উত্তুরে হাওয়া
বাঁশি পড়ে আছে পৌষে; উত্তুরে হাওয়া, বাজাও, তাকে বাজাও! সে আয়ুর পথে হেঁটেছে বিস্তর; পুরাতন জামবাটির মতো—দাগ পড়ে গেছে, তুবড়ে গেছে; চুপ করে গেছে তারপর। এখন ঠোকা দিলেও ঝাঁপ ফেলে রাখে।
তবু, তোমার সঙ্গে দু-চার কথা বলে, অবসাদের ফাঁকে। কখনও বলেছে, ভাল লাগে তোমায়? সে বলবে না। বলার লোক সে নয়। সে কেবল নীরব থেকে ব্যথা দিতে জানে। জটিল করে তুলতে জানে প্রতিটি নৈঃশব্দযাপন। সে ভয় পায়, পাছে কেউ দেখে ফ্যালে আঘাতের বিখ্যাত ঘর। পাছে জিজ্ঞেস করে কে হাঁড়ি ভেঙে ছিল হাটে!
নবীন পুদিনাপাতার মতো শরীর তোমার, বাবুই পাখির মতো চঞ্চল। ঐ প্রৌঢ় সুপুরিগাছে বুনে তোলো টলমলে বাসা। বাধা সে দেবে না। বীতশ্রদ্ধ দার্শনিকের মতো তাকিয়ে থাকবে শুধু। যেন কোনও স্পৃহার পরিচিত সুঘ্রাণ নেই আর। যেন এ জীবন থেকে পাল তুলে ভেসে গেছে প্রসিদ্ধ মধু আর নক্ষত্রের রাত। তবুও, এক অপ্রত্যাশিত নির্জনতায় সম্মতি আর নিষেধের মাঝখানে সে রেখে যাবে সন্ধ্যাতারার লণ্ঠন। ওটাই খাঁটি সময়। ঐ মুহূর্তে তাকে ঠোঁটে চেপে ধরো; মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে পুনরায় হরিণ করো।
সে বাজে! বাজে লোক, তবু বাজে বাসনায়। রূপের আঘাতে খুলে দাও ব্রহ্মপুত্র, বাঁশির— আবার কোকিলের স্পর্ধা দাও তাকে… তার মলিন সাদা পাঞ্জাবিটি পাট-ভেঙে গাঢ় কাঠের বোতামে সাজাও
উত্তুরে হাওয়া, ভাল যখন বেসছে জটিল বাঁশি, বাজাও, তাকে নতুন করে বাজাও!
বিকেলের কবিতা
তুমিও বিকেল হলে আমার এই নদীটির পাশে। তোমাকে তেমনভাবে কাশফুলে দেখা গেলে জ্বরের মতোই ঢেউ আসে। তোমার শরীর থেকে উড়ে যায় মাছরাঙা, বক আর বসন্তবৌরী। আমার এই কবেকার পাঁচালির শিবদেহ, তোমার ওই কবেকার গৌরী। শুনেছে সন্ধ্যাতারা, সুন্দর চুপিচুপি ফিরে আসে বিদ্যার ডাকে, রূপকথা বয়ে যায় ইতিহাস মাখা এই বর্ধমানের আকেঁ-বাকেঁ…
পালতোলা নৌকারা আমলকী পার করে মহিষের মতো যায় মন্থরে তমালের ঘরে। আমাদের টুসু গান মাঠ ঘাটে উড়ে ঘুরে আকাশের জলরঙে ঝরে। কথাগুলো রাঙা হয়, নীরবতা ফলে ওঠে কামরাঙা পেয়ারার বনে; মনের শরীরকথা শরীর আজ মন পেতে শোনে…
ফাঁকে ফাঁকে রাখা আছে সব চিঠি নাগালের পারে; যে বসেছে সে জেনেছে কাকে বলে বসে-থাকা নদী আর বিকেলের ধারে…
দেহমল্লার
বৃষ্টি সরোদ হয় দেহমল্লার ছুঁয়ে গেলে…
তোমার চিতোরগড়ে প্রবেশ করে দেখি বাদল মুখ আকাশের কাছে এক উচ্চ মিনারে তোমার ঘরে প্রদীপ শিখা। আমি মোগল অশ্বারোহী। সন্ধির বার্তা নিয়ে এসেছি আখরোটের খয়েরি দেশ থেকে। আমার আরবী ঘোড়ার ক্ষুরে সমরখন্দের ধুলো ওড়ে। তুমি বাতায়নে দাঁড়াও। চিতোরের রাজকন্যা, তুমি সৌদামিনী ঋতু।
তোমায় পেতে হবে, পেতেই হবে— এই ভেবে আমার আয়ু বালির মতো আরাবল্লীর আনাচে-কানাচে ওড়ে। তুমি যে সুর গাইছিলে, তা কি মিঞা তানসেনের? আমি তো শুনেছি শুধু ঘোড়াদের দেশে যাযাবর বাজিয়েছে হরিণের চামড়ার ঢোলক; চাষীদের মুখে মুখে অবিরল ঘাস-কাটার গান।
বৃষ্টি নামে; অসংখ্য টোপরের মতো ছড়িয়ে থাকা আরাবল্লীর আকাশে আকাশে মেঘ গর্জন করে। আমি যাবতীয় প্রহরীর চোখ এড়িয়ে তোমার কক্ষে প্রবেশ করি। তোমার চোখে বিস্ময়; আমার শরীরে হিন্দুকুশের হাওয়া। দূরে ঘোড়ার ডাক; হাতির মদ বারির গন্ধে ভারী-হয়ে-ওঠা ভেজা বাতাসের ঘ্রাণ।
ঠোঁটের কোণায় নরম হাসি পল্লবিত করে তুমি অস্ফুটে বল, বর্বর! স্বেচ্ছাচারী বাদল পুরুষ! অস্পষ্ট গোঙানি তুলে ঘন মেঘে উড়ে যায় লঘু পারাবত; দাঁড়ের ময়না বলে ওঠে—আ মোলো যা, জল ঢেলে দে!
বিলাসমঙ্গল
ফাগুনে রূপ ঢেলে রাত্রি যায়— আমরা কাছাকাছি কোন হাওয়ায়? আকাশে ধ্রুবতারা, দশটা মেঘ; রোমের প্রতিঘরে পিয়াসাবেগ। কুড়িটা আঙুলের সোহাগচাল; আমার তলোয়ার, তোমার ঢাল। আদিম জোনাকিরা শরীরে গান। অলস ছায়ানট, শিথিল কান। বিদিশা ভেসে যায় দামোদরে—তমালশাখা থেকে রাধা ঝরে। দামাল হিজিবিজি, মাতাল ধুম। মধুতে হাবুডুবু, কাজলে ঘুম। বিলাসজমিদার খাজনা চায়। সোহাগবুলবুলি শস্য খায়। কামজকুসুমের শিরায় টান। সবুজ শাড়ি ঢাকা সোনালি ধান। আদরে ঝুরোঝুরো দেহলতা, বিলাসে ডুবুডুবু রূপকথা…
অতীতসাগর
যাদের স্পর্শে সৌদামিনী হয়েছে শরীর, তাদের কথা লিখে যাই এইসব ঝুরোঝুরো বিলাসকীর্তনে। চিঠিভর্তি শিরা-উপশিরা রূপসীরা উপোসী রেখেছে। আমাদের মুড়ি, গান, তালসারি, শাজাহান— ছাতা ফেলে চলে গেছে অতীতসাগরে…
5 comments on “সৌভিক গুহ সরকার”
উজ্জ্বল ঘোষ
অসামান্য লেখা সব!
Raju mondal
খুব সুন্দর লেখাগুলি ❤️
Ranita mukherjee
পড়ে মন স্থির হল। কোলাহলের স্তর পেরিয়ে এক নির্জন, শান্ত, নির্বিকল্পক স্তর থেকে সবিকল্পক স্তরের দিকে যাচ্ছি ।
Himadri Sekhar Chakraborty
শব্দের ভানুমতীর খেল প্রত্যক্ষ করলাম। শ্রদ্ধা জানাই এমন কলমে💖😷
Ratri Bose
প্রতিটি বর্ণনা খুব সুন্দর