমার।
সবথেকে ভালো হয় জ্যাঠা, তুমি দুপুরে এসে বারান্দায় বসে কাগজ পড়তে পারো। একেবারে শুরু থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত। কথাটার মধ্যে শ্লেষ মিশে গেল, বুঝতে পারলাম। কিন্তু জ্যাঠা ধরতে পারলেন বলে মনে হল না।
হ। সেই চ্যাষ্টাও করছি একদিন। দ্যাখলাম বউমায় সেইসময় কাগজ পড়ে।
মা? মা কাগজ পড়ে জানি না তো!
এইসব কি তোমারে বইল্যা করব নাকি? তোমার মা সংসারের সব কাজ সাইরা তয় কাগজ হাতে নেয়।
এরপর আর কোনওদিন এইসব প্রসঙ্গ তুলিনি। ব্যাজার মুখ করে কাগজ পড়তাম আর মনে মনে গজগজ করতাম। একদিন সকালে সোনা জ্যাঠাকে দেখতে পাইনি বলে অবাক হলাম। অথচ আসেননি বলে ভালো লাগারই কথা ছিল। ব্যাপারটা সন্দেহজনক মনে হওয়ায় মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সোনা জ্যাঠা এসেছিল নাকি আজ? আমার মনে হচ্ছিল হয়তো সকাল সকালই কাগজ পড়ে চলে গেছেন। যদিও খবরের কাগজ পরিপাটিই ছিল।
না তো। উনি আজ আসেননি এখনও। কয়টা বাজে? ওমা! সাড়ে আটটা বাজে। আজ কী হল ওনার কে জানে! মায়ের কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ।
আমার মায়ের সব ব্যাপারেই দুশ্চিন্তা! এসব আমার একদম ভালো লাগে না। যাক গে। এসব ভেবে আমি কী করব? নিজের মনে কাগজ পড়ে যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ কাগজ পড়ে তারপর স্নান করতে যাই। ন-টার পরে স্নানে গেলে অফিসে যেতে দেরি হয়ে যায়। সেইসময় কানে ভেসে এল মায়ের কথা। বাবাকে বলছেন, দাদার একটু খোঁজ নিও তো। আজ পেপার পড়তে এলেন না কেন কে জানে!
মায়ের আদিখ্যেতা দেখে রাগ হল খুব। একটা লোক পেপার পড়তে আসেননি বলে তাঁর খোঁজ নিতে হবে? রাগে গরগর করতে করতে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম।
অফিস যাওয়ার আগে দুটো স্লাইজ পাউরুটি খাই মাখন দিয়ে। ওপরে অল্প চিনি ছড়িয়ে দেন মা। স্লাইজে কামড় দেওয়ার সময়ই মার কথা যেন উড়ে এল কানে, যেভাবে কলপাড় থেকে উড়ে এসে পাতিকাকটা রান্নাঘরের জানালার ধারে এসে বসে।
তুমি এক কাজ কোরো তো। একটু চুন-হলুদ গরম করে দিচ্ছি। দাদার পায়ে লাগানোর ব্যবস্থা কোরো। বুড়ো মানুষটা বাথরুমে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলেন! বুড়ো বয়সের ব্যথা কি সহজে যায়?
বাবা ইতিমধ্যেই সোনা জ্যাঠার খবর নিয়ে এসেছেন বুঝতে পারলাম। মা কথাটা বাবাকেই বলছিলেন। বাবাও মৃদুকণ্ঠে কিছু একটা বললেন। আমার কানে সেই শব্দ পৌঁছয়নি। রাগে আমার ভেতরে একটা আগুনের হলকার বয়ে যাওয়া টের পেয়েছিলাম। মুখ বুজে বেরিয়ে গেলাম অফিসে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে চা খাই শুধু। আর কিছু নয়। কেননা এরপর ক্লাবে যাব। সেখানে ক্যারাম খেলতে খেলতে এটা-সেটা খাওয়া হয়ে যায়। সেইসময় দেখলাম বাবা বেরোচ্ছেন। হাতে ব্যথানাশক মলম।
কোথায় যাচ্ছ এটা নিয়ে? যদিও বুঝেই গিয়েছিলাম বাবার গন্তব্য। তবু একটু কথা শোনানোর সুযোগ পাব ভেবে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সকালের আদিখ্যেতা মনে পড়ে গিয়েছিল। এখনও একইরকম আছে দেখে মাথায় চড়চড় করে রাগ উঠে গিয়েছিল। বাবা মিনমিন করে বললেন, সোনাদার বাড়িতে যাচ্ছি। মলমটা দিয়ে আসি।
তুমি দিয়ে আসতে যাবে কেন? ওদের বাড়ির পাশেই তো ওষুধের দোকান। বড়মা বা বুলা পিসিই তো টুক করে বেরিয়ে নিয়ে আসতে পারেন!
তা পারেন। কিন্তু আমিই বৌদিকে বলেছি, আমাদের ঘরে একটা ভালো মলম আছে। কিনতে হবে না। বাবার গলা একেবারে খাদে নেমে গেছে তখন।
তোমাদের সব তাতেই বাড়াবাড়ি। বিরক্ত মুখে বললাম আমি। মেজাজটা এত খিঁচড়ে গেল যে তক্ষুনি ক্লাবে বেরোতেও ইচ্ছে করছিল না। থম মেরে বসে রইলাম বারান্দায়। কিছুক্ষণ পরে ঘরের থমথমে পরিবেশ থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে বেরিয়ে গেলাম ক্লাবে।
পরের দিনও যথারীতি সোনা জ্যঠা আসতে পারেননি। আমি খবরের কাগজ পড়ছি। একটু বাদেই স্নান সেরে অফিসে চলে যাব। যাওয়ার আগে স্লাইজ পাউরুটি খাচ্ছিলাম প্রতিদিনের মতো। দাঁতে চিনির দান পড়ছে আর আমার ভেতরে ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়ছে। সেইসময় ঘরের ভেতর থেকে মায়ের গলা শুনতে পেলাম। স্বাভাবিকের তুলনায় একটু যেন বেশি জোরেই কথা বলছেন। চৈত্র সংক্রান্তির দিন লোকটা বিছানায় পড়ে আছেন। খুবই খারাপ লাগছে!
কথাগুলো শুনে আবার আমার মেজাজ তিরিক্ষি হতে শুরু করেছে। মায়ের ধারাবিবরণী তখনও চলছেই। মানুষটার ঋণ কোনওদিন ভুলব না। তোমার তখন আগের কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেল, চাকরি নেই অনেকদিন, উনি প্রায়ই কিছু কিছু চাল, ডাল, আলু ভর্তি ব্যাগ নিয়ে আসতেন। আরও অনেককিছু নিয়ে আসতেন হাতে করে। তুমি লজ্জায় মুখ নীচু করে থাকতে। আমি ঘোমটায় মুখ ঢেকে ওনার হাত থেকে সব জিনিস নিয়ে নিতাম। মাস তিনেক পরে তুমি নতুন চাকরি পেলে। আমি একদিন বললাম, উনি মাইনে পেলে আস্তে আস্তে সব শোধ করে দেবো দাদা। তা উনি জবাব দিলেন, সেই টাকায় তোমরা ভালোমন্দ খাইও বউমা। পারলে দুধ নিও একপো কইরা। তোমাগো চেহারা খুব খারাপ হইয়া গেছে। আমি যা করলাম, আমার ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের জন্য করছি। ও নিয়া তোমরা ভাইব্যো না।
মা কি আমাকেই কথাগুলো শোনাতে চাইলেন? সোনা জ্যাঠা আমাদের একসময় অনেক উপকার করেছেন শুনতাম। কী উপকার জানার চেষ্টা করিনি। আমি জ্যাঠার ওপর বিরক্ত, সেটা কারও না-বোঝার কারণ নেই। তাই কি এতদিন পরে জ্যাঠার সেই অবদানের কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছেন মা?
স্লাইজ পাঁউরুটি থেকে চিনি ঝরে পড়ল দু-এক টুকরো। অন্যমনস্কতায় এমন হল? তাড়াতাড়ি অফিস ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আগে সোনা জ্যাঠার বাড়ি যেতে হবে। কাগজটা জ্যাঠার হাতে দিয়ে অফিসে চলে যাব।
পরদিনই ১লা বৈশাখ। আমাদের অফিস ছুটি থাকে না। একটু আগেই স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম অফিস ব্যাগ নিয়ে। বাড়ির কাগজ সবার জন্য থকুক। নতুন কাগজ কিনে জ্যাঠার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে অফিসে চলে গেলাম। ফেরার পথে পেপারওয়ালা ছেলেটিকে বলে দিলাম, কাল থেকে জ্যাঠার বাড়িতেও পেপার দিও। মাসকাবারি দাম আমি দেবো।
এক প্যাকেট বড় মিষ্টির প্যাকেট সন্ধ্যাবেলায় জ্যাঠিমার হাতে তুলে দিয়ে বললাম, সবাই মিলে খেও। সোনা জ্যাঠা বললেন, বাঁইচ্যা থাকো বাবা। অনেক বড় মনের মানুষ হও।
ঠিক তখনই আমি বুকের ভেতরে একটা আবছায়া ছোট্ট বল গড়িয়ে যেতে দেখলাম। কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করছিলাম। ‘বড় মনের মানুষ হও!’ জ্যাঠার ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে রাস্তার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম আর সেই বলটার গড়িয়ে যাওয়া টের পাচ্ছিলাম। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম মনে করতে পারছি না। চোখ পড়ল কোমরে হাত দিয়ে বড়মা দাঁড়িয়ে আছেন। পাশে বুলা পিসি। দুজনেরই চোখ আমার দিকে। তাঁদের মাথার পেছনে আলো-আঁধারি গোলাকার বলয়ে আমার চোখ আটকে গেল। বলটা তখনও গড়িয়েই চলেছে।
8 comments on “ছোটগল্প : যুগান্তর মিত্র”
Soumi Acharya
যুগান্তর দা এ সাধারণ গল্প নয়,অনেক স্মৃতিও মনে পড়ে গেলো।ছুঁয়ে গেলো আমায়।
ALOPRITHIBI BLOG
ধন্যবাদ সাথে থাকুন।
Barnali Roy Mitra.
খুব ভালো লাগলো ۔۔۔বড় মনই তো মানুষের আসল সম্পদ ! 💓😊
Sampa
খুব খুব ভালো লাগল
যুগান্তর মিত্র
ভালোবাসা সৌমী।
যুগান্তর মিত্র
আনন্দ আনন্দ !
যুগান্তর মিত্র
ভালোবাসা শম্পা।
ব্র ত তী
ভীষণ ভীষণ ভালো