মোস্তাফাপুরে বাড়ি লোকেশনাথের। তিনি ভোরবেলায় সাইকেলে দুইদিকে দুটো বড় ব্যাগ ঝুলিয়ে, পেছনে মাছ রাখার একটা বড় গামলা সাইকেলের টিউব দিয়ে শক্ত করে বেঁধে কাটোয়া শহরে আসেন। রাস্তায় তার জুটে যায় অনেক ব্যবসাদার বন্ধু। সকলে কিছু না কিছু বিক্রি করেন। কেউ সব্জি বিক্রি করেন কেউবা জমির আখ বিক্রি করেন।
লোকেশনাথ এই মাছের ব্যবসা করে সংসার চালান।
মাছের বাজারে বড় বড় বঁটি। মাছ কেটে পিস করে দেন মাছ বিক্রেতারা। কে কেমন সাইজ নেবেন, জিজ্ঞাসা করে তারা সেইমত কেটে দেন। লোকেশবাবুর পাশেই বসে এক মাছওয়ালী। বেশ চটপটে, তরতাজা, উদ্দাম নদীর মত ভাব। লোকেশবাবুর অল্প মাছ। তবু বিক্রি হতে সময় লাগে। পাশের চুমকি মাছওয়ালী বলে, আমারটা বিক্রি হয়ে গেলেই তোমার মাছ আমি চালিয়ে দোব। বেশি চিন্তা কোরো নি তো। চুপ করে বসে থাকো। লোকেশবাবু দেখেন সবাই চুমকির কাছে দাঁড়ায়। টিপে মাছের পেটি পরখ করে। সঙ্গে চোখ চলে যায় চুমকির খোলা বুকে। স্তনযুগল উর্ধমুখি হয়ে ডাকে খদ্দের । কি এক অমোঘ আকর্ষণে সব খদ্দের প্রথমে দাঁড়ায় চুমকির কাছে। চুমকির মাছ বিক্রি হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। তারপর ধরে লোকেশবাবুর মাছ। একইসঙ্গে সব মাছ বিক্রি হয়ে গেলে ওরা দুজনেই কচুরির দোকানে গিয়ে খেয়ে নেয় পেটভরে।
লোকেশবাবু ভাবেন, প্রায় দশ বছর মাছের লাইনে আছেন তিনি। চুমকি এসেছে তিন বছর। তবু এই তিন বছরে চুমকির পরিচিতি বেড়েছে অনেকটা।
কি কারণে চুমকি লোকেশবাবুকে এত সাহায্য করে তিনি জানেন না। চিন্তা করেন বসে বসে তার মেয়ের বয়সি হবে চুমকি। বেশ খোলামেলা উদার তার মন, কথাবার্তা। রাক ঢাক না রেখেই সরল মনে কথা বলে। জীবনে এই ধরণের মেয়েগুলোই কষ্ট পায় বেশি। একবার ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে এই মনে করে লোকেশবাবু সাইকেলে চাপলেন। এই পঁয়ষট্টি বছর বয়সেও লোকেশবাবু বারো মাইল পথ সাইকেল চালিয়ে যাওয়া আসা করেন শুধু সংসার বাঁচানোর জন্য।
তার সংসারে রুগ্ন স্ত্রী আর তিনি। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তবু তার বাড়ি এলে নাতি নাতনিদের মুখ চেয়ে কিছু খরচ করতে হয়। স্ত্রীর চিকিৎসাবাবদ একটা পরিমাণ টাকা সবসময় জমা রাখতে হয়।
পরের দিন সকালে মাছ নিয়ে চুমকির পাশে বসে লোকেশবাবু মাছ বিক্রি করছেন। চুমকির মাছের রেকর্ড খুব ভালো। খারাপ, পচা মাছ চুমকি রাখে না। চেঁচামেচি চলছে, দরদাম চলছে। আর এক জায়গায় হাঁকাহঁাকি চলছে। এই দুশো টাকা কেজি আর একজন বলছে আসুন একশ আশিতে দিয়ে দোব সেরা মাছ, নড়ছে।
কারও কথা ঠিকমত শোনা যাচ্ছে না। চুমকি লোকেশবাবুর মাছ বিক্রি শেষ করে আঁচল ঝেড়ে কোমরে বাঁধল। সোজা কচুরির দোকান। টেবিলে বসে দুজনেই জল খেলো। লোকেশবাবু বললেন, চুমকি, তুই কেন আমার জন্য এত কিছু করিস।
আমার বাবা নেই, মা নেই। কেউ নেই। আমি একা। আপনাকে আমি বাবার মত দেখি। তাই একটু আধটু আপনাকে সাহায্য করি। আপনার কাছে থাকলে আমি আমার বাবার গায়ের মিষ্টি গন্ধ পাই।
লোকেশবাবু বললেন, আমিও তোর চোখে আমার মেয়ের মত ভালোবাসা দেখেছি। আমার বড় মেয়ে আর তুই একই বয়সি। আজ থেকে তুই আমার মেয়ে হলি।
চুমকি বলল, তুমি আমার হারিয়ে যাওয়া বাবা। ধুলোবাবা।
কেন, ধুলোবাবা নাম দিলি রে চুমকি?
আপনাকে এই ধুলোর মাঝে পেয়েছি।
-তুমি আমার মাটির মায়ার বাবা। প্রতি বিপদে আপদে তোমার পরামর্শ পেয়েছি। এই বলে চুমকি তার পাতানো ধুলোবাবাকে প্রণাম করলো।
—–তাহলে তুই একা কেন থাকবি? আমার বাড়িতে চলে আয়। বাপ মেয়ে একসঙ্গে থাকব। যা জুটবে খাব। ঘরে তুই মা কে পাবি। রুগ্ন হলেও আমার স্ত্রী খুব গল্প করতে ভালোবাসে। দেখবি কোন অসুবিধে হবে না তোর।
—-ঠিক আছে সময় হলে তাই হবে বাবা।
এই কথা বলে চুমকি নিজের বাড়ি চলে যায়। সে একা বলে সন্ধে থেকে শুরু হয় লম্পটদের অত্যাচার। জগা প্রস্তাব দেয় বিছানায় শোবার জন্য। এমনকি গ্রামের ভিকু পেধান পর্যন্ত চলে আসে কামের তাড়নায়। চুমকি ভাবে, হায় রে মানব জমিন শুধু কামের জোয়ারে ভেসে গেলে। আঁচলের স্নেহ ভুলে গেলি নিশিথে।
চুমকির ধারালো শান দেওয়া ডাল কাটার হেঁসোদা দেখে কেউ সামনে যায় না। সে বলে, ঘরের ভেতরে ঢুকলে গলা আর দেহ আলাদা করে দোবো। আমি কারও টাকার ধার ধারি না। আমি খেটে খাই। পেয়োজন হলি বাবার বাড়ি চলে যাবো। আমার বাবা মরে নাই বুঝলি।
চুমকির কথা অনেকে বুঝতে লারে। কিন্তু এই রহস্যময় কতা শুনি কেউ আগায় না, পাশের মাসি বলে আমি সব জানি মিনসেগোলার স্বভাব। শালারা দিনে সাধু রাতে চদু রাতচড়া। বাড়িতে নিজের বউ বেটি থাকলেও শালারা আমাদের গতর দেখে নুকিয়ে।
তারপর অজয়ের বান এলো বর্ষায়। কাঁচা ঘর বাড়ি জলের তোড়ে ভেসে গেল তেপান্তরের মাঠে। চুমকির ঘরও ভেঙ্গে গেল বানের তোড়ে।
পূর্ব বর্ধমানের অজয় এক ভয়ংকর নদ। গরমে নরম বর্ষায় চরম সর্বনাশের কারণ এই অজয় নদ। ধানের থোঁড়ে জল ঢুকলে আগরা ধান হয়ে যায়। তখন লোকেদের না খেতে পাওয়ার দশা।
চুমকির সঙ্গে ধুলোবাবার দেখা হল তিনমাস পরে মাছের বাজারে। ধুলোবাবা মেয়ের খবর নিল। সে বললো— কি রে চুমকি বানে তু কেমন ছিলিস?
—-আর বোলো না বাবা বাড়িঘর কিছুই নাই। তালপাতার ঘরে আছি। মাতালের অত্যাচার বেড়েছে। মেয়েদের একা দেখলে অনেকে ছুঁক ছু্ক করে আশেপাশে। আর আমার হেঁসোদাটা মাটি চাপা পড়ে হারিয়ে গেল। ওখানে আর থাকা মস্কিল বটে। তোমার খবর কি বাবা। মা কেমন আছে।
*— এই ক মাস ভুগে একমাস আগে তোর মা মরে গেলো রে।
—-তাহলে তোমার খাওয়া দাওয়া কি করে চলে বাবা।
– চেয়ে চিন্তে যা জোটে তাই খাই।
আজ মাছের বাজারে ভালো লাভ করেছে চুমকি। সে বাবাকে খাওয়ার দিয়ে বাড়ি গেল। বাবা বারে বারে পই পই করে বললে চুমকি তু চলে আয়। দুজনে একসঙ্গে থাকব।
চুমকি চিন্তা করতে করতে বাড়ি গেল।
—রেতের বেলা আসবা \’মাসি বলল।
চুমকি বললো মাসি কে গো?
মাসি বললো ও তু বুজবি না। যা শোগা যা। যৌবন বয়েস। একটু খোলামেলা হ। দেখবি মজা আছে।
রাত হলে চুমকি তালপাতার ঘরে শুয়ে পরলো।মাসির কথা তার ভালো লাগে নাই। চুমকি দেখলো, হঠাৎ মাঝরাতে চাল ফুঁড়ে নেমে এলো পেধানের বড় জিভ। চুমকি লাথি মেরে জিভের লালা ঘুচিয়ে দিল। পেধান বাবাগো বলে পড়ে গেল। চুমকি ছুটতে ছুটতে বাবার বাড়ি চলে এলো। তখন রাত দুটো। পেঁচা ডাকছে শিমুল গাছে।
ধুলোবাবা সব শুনলো। রাগে তার শরীরে জওয়ান বেলার শিরা ফুলে উঠলো। ধুলোবাবা বললো, তোর সঙ্গে আমি বিয়ে দোব আমাদের গ্রামের বড় পালোয়ান ভীম মোড়লের সঙ্গে। তাকে শুনিয়ে রেকেছি তোর কতা। তারপর তোর বাড়ির ওখানে মাটির বাড়ি করবো। থাকবো সবাই তোদের পেধানের গাঁয়ে। শালাকে হাড় আম হাগিয়ে ছাড়বো।আর আমার বাড়ি বেচবো না। মাঝে মাঝে আসবো। মেয়ে জামাইরা পয়োজনে আসবে গাঁয়ে।
আবার সকাল হয়। মেঘ সরে গিয়ে রোদ ওঠে। সকালে গান গাইতে গাইতে ছুটে আসে ভীম পালোয়ান। চুমকি তার পালোয়ান মার্কা শরীর দেখে মুগ্ধ। ভীম পালোয়ান ধুলোবাবাকে ডেকে বললো, খুড়ো ডেকে পাঠিয়েছ ক্যানে। কোনো শালা কিচু অসুবিদা করেছে না কি?
ধুলোবাবা বললো বোসো বাবা বোসো। তোকে আমার এই নতুন মেয়েকে দেকাবো বলে ডেকেছি। আগে বলেছিলাম তোমাকে এই মেয়ের কতা।
পালোয়ান চোখ তুলে দেখলো চুমকিকে। এ তো তার স্বপ্নের নায়িকা। সে ভাবে, সংসার সুখের হবে লিশ্চয় এই লক্ষীর গুণে আর রূপে। রূপ সে দেখছে সামনে আর গুণের কথা শুনেছে খুড়োর কাছে।
খুড়ো পুরোনো পালোয়ান। তার কাছেই শেখা সব প্যাঁচ পয়জার এই পালোয়ানের।
চুমকি লাজে রাঙা। পালোয়ানের চোখ স্থির। প্রথম দর্শনেই প্রেম। পালোয়ান বলে, তোমার নাম কি?
—- চুমকি। তোমার নাম?
— ভীম পালোয়ান।
তারপর দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। অনেক কালের চেনা পরস্পরের দুজোড়া চোখ।
ধুলোবাবার ডাকে পালোয়ান চেতনা ফিরে পেয়ে বললো, খুড়ো একটা ভালো দিন দ্যাখো। আমার পছন্দ হয়েছে তোমার মেয়েকে দেখে। এই বলে পালোয়ান ছুটে চলে গেলো সবুজ মাঠে। চুমকির চোখে এখন শুধু পালোয়ান আর সবুজ জীবনের ঈশারা..
Leave a reply