১.
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো আদিনাথ
এখনও যাস নি ! ওই তো
রাস্তা মায়াবী
কতবার তোকে ডাকল!
সব শুনশান। ছায়ারাও আজ ত্রস্ত
কেঁপে ওঠে বাতি। মেঘ ডাকে
ওই আকাশে, বাতাসও বলছে
আজ আর গিয়ে কাজ নেই।
গিয়ে কাজ নেই। সমাজ অথবা রাষ্ট্রের
আমরা হলাম কবে থেকে এত বাধ্য !
তোর মনে পড়ে? আমার তো
কিছু মনে নেই।
এই তো সেদিনও মধ্যরাতের শহরে
চিত হয়ে শুয়ে ময়দানে খোলা আকাশের
তারাদের সাথে খেলাধুলো ছিল, বিদুৎ
ঝড়ের রাত্রে মেঘটির সাথে ইশারায়…
এই তো সেদিন অলীক হত্যাদৃশ্যেও
ছিল প্রেম, ছিল তৃষ্ণা, স্বপ্নসরণির
ভিতরে ভিতরে বরফের তলে লুকনো
সাদা হাড়, তার উদাসীনতার কাহিনী…
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি নামলো আদিনাথ
পঁচিশ পয়সা ভাড়া সাইকেলে রাস্তা
নিমেষে পেরোলো নিখিল সেতুর সীমানা
মৃত্যুর সাথে তারা জাগা
এক তমসার, ভরসাবিহীন
অসম্ভবের প্রহরে…
২.
আজও হাওয়া ফিরে গেলে , জারুলগাছের নীচে
সব যেন ফাঁকা হয়ে আসে। প্রকৃতির এইসব
ছায়া ঘেরা সন্ধ্যা থেকে বহুদূরে, তাচ্ছিল্যভরে
ছদ্ম-গাম্ভীর্যের পর্ব শেষ করে, সম্পাদক বাণিজ্য সফল
লম্বা কোনও সিগারেট ধরাবে আবার। মেতেরোপলিসে।
কিম্বা সে নিতান্তই না যদি ধরায়
গাছতলা থেকে দূরে গঞ্জের সবজি বাজার
তাড়ির ঠেকের পাশে, ঘুমচোখে
ঠিক বসবে যথারীতি
ঘড়ি ধরে বিকেল পাঁচটায়…
তোমার তো তাড়া নেই আর, নেই আর দায় । জীবিকার
ব্যস্ত পর্ব চুকে গেছে, অধ্যয়নও বহুকাল
হয় না তেমন। অধ্যবসায় নেই, নাছোড়বান্দার মতো
শুধু কিছু লেখালেখি, অক্ষরের কুটাভাস আছে
কেন আছে ! কেনই বা আছে ! নিয়ত নিবিষ্ট তনুমনে
তুমি তো মরণই তার কামনা করেছো কত বার ।
তবু তাকে না পেরে এড়াতে, সপাটে অর্গল আটকে
ভিতর প্রবেশপথ রুদ্ধ করার ছল খুঁজেছ অনেক…
হাওয়া ফিরে গেলে তাই জারুলগাছের নীচে
কবেকার হিমে ঢাকা ইতিহাস, মায়া নেমে আসে…
৩.
চিতাগ্নি নীরবে জ্বলে আজও
পোড়ে হাওয়া বাষ্প বায়ু স্মৃতি
আগুন পোহানো শীত রাতে
পোড়ে চাঁদ, রাতের নিয়তি
শোক তাপ পত্র মর্মর
নীরবতা, হাওয়ায় অসুখ
রাত্রি বৃক্ষে গন্ধমরীচিকা
মনে পড়ে গতজন্মকথা…
তারই মাঝে মৃত্যু মনে পড়ে
মনে পড়ে স্বপ্নে পাওয়া লেখা
এক চোখ অন্ধ কোনও তারা
খসে পড়ছে মহাশূন্যপারে…
৪.
একদিন যাবো।
আমার জন্য শুধু রেখো
মেঘের মিনারে এক
জানলা খোলা বাতাসের বাড়ি
যাবো একদিন। সন্ধ্যা নামলেই
পাহাড়ে পাহাড়ে যেই
জ্বলে উঠবে ছায়া ঘেরা আলো
দেখবে মৃত্তিকা ফুঁড়ে
অকস্মাৎ আমিও এলাম
তোমার বাতাসবাড়ির জানলায়
যেরকম চলে গিয়েছিলাম একদিন
আলো আর অন্ধকারের ফাটলে
নিমেষে হারিয়ে যাওয়া জুনিপোকাটির মতো একা
দেখবে ফিরেও আসি সেভাবেই, অপ্রত্যাশিত।
কখন? তারিখ কত? কে বলতে পারে !
ঘড়ির কাঁটার সাথে বহুকাল যোগ নেই আর
শূন্যপুরে আমি এক সামান্য নাবিক, সেই নৈরাজ্য, মধ্যসাগরের
পেরিয়ে এসেও তীর খুঁজে আর পাইনি কখনও
ডুবোজাহাজের সাথে বার বার ডুবে গেছে
আমাদের শেষ কবিতারা। সমুদ্র ফিরিয়ে দেয়, দেবে
বলেছিলো যারা, তাদের হাড়ের ডিঙি
ভেসে গেছে মায়ার বন্দরে…
যাবো একদিন। তোমার বাতাস ঘরে, মেঘের জানলায়
দু চার দন্ড থেকে, কাউকে কিছু না বলে আবার উধাও হয়ে যাবো।
দুঃখ পেও না তাতে। দুঃখ থাকে না বেশি দিন।
৫.
তুমি বন্ধু কাল্পনিক। নিজেরই ভিতরে
বৃথা হাহাকার খোঁজো অথবা সমাধি
সব যেন উহ্য থাকে, কালো জল, ব্যাধি
শৃঙ্গে থাকে নীলমণি, মাধুরীর ঘরে
সে সব বানানো দুঃখ যদি ভীড় করে
শব্দজালে যদি ধরা পড়ে আধাআধি
বাকি অর্ধ জুনিপোকা রাতের অতিথি
অতি ক্ষণিকের চিহ্ন সমূহ আধারে
তবু ডানা ছিন্ন হলে অন্ধ মেঘ জাগে
জাগে ঊর্মি, দীপশিখা, শ্বাস, মর্মক্ষত
স্মৃতিজল, বায়ুশব্দ , তমসার মেঘ
সেই মেঘাবৃত আলো কোন্ অস্তরাগে
নিভে আসে মায়াকল্পে ঘোর চন্দ্রাহত
পাণ্ডুরতা ঘন হলে বাড়ে গতিবেগ…
[জিওকিমো লিনটিনি ও আদি সিসিলিয়ান
টাসকান সনেটের কাঠামোকে মনে রেখে।]
2 comments on “কবিতা : প্রজিত জানা”
প্রসূন প্রামাণিক
অসম্ভব অসম্ভব ভাল কবিতা। ছন্দ এবং শব্দ প্রয়োগ, মূর্ছনা আর আর্তি ! শিহরণ । শুধু টেকনিক্যাল কারণে ,হয়তো, পঙক্তি বিন্যাসে একটু সমস্যা লাগছে। কবিকে প্রণাম জানাই।
Gaurisankar De
অসাধারণ লিকছিস বেশ কিছুদিন ধরে। চিরদিনই ভালো লিখতি। কিন্তু শব্দের ভিতরে যে অর্ধমাত্রা স্থিতানিত্যা তাকে অভিজ্ঞতার সঞ্চারপথ থেকে যে অভিজ্ঞায় উত্তীর্ণ করে তুলছিস ইদানীং তা যানুশ্চার্যা বিশেষতঃ হয়ে নির্মাণের কর্ণিকটাকে কোন যাদুবলে যেন লুকিয়ে ফেলেছে। সে কারণে মেতেরপলিসের মত সেরিব্রাল শব্দেরাও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে হৃৎপিণ্ডে। মুগ্ধতা ছাড়া কোনও শব্দ পচ্ছি না কুর্ণিশ জানিয়ে আজ রাখছি। ভালো থেকে আরও লিখে য। Prayers and wishe.