লোভ হয়, কেবলই ঘুরে ফিরে দেখি আর দেখাই
চিনি আর চেনাই, গভীর ছুঁই আর ছোঁয়াই
আরতিপ্রবণ পঞ্চভূতের শিরোত্তোলন
হালকা পলকা ফুলঝুরির নৃত্য
ভূমিদেশে ফেঁড়ে ওঠা চোঁচ ও তুণ্ডের রোমশ সবুজাভ প্রকাশ
ঝিঁঝির চোখের মতো স্তব্ধ নরম মেঘের ওড়াওড়ি
খুব পুষ্ট পেশীময় সে জোয়ার আচমকা
মাংসাশী হায়েনার মতো গরগর করে
নোয়ানো ঝুলে পড়া গোঁফ অকস্মাৎ খাড়া হয়ে ওঠে।
পরক্ষণেই উদাসীন মিহি ধাক্কায় নাভির ভেতরে অচেনা তৃষ্ণা ঝাঁকায়
মদির ঘ্রাণ ধাতব পাথরের তন্তুজাল বিকীর্ণ করে
লাফ দেয় সূর্যাস্তের নিষ্প্রভ ছায়ার জঠরে
গোধূলী মেঘে এখানে ওখানে চুনট করা কোঁচান রক্তফুল।
বহুদিন ধরেই পোষমানা ধড়ের ভেতরে অচেনা আগন্তুকের শির থাবার ভেতর মুখ ঢেকে শুঁকে চলেছে
প্রখর উন্মাদ সেই গন্ধ
সমস্ত আকাশে ঘনীভূত হয়ে আছে তার কালো অন্ধ শিকড়।
মাধ্যাকর্ষণ
ঝড়ের বাচালতার মধ্যে মাঝে মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছি
তারপর আবার জেগে উঠছি তার ক্রোধে ও গর্জনে
পরক্ষণেই ভেসে যাই পরকীয়া শাপভ্রষ্ট ঝঞ্ঝায়
জড়িয়ে যাই কদমফুলের শুক্ল প্লুত বিরহী রেণুতে
টলমল করে উঠল খড়ের চালা, পটপট মটকাচ্ছে ডাল
মাটির চাকলা ওড়ে, ঘাসের ছিবড়ে উপড়ায়
বনমৌচাকের তলায় আর ভনভনানী নেই
বোলতার বাসা ভেদ করে ছুটছে অদৃশ্য ইস্পাত বুলেট
ফুলের কাটামুণ্ড থেকে ছিটকে এসে পড়ল রক্তখেকো পরাগ
বৃক্ষশাখার ছিন্নাংশে কোনো নির্জ্ঞান চৈতন্যের স্মৃতি
একগুঁয়ে ঝটকায় মড়মড়াল শুকনো খড়খড়ে পাঁজর।
এই রণক্ষেত্রে দামামা নেই দোলাচল নেই
তবুও আপ্লুত খরবেগে তছনছ করে দিচ্ছে সজ্জিত জীবন
তোমার রতিপ্রবণ সত্তাটিকে শূলে চড়িয়ে ফিকফিক হাসছে
গোছানো জটিল দাঁড়ার মতো মননশীল গ্রন্থির ভেতর
লুটিয়ে গেল আমার পরাম্মুখ নাভির জট।
জীবন্যাস
কখনো মানিনি এভাবে আধবুড়ো হয়ে ফেটে যাওয়ায় চমক
নিভু উনুনের আয়োজনে আটপৌরে চৌহদ্দি খোলা থাক তোমাদের
গড়পড়তা দিনের রোজনামচায় মুখরিত হোক নাভি ও খোলস
ডিম্বানুর খরচক্রে মন্থিত হোক সুখ, প্রজ্ঞা পরম্পরা
রূপবান জৃম্ভণ ছেড়ে চলো যাই কুইলা পাহাড়ের গাঢ়ায়
কয়েকলক্ষ বছর আগে পলল প্রস্তরে পুঁতে রেখেছিলাম
প্রতিতামহীর পাঁজর, চামড়া আর ধ্যানী শান্ত দৃষ্টি
সেখানে এখন বুনো করমচার লাল আভা চাঁদের মতো ঝুলে আছে
ঝাঁকড়া কুল পাতায় সবুজ দমক আছড়ে পড়ে
হিংস্র শ্বাপদেরা বিরাট থাবার গর্তে মুখ লুকিয়ে রাখে
নিপুণ চৈতি আবেশে নতজানু হয়ে আছে মহাশির।
সমাগত আমার পূর্বপুরুষ ধীর ধ্যানে খোঁজে নির্বিশেষ অধিকল্প
তারুণ্যের তেজস্ক্রিয় অট্টহাস
নির্ভার স্তব্ধতায় রোপন করতে চায় শান্ত দাঁড়ার ক্রোধ
আমি উত্তরপুরুষ কমণ্ডুলু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি মহাব্যোমে
দ্বাদশ গিঁট ভেঙে উন্মোচিত করি প্রপিতামহের জীবন্যাস।
সঞ্চয়
প্রতিদিন লক্ষ করি অতিমানদের ঘরে ফেরা
অলস, ধীর আর দুলকি চাল তাদের
মুখে ঘাসদলা, ঝোপের টুকরো, কোঁচকানো চোখে পিঁচুটি
চওড়া নাসিকার নিচে থুতনিতে ফ্যানের দাগ
নিঃশ্বাসের ঘন ঘন যাওয়া আসায় আজব ফোঁ ফোঁ শব্দ হয়
মাঝে মাঝে ফোলানো কুঁজ থরথর করে কাঁপে
কাঁথার মতো ঝুলে থাকা গলকম্বল ঝুনো বাতাসে দোল খায়
এই মেঠো জংলা স্বচ্ছতোয়া পথের ছায়ায়
আমিও হয়ে উঠি বাঁশের চোঙের মতো সরু ও তীক্ষ্ণ
খুঁজি শাক ও কন্দমূলের নিচে বর্বর আগুন
পেতে চাই পশুদের চ্যাপ্টা রোমশ ফুদফুদে ল্যাজের চক্রবৎ উৎক্ষেপন
খুঁটে তুলি ঘাসের শ্বেতসার ও তার অমোঘ কৌমার্যের সঞ্চয়।
এখন আর বলগা ধরার কেউ নেই
ঐ যে কামহীন জোছনায় নুয়ে আছে ধবল বলদের যোনিদেশ
হৈ হৈ হীন টসটসে হয়ে আছে কোনো অবুঝ গভীর ব্যথায়
সেই প্রাকৃত আমোদের স্পর্শে হৃদি থেকে উবে গেছে ক্রূর অসূর
সেই নিরাসক্ত বাসনাহীন নির্বাক মন্থনে ভরে গেছে এই সারাৎসার
যেভাবে শান্ত হয়ে ফিরছে অতিমানবেরা পৃথিবী থেকে চাঁদের দিকে।
কাকতাড়ুয়া
সর্ষেক্ষেতে উচ্চশির কিম্ভুত কাকতাড়ুয়া
বিস্তৃত হলুদের নীরব উদগীরণের পাশে পোড়া হাঁড়ির মাথা
কুদকুদে ব্রহ্মকালোর মাঝে ফুটে উঠেছে
খড়ির গুঁড়োয় লেপা চোখ নাক দাঁত
জন্মমুহুর্ত থেকেই মুখ ভেংচিয়ে হি হি করে হাসছে
কদাকার মুখে লাবণ্য নেই অপরূপ জ্বলনে বিদ্ধ হয়ে আছে আঁখি
ফাতনার মতো হাত বাতাসে পতপত করে
কাষ্ঠদণ্ডের অঙ্গে ময়লা কানি জড়ানো
অচেনা প্রতাপের জোয়ারে কাকতাড়ুয়া হয়ে ওঠে বীভৎস প্রেতযোনি
হাজামজাখাজা দেহখানিতে ঘুরঘুর করে অনাময় আদিম ত্রাস।
ক্রমশ বাতাসও স্তব্ধ হল
পোকামাকড় কীটপতঙ্গ কেউ কাছে ঘেঁষছে না
একদল বলদ ভীমরূপে আঁতকে উঠে গোঁত গোঁত করে পালাল
মঁজরী গোঁজানো টেকো মাথায় ভর করে আছে বনবিবির ক্রোধ
আহত, উত্থানরহিত অঙ্গে মৃত্যুর রঙ ছড়ায়
তুমি বহুদূর থেকে দেখছ এই উন্মাদ অনালোকিত দুর্যোগ
তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছ রোমশ প্রলয়ের শাঁস।
2 comments on “কবিতা : অচিন্ত্য মাজী”
রণজিৎ অধিকারী
খুব উঁচুমানের কবিতা। নমস্কার রইল।
Unknown
অপূর্ব শব্দ চয়ন ,চেনা পরিচিত পরিবেশ শিল্পীর তুলিতে অপূ্র্ব কাব্্য মন্ডিত হয়েছে