মাইকেল ও হাওধা কর্তৃক কে সচ্চিদানন্দনের একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার
বাংলা ভাষান্তর সোহম চক্রবর্তী
আপনার পরিপ্রেক্ষিতের ব্যাপারে একটু শুনি। সাহিত্যের প্রতি কী আপনাকে প্রথম আকর্ষণ করল?
আমার আগে আমার পরিবারে কেউ লেখক ছিলেন না, যদিও আমার দাদা তাঁর স্কুল ও কলেজজীবনে কবিতা লিখতেন। যখনই আমি ভাবতে চেষ্টা করি যে কী আসলে আমায় কবিতার কাছে নিয়ে এল, আমি শুনতে পাই দক্ষিণ ভারতের কেরালায়, আমার গ্রামে, অনর্গল বৃষ্টিপাতের নানারকম শব্দ। স্কুলবেলায় পড়া মহাকাব্য রামায়ণের সেই উজ্জ্বল পঙক্তিগুলির কথাও মনে পড়ে আমার, যেখানে কবি আহ্বান জানাচ্ছেন শব্দের দেবী, ভারতীয় কাব্যমানসী সরস্বতীকে, যেন সমুদ্রের নিরন্তর ঢেউয়ের মতনই তাঁর অন্তরে তিনি জুগিয়ে চলেন সার্থকতম শব্দ, একের পর এক – বিরামহীন। আমার মা আমাকে কাকেদের সাথে, গাছেদের সাথে কথা বলা শিখিয়েছিলেন; ধর্মপ্রাণ বাবার কাছ থেকে আমি শিখেছিলাম ঈশ্বর ও পরমাত্মার সাথে কীভাবে সংযোগস্থাপন করতে হয়। আমার অপ্রকৃতিস্থ ঠাকুমা আমাকে দেখিয়েছিলেন প্রাত্যহিক এই জীবনের জঘন্য সাধারণত্ব আর ক্লান্তিকর গতানুগতিকতা থেকে পালিয়ে বাঁচার উপায় হিসেবে এক সমান্তরাল পৃথিবী গ’ড়ে নেওয়ার পথ; মৃতেরা আমায় শিখিয়েছিল মাটির সঙ্গে মিশে যেতে; বাতাস আমায় শিখিয়েছিল সবার চোখের আড়াল দিয়ে হেঁটে যাওয়া আর কেঁপে ওঠার পাঠ; আর বৃষ্টি আমায় দিয়েছিল সহস্র স্বরে কথা বলার শিক্ষা। আমার নয়নমোহন গ্রাম এবং তার হতদরিদ্র মানুষেরাও আমায় কবিতার দিকে ঠেলে দিয়েছে নিশ্চয়ই। এহেন বিরল সব শিক্ষকের সান্নিধ্য পাওয়ার পর সম্ভবত আমার পক্ষে কবি না-হওয়াটা একপ্রকার অসম্ভবই ছিল।
সাহিত্যের বাইরে আপনার অন্যান্য আগ্রহের জায়গা কী কী?
আমার দ্বিতীয় প্রেম হ’ল চিত্রকলা। কোথাও বেড়াতে গেলে সবার আগে আমি চিত্রপ্রদর্শনীতেই যাই। ছবি নিয়ে লিখেওছি আমি। তারপর আছে সিনেমা। চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়ে আমি সেখানকার হালচাল বুঝতে চেষ্টা ক’রি। সমালোচকদের মতে আমার কবিতায় দৃশ্যকল্পের যে শক্তিশালী ব্যবহার, একইসাথে, পূর্ণাঙ্গতার মাধ্যম হিসেবে আখ্যানধর্মিতার যে উপাদানটি লক্ষ্য করা যায় – সেইটিও, কোনোভাবে বোধহয় সিনেমার প্রতি আমার এই আকর্ষণটার সঙ্গে সম্পর্কিত। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, দর্শন ও ইতিহাসের দিকেও আমার বিশেষ ঝোঁক আছে। আমি সবরকমের গানও শুনি। মানবদেহ, বিশেষত মস্তিস্ক নিয়ে নিত্যনতুন সব আবিষ্কার, পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সম্ভাবনা কিংবা সৌরজগৎ বিষয়ক নানান গবেষণাও আমায় খুব টানে।
সাহিত্যের কোন্ শৈলী বা ঘরানাটা পাঠক হিসেবে আপনার সবচেয়ে প্রিয়?
আভা-গাঁর্দের সমস্তধরণের লেখা আমায় বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। বিশ্বকবিতার পাশাপাশি আমি সারা পৃথিবীর প্রচুর গল্পও প’ড়ি। আমার প্রিয় কয়েকজন লেখকের নাম করলে আপনি হয়তো কিছুটা ধারণা করতে পারবেন যে মূলত কোন্ ধরণের লেখা আমার পছন্দ – যেমন ধরুন – দস্তভয়স্কি, কাফকা, কাজান্তসাকিস, ইটালো ক্যালভিনো, জেমস জয়েস, স্যামুয়েল বেকেট, জর্জ লুই বোর্জেস, মিলান কুন্দেরা, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, জে এম কোয়েটজি, মারিয়া ভের্গাস লোসা, সলমন রুশদি – এরকম আরও অনেকে, তবে এঁদের সেই সমস্ত লেখার প্রায় সবক’টিই আমি পড়েছি, যেগুলি ইংরাজিতে পাওয়া যায়। আমি নানান নাটকও প’ড়ি আর ভালো বিশ্লেষণধর্মী বা তাত্ত্বিক লেখাও আমার বিশেষ পছন্দের, উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি রোল্যান্ড বার্থেস, মরিস ব্লাশঁ, মিশেল ফুকো, জাক দেরিদা কিংবা উমবার্তো ইকো-র মতো কয়েকটি নাম। অতীতে আমার গবেষণার বিষয় ছিল উত্তর-নির্মাণবাদ।
যখন আপনি প্রথম লিখতে আসেন, সে-সময় মালয়ালি কবিতার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সম্পর্কে আপনি কি সচেতন ছিলেন?
আমার লেখালিখির সূত্রপাত স্কুলজীবন থেকে – গ্রামের একটি ছোট্ট পত্রিকায় যখন আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়, তখন বয়স বছর বারো হবে – আমাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে আমার বোধ তখন খুবই ভাসা-ভাসা। অবশ্যই ততদিনে আমি বেশ ক’জন ধ্রুপদী সাহিত্যিককে প’ড়ে ফেলেছি, তবে ঐতিহ্যের ব্যাপারে সামগ্রিক ধারণাটি তখনও তেমন মজবুত ছিল না। কিন্তু কালক্রমে, যখন আমি কবিতা নিয়ে গুরুত্ব সহকারে ভাবনাচিন্তা শুরু করলাম, তখন থেকেই আমার আস্তে আস্তে, সচেতনভাবে আমাদের কবিদেরকে পড়া এবং পরবর্তীতে তাঁদের কাজের বিষয়ে লেখালিখির শুরু। আমার নিজস্ব অস্ত্র ছিল এবং আমি আমার যে-সকল পূর্বসূরীকে কাব্যিক অভিজ্ঞতা ও গঠনের নিরিখে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব’লে মনে করেছি, তাঁদের নিয়ে কবিতাও লিখেছি। তবে আমি আজও এমনকি তরুণতম কবিটিকেও প’ড়ি আর স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অন্যদের অভ্যাস থেকে শিক্ষা নিতে কক্ষনো পিছপা হই না।
পাশ্চাত্যের মানুষজন কি ‘ভারতীয়’ সারবত্তার গুটিকয় লেখা প’ড়ে ভারতের সম্পর্কে একটা ‘ভুল’ পরিচয় পান – অর্থাৎ কী-না সেইসব ভারতীয় ‘অভিবাসী লেখা’ প’ড়ে, যেগুলি লেখেন ভারতের বাইরে বেড়ে ওঠা কয়েকজন লেখক, ‘স্বভূমি’-র সঙ্গে যাঁদের সংযোগ অত্যন্ত ক্ষীণ?
এমনকি ভারতীয় লেখক, যাঁরা ইংরাজিতে লেখালিখি করেন, তাঁদের মধ্যেও দু’টি শ্রেণী আছে – যাঁরা ভারতেই থাকেন আর লেখেন ভারতীয় জীবন ও সমাজ সম্বন্ধে, এবং যাঁরা বিদেশে থাকেন আর সেখান থেকে মাঝেমাঝেই ভারত-ভ্রমণে আসেন ‘বিষয়বস্তু’-র খোঁজে। তারপর আছেন তাঁরা, যাঁরা লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কোনও একটি ভারতীয় ভাষায়, যাদের মধ্যে বাইশটি সংবিধান-স্বীকৃত (তার বাইরেও আরও বহু ভাষা আছে)। এইসমস্ত ভাষায় যাঁরা লেখেন, তাঁদের অবস্থান আমাদের বাস্তবতার সবচেয়ে কাছাকাছি, কেননা তার সূক্ষ্মতা ও জটিলতাগুলিকে ইংরাজিতে ধরা প্রায় অসম্ভব; ভারতে ইংরাজি এখনও মুষ্টিমেয় অভিজাতদের ভাষা হয়েই র’য়ে গেছে। নানান কারণে যাঁরা ইংরাজিতে লেখালিখি করেন – কেউ হয়তো করেন তাঁর বাইরে বেড়ে-ওঠা ও পড়াশোনার দরুন ইংরাজি ছাড়া অন্য আর একটিও ভাষা ভালোভাবে না-জানার জন্য; কেউ হয়তো করেন এই সুযোগে হঠাৎ ক’রে সর্বভারতীয় এমনকি ‘আন্তর্জাতিক’ হ’য়ে ওঠা যায় ব’লে; কেউ হয়তো করেন বিদেশে বসবাসের কারণে – তাঁরা সকলেই তাঁদের লেখায় একটা খুব অবাস্তব ভারতবর্ষের নির্মাণ করেন। তাঁদের বেশিরভাগের কাছেই ভারত একটি জাতিতত্ত্বগত সংগ্রহশালা আর তাঁদের প্রবণতা হ’ল সেই সুদৃশ্য মোড়কে ভারতটাকে বিক্রি করার। দুর্ভাগ্যবশত এই প্রবণতা দেশের ভিতর ব’সে যাঁরা ইংরাজিতে লেখেন তাঁদের অনেককেও ভুল পথে চালিত করতে শুরু করেছে। বেশিরভাগ সময়েই তাঁদের কাজগুলিকে সাহিত্য হিসেবে আর পড়া হ’চ্ছে না, পড়া হ’চ্ছে ইতিহাস, জাতিতত্ত্ব, এমনকি নৃতত্ত্বের দলিল হিসেবে। আপনার সম্পূর্ণ প্রেক্ষিতটাই মিথ্যে হ’য়ে যাবে যদি আপনি বিদেশি বাজারের দিকে তাকাতে শুরু করেন। ঈশ্বরের কৃপায় কবিতা এসবকিছুর থেকে মুক্ত কেননা সে-অর্থে তার কোনও ‘বাজার’ নেই।
রাজনৈতিক বীক্ষার নিরিখে আপনি নিজেকে কীভাবে দেখেন?
আমার লিখনজীবনের একটা পর্যায় আমি অতিবামপন্থী পরিচয় নিয়ে কাটিয়েছি। কিন্তু এখন আমার বোধ আরও অনেক বেশি প্রসারিত। আমার চেতনা এখনও জাগ্রত ভীষণভাবেই, তবে তা আর শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; তা এখন অনেক বেশি ক’রে প্রজাতি-কেন্দ্রিক। আমি সাধারণের দর্শনে বিশ্বাস ক’রি – আমি বিশ্বাস ক’রি যে এই পৃথিবী, তার জলহাওয়া কেবল মানুষের জন্য নয়, প্রতিটি উপাদান যা আমাদের বাস্তুতন্ত্রকে তৈরি করে, তাদের সকলের জন্য। আমি প্রায়শই এই পৃথিবীকে দেখতে চেষ্টা ক’রি পশুপাখি, কীটপতঙ্গ আর গাছপালার চোখ দিয়ে, যা আমায় মনুষ্যোচিত ঔদ্ধত্য থেকে মুক্তি দেয়।
এ-সময়ের ভারতীয় কবি-লেখকদের মধ্যে এত কম কয়েকজনমাত্রই অনুদিত হন কেন – এটা তো বিশ্বের অন্যান্য অংশের, বিশেষ ক’রে পশ্চিমের বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যাওয়ার পথে তাঁদের বিরাট একটা অন্তরায়?
এর জন্য কিছু অংশে দায়ী অনুবাদ নিয়ে চলতে থাকা আন্তর্জাতিক রাজনীতি আর অন্য একটা কারণ হ’ল সরাসরি কোনও একটি ভারতীয় ভাষা থেকে বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করতে পারেন, দেশের ভিতরে হোক কি বাইরে, তেমন দক্ষ মানুষের দুর্ভাগ্যজনক অপ্রাচুর্য। এমনকি ভালোভাবে ইংরাজিতে অনুবাদ করতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যাই সীমিত, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, ইতালীয়, ওয়েলশ্ বা আইরিশের কথা তো ছেড়েই দিন। কাজেই, সংযোগের ভাষা হিসেবে আমাদের শুধুমাত্র ইংরাজির উপরেই ভরসা করতে হ’চ্ছে। আমার সৌভাগ্য যে ফরাসি ও জার্মান ভাষায় আমার কাজ সরাসরি অনুদিত হয়েছে, কিন্তু আমার ইতালীয় আর আরবি অনুবাদগুলির প্রতিটিই হয়েছে আমার নিজের করা ইংরাজি অনুবাদ থেকে, যদিও সেইসব ভাষায় পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাহায্য নিয়ে আমি মূল লেখাগুলির সাথে সংশ্লিষ্ট অনুবাদগুলির একটা তুলনা ক’রে দেখেছিলাম। বিদেশের বহু প্রকাশকই এরকম পরোক্ষ অনুবাদ গ্রহণ করতে চান না। অন্যান্য নানান ভাষায় পৌঁছনোর উপায় হিসেবে ইংরাজি অনুবাদের কাজ আরও বাড়ানো ছাড়া আমি অবশ্য আর কোনও সহজ পথ দেখছি না। এ-ধরণের অনুবাদে যা-কিছু উপাদানই হারিয়ে যাক না কেন, মূল লেখাটির থেকে কিছুটা অন্তত অন্য ভাষায় পৌঁছয়।
আপনি কি মনে করেন যে এই মুহূর্তে প্রাচ্যের প্রতি পাশ্চাত্যের, এবং উল্টোটারও, মূল্যায়নের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা হ’চ্ছে? প্রাচ্যের কি এমন কোনও দিক আছে যা আপনার মতে সবসময় ‘তারই’ থাকা উচিত?
আমার মনে হয় না যে একে অপরকে বুঝতে চাওয়ার মধ্যে কোনওরকম ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। ‘পাশ্চাত্য’ আর ‘প্রাচ্য’ নামের এই দু’টো ভয়ঙ্কর সীমাবদ্ধ আর সার্বিক শ্রেণীবিভাজনটা আমার কাছে আশ্চর্যের। ‘আধ্যাত্মিক প্রাচ্য’ আর ‘বস্তুবাদী পাশ্চাত্য’ – এহেন ছকে-বাঁধা চিন্তাভাবনাগুলো এর মধ্যেই আমাদের অনেক ক্ষতি ক’রে ফেলেছে। আবার, খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের সমস্ত দেশ হুবহু একইরকম হয় না – জাপান, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া – এদের যদি কিছু মিল থাকে, তবে প্রায় সমান সংখ্যক অমিলও আছে। তথাকথিত ‘পাশ্চাত্যের’ ক্ষেত্রেও কথাটা সমানভাবে সত্যি। আয়ারল্যান্ড আর কতটাই-বা ফ্রান্সের মতো, কিংবা জার্মানি আর আইসল্যান্ডের মধ্যেই বা তেমন একটা মিল কোথায়? একইসঙ্গে, বিশ্বায়নের দরুন জীবনযাত্রার একটা বাস্তব সাধারণীকরণ ঘটছে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যেকোনো একটা সুপারমার্কেট বা শপিংমলে গেলে আপনি হয়তো একই সংস্থার তৈরি-করা একই পণ্যসম্ভার দেখতে পাবেন। কিছুক্ষেত্রে এই জিনিসটা আধুনিক শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ঘটছে। সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচিতির অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে চারদিকে এত হইহল্লা সত্ত্বেও এই পরিমাণ বিনিময় আর পারস্পরিক প্রভাবের কারণে তাদের প্রায়ই একইরকম মনে হয়। সংস্কৃতি এখন একটা প্রবাহের মধ্যে আছে, সম্ভবত মানবসভ্যতার ইতিহাসের যেকোনো পর্যায়ের তুলনায় বেশি তীব্রভাবে। সমকালীন ‘প্রাচ্যের’ অনেকখানি ‘পাশ্চাত্য’সুলভ, এবং উল্টোটাও।
আপনি এখন ভারতের যে-অঞ্চলে রয়েছেন সেখানে লেখকদের বর্তমান পরিস্থিতি এবং আধুনিক (উত্তর-আধুনিক) ভারতীয় সাহিত্য ও ভাষার ক্রমবিকাশের ব্যাপারে সামগ্রিকভাবে কিছু বলুন।
এই বিষয়ের উপর আমি ইংরাজিতে তিনটি বই লিখেছি। এখানে আমি খুব সংক্ষেপে ক’টা কথা বলব। বর্তমানে আমি ভারতের রাজধানী শহর দিল্লিতে থাকি, যা আসলে বহু সংস্কৃতির সঙ্গমস্থল, প্রকৃত অর্থেই মহানগরী। কাজেই, নানান সাহিত্য সম্পর্কে জানার সুযোগ আমার হয়েছে। ভারতে সাহিত্য অকাদেমির সম্পাদক থাকার সুবাদেও অনেক সাহিত্যই আমি খুব কাছ থেকে অনুধাবন করেছি। উচ্চকিত আধুনিকতার তুঙ্গ বিকাশের পর এই সময় নানান ভাষার ভারতীয় সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ঘটনাগুলি ঘটছে সেগুলি হ’ল – নারীবাদী না হলেও নারীকেন্দ্রিক সাহিত্য (যার ইতিহাস প্রায় ২৬ শতাব্দী প্রাচীন, তবে মান ও পরিমাণ মিলিয়ে তার স্পষ্ট বিস্তার দেখা যাচ্ছে গত ১৫-২০ বছর ধ’রে), প্রান্তিক সাহিত্য (বিশেষ ক’রে দলিতদের নিয়ে, যারা একসময় ছিল অচ্ছুৎ আর বর্ণব্যবস্থার সবচেয়ে নীচে – দলিত-কেন্দ্রিক কবিতা, গল্প, আত্মজীবনী সবকিছুই এখন লেখা হ’চ্ছে একটা সতেজ বাক্-বৈশিষ্ট্যে, যার মধ্যে এসে পড়ছে অজস্র দেহাতি ও উপভাষিক উপাদান, যেগুলি আমাদের নৈতিক ভিত্তিসমূহের আপাদমস্তক পুনর্গঠনের মাধ্যমে গ’ড়ে তুলছে নতুন এক নান্দনিকতা) এবং সংখ্যালঘু সাহিত্যের (যেগুলি লিখছেন জাতিগত, ধর্মগত, ভাষাগত এবং যৌন-পরিচয়ভিত্তিক সংখ্যালঘুরা) ব্যাপক উত্থান।
ভারতীয় সাহিত্যের কি ক্রমসমৃদ্ধি ঘটছে?
আমার মতে হ্যাঁ – তার একটা কারণ বিরোধমূলক সাহিত্যের উপরোক্ত আঙ্গিকগুলি ক্রমশ প্রসার পাওয়ার ফলে উদ্ভূত নতুন একরকমের স্পন্দমানতা, আর অন্য একটা কারণ হ’ল বহু বহু আকর্ষণীয় লেখকের আবির্ভাব, ইংরাজিতে লেখার ব্যাপারে যাঁরা তাঁদের পূর্বসূরীদের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। আগেও যেমনটি বলেছি, তাঁদের মধ্যে সব ধরণের লেখকই আছেন, তবে অনেক ভালো লেখকও আছেন, বিশেষত কবি ও গল্পকারদের মধ্যে; তাছাড়াও ইংরাজিতে এখন বহু ভালো ভালো ‘নন্-ফিকশন’-ও তৈরি হ’চ্ছে। পাশ্চাত্যের প্রকাশকেরাও আফ্রিকান ও ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যের ভাঁড়ার প্রায় ফুরিয়ে ফেলে বর্তমানে বেশি বেশি ক’রে ভারতীয় সাহিত্যের দিকে ঝুঁকছেন, তা সে মূল ইংরাজি লেখাই হোক বা নানান ভারতীয় ভাষা থেকে অনুবাদ।
আপনি তো ওয়েলস্-সহ অন্যান্য পশ্চিমী দেশের নানান লিখন-কর্মশালায় কিছু সময় কাটিয়েছেন। পাশ্চাত্যের সাহিত্য বা লেখালিখি ভারতের সাহিত্য বা লেখালিখির থেকে আলাদা কী হিসেবে? যে-সমস্ত ভারতীয় লেখক আসলে প্রবাসী এবং এই সময় দাঁড়িয়ে ‘তৃণমূল স্তরের’ ভারতীয় জীবন ও সংস্কৃতি কীরকম সেই ধারণার সঙ্গে সম্ভবত ‘সংযোগহীন’ – তাঁদের সংখ্যা কি আগের তুলনায় বাড়ছে?
যেখানেই লেখা হোক না কেন, সাহিত্য যে অনুভূতি প্রকাশ করে, তা খুব একটা আলাদা নয়। পার্থক্যটা দেখা যায় জীবনদর্শনের ক্ষেত্রে আর কিছু কিছু নির্মাণের নিরিখে, যেগুলি কিছু সুনির্দিষ্ট ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। এমনকি এখানেও আমি কোনোরকম সাধারণীকরণ করতে চাইছি না কেননা ব্যক্তিগত তফাতও এক্ষেত্রে অনেক বড়ো একটা ভূমিকা পালন করে। ওয়েলশ্ কবিদের দেখুন – টিম মরিস নিয়ে আসবেন লোকসঙ্গীতের ঘরানা; ছন্দোবদ্ধ কিংবা মুক্ত কবিতায় মেনা এলফিন বলবেন সমকালীন অভিজ্ঞতার কথা; ইউরিগ স্যালিসবারি আবার সমকালের কথা লিখতে গিয়েও কাঠামো হিসেবে বেছে নেবেন ঐতিহ্যবাহী ও ধ্রুপদী ‘সিনহানেড’ শৈলীকে। শুধু ওয়েলশ্ কবিতাই নয়, আমি বহু সুইডিশ কবিতারও অনুবাদ করেছি, তাও আবার কবিদের সঙ্গে ব’সে। সুইডিশ কবিতায় প্রকৃতি একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেয়।
ইউরোপের সংখ্যালঘু ভাষা ও সাহিত্য, যেমন আইরিশ, ওয়েলশ্, বাস্ক প্রভৃতি সম্পর্কে ভারতে কি কোনও সচেতনতা আছে ব’লে আপনার মনে হয়?
আমি অন্তত ওয়েলশ্ সাহিত্য সম্পর্কে তুলনায় কিছুটা বেশি জানি ব’লে বলছি, এই বিষয়ে আমাদের সচেতনতা একেবারেই পর্যাপ্ত নয়। আয়ারল্যান্ড ভারতের কাছে বেশি পরিচিত মূলত সেখানকার ইংরেজ লেখকদের কারণে, কেননা বার্নার্ড শ’ থেকে ডব্লিউ বি ইয়েটস্ হ’য়ে লেডি গ্রেগোরি, সিন ও’ কেসি এবং অবশ্যই জেমস্ জয়েস – এঁরা সকলেই এ-দেশে ইংরাজি পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত। বাস্ক সম্পর্কে অবগতি যৎসামান্যই।
ভারতে কি লেখকেরা উপযুক্ত সরকারি সাহায্য পান?
লেখকেরা এখানে কোনও সহায়তা পান না বললেই চলে। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের অভিযোগ করাও উচিত হবে না কারণ উন্নয়নের সমস্ত দাবিদাওয়া সত্ত্বেও ভারত আজও একটি গরিব দেশ যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রোজকার দিন গুজরানটুকু করতে গিয়েই হিমসিম খান। সাহিত্য অকাদেমি, এক দশকেরও বেশি সময় আমি যে সংস্থার সম্পাদক ছিলাম, বহু ছোট ছোট অস্বীকৃত ভাষাকে উৎসাহদানের পাশাপাশি প্রতিবছর ২৪টি ভাষার শ্রেষ্ঠ বই এবং শ্রেষ্ঠ অনুবাদের কাজকে পুরস্কৃত করে। তাছাড়াও এই সংস্থাটি বিভিন্ন ধ্রুপদী সাহিত্যের ভাষান্তর, নানান বইকে পুরস্কারপ্রদান, নতুন লেখার সংকলনপ্রকাশ প্রভৃতি কাজের সাথে সাথেই প্রতিবছর প্রতিটি ভাষার একজন ক’রে তরুণ লেখকের প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ ক’রে থাকে। এই প্রতিষ্ঠান বহু আলোচনাসভা, কর্মশালা ও পাঠচক্র আয়োজনের সঙ্গেও যুক্ত। কিন্তু, একটিমাত্র সংগঠনের পক্ষে শত শত মাতৃভাষা-সমন্বিত এই বিশাল দেশের সামগ্রিক চাহিদার সাথে যুঝে ওঠা নিতান্তই অসম্ভব।
‘দ্য ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস্’-ও মাঝেমধ্যে লেখক বিনিময় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। অসংখ্য বেসরকারি সাহিত্য সংস্থার পাশাপাশি বহু রাজ্যেই বহু সরকারি অকাদেমিও আছে, যেগুলি পুরস্কারপ্রদান এবং লেখক সম্মেলন আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত। মালয়ালম, যে ভাষায় আমি লিখি, তা এই নিরিখে ভীষণই সমৃদ্ধ – তার বড়ো বড়ো প্রকাশনা সংস্থা আছে, পাঠকসংখ্যা তথা প্রকাশনার পরিমাণও বিপুল। কিন্তু সব ভাষার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা এক নয়।
সেইসব লেখক, যাঁরা বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়ে কোনও একটি শক্তিশালী ‘রাজনৈতিক’ অবস্থান গ্রহণ করেন, তাঁদের সম্পর্কে কি ভারতীয় পাঠকগোষ্ঠীর মধ্যে এখনও কোনও বিশেষ সম্ভ্রম কাজ করে?
স্থান-কাল-পাত্রের উপর নির্ভর করছে। বাংলার মহাশ্বেতা দেবীর মতো পরম শ্রদ্ধেয় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কিছু লেখক রয়েছেন যাঁরা মানুষের দুঃখদুর্দশার কথা ব’লে গিয়েছেন নিরন্তর। আমিও বিভিন্ন বিষয়ে আমার মতো ক’রে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এসেছি।
কিন্তু এমন লেখকের সংখ্যা নেহাতই হাতে-গোনা। দলিত, নারীবাদী কিংবা সমকামী সাহিত্য-আন্দোলনের একটা নিজস্ব রাজনীতি আছে যা চিরাচরিত শ্রেণীসংগ্রামের ধারণাকে ছাপিয়ে যায়। ভারতীয় ইংরাজি সাহিত্যের মধ্যেও অনেক লেখাই রাজনৈতিক, উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অমিতাভ ঘোষের কথা যিনি সাম্রাজ্যবাদের বিবর্তনকে ধরার চেষ্টা করছেন, কিংবা গীতা হরিহরনের নাম যাঁর একটা তীব্র অসাম্প্রদায়িক অবস্থান আছে। সলমন রুশদিও ইদানীং সাম্প্রতিক ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন।
কবিতা লেখার কোন্ বিষয়টা আপনাকে আনন্দ দেয়?
আমার কাছে কবিতা হ’ল পরিপূর্ণ অভিব্যক্তির মাধ্যম। তা আমাকে আমার নিতান্ত মানবিক ভাবনাচিন্তাগুলি প্রকাশের সময়েও ভাষা নিয়ে খেলা করার একটা সুযোগ দেয়। প্রকাশনা, স্বীকৃতি, পার্থিব পুরস্কার – এইসব পরবর্তী ফলশ্রুতির থেকেও লিখনপ্রক্রিয়াটি নিজে আমায় অনেক বেশি আনন্দ দেয়। এটা আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী, এমনকি আমি যখন লিখছি না তখনও তা আমার সঙ্গে থাকে। আমি যে কেবল কবিতা লিখি তা-ই নয়, কবিতা অনুবাদ ক’রি, একটি কবিতা-পত্রিকার সম্পাদনা ক’রি, অজস্র কবি ও কবিতা প্রসঙ্গেও নানান কিছু লিখতে থাকি।
আপনি অডেন আর স্পেন্ডারের মতো ইংরেজ কবি এবং ইয়েটস্-এর মতো আইরিশ কবিকে মালয়ালমে ভাষান্তরিত করেছেন। আপনার বিচারে এমন কোনও ইংরেজ কবি আছেন, যাঁকে বা যাঁদের পুরোপুরি ঠিকঠাকভাবে মালয়ালমে অনুবাদ করা যায় না?
আমার অভিজ্ঞতা বলে যে ভারতীয় কবিরা, যাঁরা অন্যান্য ভাষায় লিখছেন, তাঁদের পর অন্যান্য এশীয় কবি, এবং আফ্রিকান, ল্যাটিন আমেরিকান আর কিছু কিছু ইউরোপীয় কবিতাকে মালয়ালমে ভালোভাবে অনুবাদ করা যায়।
বিষয়বস্তু ও গঠনের নিরিখে এইসব কবিতা আমাদের কবিতাগুলির সাথে অনেকাংশেই একরকম। ইংরেজ কবিরা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি স্বতন্ত্র। তাই আমি খুব কম ইংরেজ কবিদেরই অনুবাদ করেছি। এমনকি টি এস্ এলিয়টের অনুবাদও যথেষ্ট কঠিন যদিও এক অগ্রজ কবি ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’-এর একটি ভাষান্তর করেছেন। এইসব ক্ষেত্রে প্রথমেই ছন্দটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া, দ্রাবিড়ীয় ভাষা হিসেবে মালয়ালমের শব্দসংস্থাপনগত নির্মাণকৌশলও আলাদা।
আপনার আগামী কাজগুলির ব্যাপারে একটু বলবেন?
আমার মাথায় দু’টো দীর্ঘ কবিতা ঘুরছে – একটা আত্মজীবনীমূলক, আমার শৈশব নিয়ে – যার কিছুটা আমি বছরকয়েক আগে লিখেছিলাম। দ্বিতীয়টা একটি কবিতাগুচ্ছ, যার ভিত্তি হ’ল সুমহান ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতের কিছু চরিত্র ও সংশ্লিষ্ট কিছু ঘটনা। এর সঙ্গে মানুষের সমকালীন পরিস্থিতির একটা যোগসূত্র থাকবে। ভারতে স্বাধীনতা-পরবর্তী কবিতার ধারা নিয়ে ইংরাজিতে একটি বই লেখার পরিকল্পনাও আছে।
আপনার লিখনপদ্ধতিটি কীরকম? আপনার লেখা কি সহজে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আসে, নাকি আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ’রে কবিতার সম্পাদনা করেন?
কিছু কিছু কবিতা আমি একটানা লিখেছি, পুনর্বীক্ষণের কাজ লেখাগুলো চলতে চলতেই হয়েছে, আর বাকি যেগুলি নিয়ে আমি পরবর্তীতে বহুবার কাটাছেঁড়া করেছি সেগুলির ব্যাপারে এখনও আমি পুরোপুরি খুশি ন’ই। বেশিরভাগক্ষেত্রেই, বিশেষত যদি ছোট কবিতা হয়, তবে সেগুলি আমি একটানাই লিখি আর সংশোধনের কাজটাও লেখার সময়েই একইসাথে হ’য়ে যায়, তারপর আমি সেগুলিকে আরও একবার বা দু’বার ক’রে লিখি, যেখানে কখনও কখনও ছোট-বড় কিছু পরিবর্তন হয়।
আপনার কবিতা অন্যান্য বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এটা কি আপনাকে তৃপ্তি দেয়? এই অনুবাদপ্রক্রিয়ায় কি আপনার লেখা নতুন জীবনের স্বাদ পায়? অনুবাদ জিনিসটা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
অনুবাদকে আমি দেখি সেইসব মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার বাহন হিসেবে যাঁদের কাছে এছাড়া আমার কবিতা পড়ার অন্য কোনও সুযোগ ছিল না। অবশ্যই এই প্রক্রিয়ায় ভাষান্তরজনিত ক্ষয়ের একটা সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু তার পাশাপাশি অন্য একটি ভাষার রক্তমাংসে নতুন ক’রে বেঁচে ওঠার প্রাপ্তিও তো আছে, ভারতীয় অনুষঙ্গে যা একপ্রকার ‘পুনর্জন্মেরই’ সমান। বহুদিন হ’ল বহু উৎসবে, বিশ্বের নানান প্রান্তে আয়োজিত একক পাঠের নানান অনুষ্ঠানে আমি নিজের কবিতা, নিজের লেখা প’ড়ে আসছি অনুবাদসহ, সাধারণত কোনও অনুবাদক কিংবা পেশাদার বাচিকশিল্পী বা অভিনেতার সাহায্য নিয়ে। কবিতা যে এক সর্বজনীন ভাষা – ব্যাবেল-পূর্ববর্তী মানবজাতির অভিন্ন মাতৃভাষা কবিতাই – এইসব অভিজ্ঞতা আমার এই বিশ্বাসটিকে দিনে দিনে দৃঢ় করেছে। সাংস্কৃতিক অনুসন্ধান ও বিনিময়ের পথ হিসেবে, সদৃশতার খোঁজ হিসেবে, এমনকি কোনও একটি সংখ্যালঘু ভাষা বা স্বল্পপরিচিত সংস্কৃতির ক্ষমতায়নের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেও অনুবাদের গুরুত্ব অপরিসীম।
আধুনিক সমাজে কবিতার ভূমিকা কী?
কবিতা তার পাঠককে সংবেদনশীল করে। পতিত জমিকে ওলটপালট ক’রে তা আমাদের সেই জিনিস দেখায় যা হয়তো আমরা এমনিতে দেখতাম না, সেই জিনিস শোনায় যা হয়তো আমরা শুনতাম না এমনিতে। কবিতা আমাদের উপলব্ধিকে সতেজ ক’রে তোলে আর ভাষাকে জোগায় সঞ্জীবন। ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিনির্ভরতা তথা বস্তুবাদে আচ্ছন্ন সমাজকে তার হারিয়ে-ফেলা মুগ্ধতার যাদুস্পর্শ দেয় কবিতা।
আমার নিজের যেহেতু ছোট-ছোট কয়েকটি সন্তান আছে – যাদের মধ্যে একজন অটিজম-আক্রান্ত – সেই জায়গা থেকে পলাশের জন্য লেখা আপনার কবিতাটি ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশেষ প্রিয়। জনৈক বিখ্যাত আইরিশ জাতীয়তাবাদী লেখক – পাদ্রেইগ পিয়ার্স – ঘটনাচক্রে যাঁর উপর আবার ভারতীয় লেখকদের একটা বড়ো প্রভাব ছিল – বলেছিলেন যে একজন কবি বা শিল্পী যখন পৃথিবীটাকে শিশুর চোখ দিয়ে দেখতে পারেন, তখনই সেই মহত্তম সৃজনশীলতার জন্ম হয়। আপনি কি কবিতার বিষয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত?
আমি নিজেও প্রায়ই শিশুর চোখ দিয়ে দুনিয়াটাকে দেখতে চেষ্টা ক’রি যাতে এই চিরচেনা পৃথিবীটাকেও সময়-সময় অচেনা আর বিস্ময়বহুল মনে হয়। সম্প্রতি আমি ছোটদের জন্য লেখা শুরুও করেছি, তবে তাছাড়াও ভিতরের শিশুটাকে আমি কখনই হারিয়ে যেতে দিই না। হ্যাঁ, নিশ্চিত, একজন কবির জন্য তাঁর মধ্যেকার শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখা একান্ত প্রয়োজনীয়। আমি আমার দুই মেয়েকে নিয়ে কিংবা তাদের জন্যেও অনেক কবিতা লিখেছি। এই কবিতাটিও আমার এক কবি-বন্ধুর ছেলের জন্য লেখা, যে কী-না বড়ো হ’য়ে এখন নিজেই একজন লেখক!
অন্যান্য ভারতীয় (সংখ্যালঘু) ভাষার (কিংবা মালয়ালমেরই) কয়েকজন কবি বা লেখকের কথা বলুন যাঁদের ব্যাপারে আয়ারল্যান্ডে ব’সে আমাদের আরও বেশি ক’রে জানা উচিত।
আমার ভাষায় তো বটেই, অন্যান্য সমস্ত ভাষাতেই এমন বহু লেখক বা কবি আছেন। চলুন না, আইরিশে মালয়ালি কবিতার সংকলন নিয়ে একটা কাজ করা যাক! অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের জন্য আমি ইংরাজিতে একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করছি; প্রাথমিক উপাদান হিসেবে সেটাকেই ব্যবহার করা যেতে পারে। তারপরে না-হয় আমরা সমকালীন ভারতীয় কবিতার একটা সংকলন প্রকাশের কথা ভাবব – ইতিমধ্যেই আমি ইংরাজিতে এরকম একটা কাজ করেছি, একশোজন আধুনিক ভারতীয় কবির কবিতাসংকলন – ‘সিগনেচার্স’ শিরোনামে, বেরিয়েছে ‘ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট অফ্ ইন্ডিয়া’ থেকে।
কবিতা কী?
সারাটি জীবন ধ’রে আমি এইটাই বোঝার চেষ্টা ক’রে যাচ্ছি। এই প্রশ্নের কোনও অন্তিম উত্তর আমার কাছে নেই, কেননা সদাপরিবর্তমান বাস্তবতা ও নিয়ত বিবর্তনশীল জীবনদর্শনকে ধরার তাগিদে কবিতাও পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে ক্রমাগত। এর কোনও সর্বকালীন ও সর্বজনীন সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা না-হয় এখন থাক।
দ্রষ্টব্য । ইংরাজিতে সচ্চিদানন্দনের এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ডঃ মাইকেল ও হাওধা (ইউনিভার্সিটি অফ্ লিমেরিক)। গ্যাব্রিয়েল রোজেনস্টক-কৃত সচ্চিদানন্দনের কবিতার আইরিশ অনুবাদগ্রন্থে এটি প্রকাশিত হয়েছিল।
কে সচ্চিদানন্দনের পাঁচটি কবিতা
ভাষান্তর সোহম চক্রবর্তী
শকুন্তলম্
প্রতি প্রণয়ীকে তাড়া করে অভিশাপ
বিস্মরণের, ক্ষণেকের জন্য হলেও
ভুলে যাওয়া প্রিয় নারীটিকে – স্মৃতিভ্রংশের নদী
যেন গ্রাস করে ভালোবাসা তার।
প্রতি দয়িতাকে তাড়া করে অভিশাপ
মুছে দেয় স্মৃতিপট থেকে, স্মরণের জালে তার গুপ্ত কথাটি
যতখন আটক না হয়।
প্রতিটি শিশুকে তাড়া করে অভিশাপ
পিতৃহীনতায়
বেড়ে উঠবার, হাত রেখে সিংহের মুখে।
আমি
আমার মা বিশ্বাস করেননি
যখন, ১৯৪৫-এ, তাঁর
স্বপ্নের মধ্যে এসে বলেছিলাম আমি
জন্ম নেব পরের বছর।
আমার বাম অঙ্গুষ্ঠের নীচে
তিলটুকু দেখেই
বাবা আমাকে চিনতে পেরেছিলেন।
কিন্তু একদম শেষ পর্যন্ত মা বিশ্বাস ক’রে গেছেন
আমার ছদ্মবেশে
গর্ভে তাঁর জন্ম নিয়েছে অন্য কেউ এক।
বাবা আর আমি তাঁর কাছে সওয়াল করেছি আত্মপক্ষ নিয়ে,
কিন্তু সাক্ষী হিসেবে স্বপ্নেরা তত বিশ্বস্ত নয়।
মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি
প্রতিশ্রুত সন্তানের জন্য অপেক্ষা ক’রে গেছেন।
কেবল যখন আমার মেয়ের শরীরে তাঁর পুনর্জন্ম হ’ল
তখন তিনি মেনে নিলেন আসলে ওটি আমিই ছিলাম।
কিন্তু ততদিনে সন্দিহান হ’য়ে উঠেছি আমি –
হয়তো-বা অন্য কারো হৃদয়
ধকধক করছে আমার এই দেহের ভিতর।
একদিন আমার হৃদয় পুনরুদ্ধার করব আমি;
আমার ভাষাও।
ঠাকুমা
আমার ঠাকুমা ছিলেন বদ্ধ উন্মাদ।
তাঁর পাগলামো যখন মৃত্যুতে পরিণতি পেল,
আমার কৃপণ কাকা
তখন তাঁকে আমাদের ভাঁড়ারঘরে
খড়ের গাদায় মুড়ে রেখে দিলেন।
শুকোতে শুকোতে একদিন ফেটে পড়লেন আমার ঠাকুমা;
কণা কণা বীজগুলি তাঁর উড়ে গেল জানলা দিয়ে।
রোদ উঠল, বৃষ্টিও হ’ল তারপর;
একখানি চারা বড়ো হ’তে হ’তে মহীরুহ হ’ল,
তার কামনায় আমি বিদ্ধ হলাম।
সোনার দাঁতের বাঁদরদের নিয়ে
আমি কি কবিতা আর না-লিখে পারি?
কাঁটাগাছ
কাঁটা আমার ভাষা।
রক্তাক্ত স্পর্শ দিয়ে আমি
অস্তিত্বের ঘোষণা ক’রে থাকি।
একদিন এইসব কাঁটা ফুল হ’য়ে ছিল।
প্রতারক প্রেমিকদের আমি ঘৃণা ক’রি।
বাগানে ফেরার জন্য কবিরা
মরুভূমিকে বর্জন করেছেন।
সেখানে শুধু উট, এবং বণিক,
পায়ে-পায়ে আমার ফুলগুলি যারা শুধু ধুলো ক’রে যায়।
প্রতিটি বিরল জলকণার জন্য একটি-একটি কাঁটা।
প্রজাপতিদের আমি প্রলুব্ধ ক’রি না,
কোনও পাখি গেয়ে বেড়ায় না আমার স্তবগান।
খরার জন্য আমি দায়ী ন’ই।
জ্যোৎস্না পেরিয়ে এসে
অন্য এক সৌন্দর্য রচনা ক’রি আমি,
স্বপ্নের এই পাশটিতে
তীক্ষ্ণ, শাণিত এক
ভাষা – সমান্তরাল।
কবিতা আসবে
আমাদের চাল চাই, নুন চাই,
চাই লঙ্কা আর জ্বালানির কাঠ;
কবিতা ছাড়াও আমাদের চ’লে যাবে।
তবুও কবিতা আসবে ফিরে
চালের মতন,
পৃথিবীর বীজ,
সিদ্ধ ক’রে, শস্যশীষ ঝেড়ে-বেছে, আর
সমস্ত খামার, গোলা, মরাইয়ের
সমস্ত মাপ উপচে উপচে উঠে;
নুনের মতন,
সমুদ্রের স্মৃতি,
আমাদের মুখের লালায়,
বেদনায় পুড়িয়ে আমাদের,
ক্ষতদাগে শুশ্রূষা দিতে,
শিকড়ে শিকড়ে দিয়ে যেতে পুষ্টির রস;
লঙ্কার মতন,
মাটির কামনা,
উষ্ণ ক’রে তোলে আমাদের ঠোঁট, জিভ,
স্তন, নীবি, শিরা ও স্নায়ুজাল;
জ্বালানিকাঠের মতন,
অরণ্যের অস্থি,
গলিত মজ্জা তার,
আস্তে-আস্তে পোড়ে অল্প আঁচে, আর
এক নিঃশ্বাসে, ব’লে চলে শুধু
চাল নুন লঙ্কা জ্বালানিকাঠ ও কবিতা।
Leave a reply