লিখতে লিখতে কখনও কি অহংকার ভর করে মনে? মনে হয়, যা লিখব তাই-ই প্রকাশযোগ্য? জমতে থাকা লেখাদের দিকে তাকাই। অসাড় নাড়িতে আঙুল রেখে খুঁজতে চাই প্রাণ। ডিফেন্স। সত্যিই কি অত খারাপ লিখছি? বিরুদ্ধ যুক্তি, মনে-মনে। পাঠকের আসনে বসাই নিজেকে। অথচ, লেখার মুহূর্তটুকু বিচ্ছিন্ন হয় না কিছুতেই। সেইসব চিন্তা-অনুভূতি চেপে ধরে, বলে, স্বীকৃতি দাও। লেখা ছাড়া আর কোথাওই থাকার জায়গা নেই আমাদের। সামান্যই তো স্বীকৃতি। সেটুকু দিতেও কুণ্ঠা কেন এত?
একজন কবিতাপ্রয়াসীর সবচেয়ে কঠিন কাজ বোধহয় নিজের লেখার প্রতি নিষ্ঠুর হওয়া। সন্দেহমাত্র হয় পরিমার্জন, নয়তো বাতিল করে দেওয়া। তার তা না পারলে? জমতে থাকে। প্রকাশ নিয়ে দ্বিধা। কিন্তু কেন? যদি লেখা হিসেবে স্বীকৃতিই দিই(বা না দিই), বাইরে আনতে সংশয় কেন? আমি কি ইমেজ-সচেতন হয়ে পড়ছি? ‘আমার লেখা’ হিসেবে প্রকাশ্যে এলে লোকে মুখ টিপে হাসবে – এমন ভাবনা কাজ করছে মনে? ‘লোকে কী ভাববে’ – শুধুমাত্র এই ভাবনাতেই বন্দি করে রাখছি লেখাদের? নাকি নিজেও জানি, বলার মতো কিছুই হয়নি এ-লেখা?
বলার মতো? কার কাছে? চোখ বন্ধ করি। ভেসে ওঠে দুটো-চারটে মুখ। দশ-বারোটা। ধীরে ধীরে খান পঁচিশেক। এই পঁচিশজনকেই আমি ভয় পাচ্ছি? এরা না থাকলেই সেই লেখা প্রকাশ্যে আনতে বাধা নেই কোনো? কারা এই পঁচিশজন? ধারাবাহিক লেখা পড়ে বলে দুর্বলতা ধরে ফেলবে? মুখে কিছু না বললেও, মনে-মনে করুণার পাত্র হয়ে যাব তাদের কাছে? এতকিছু ভাবি আমি? লেখা প্রকাশ্যে আনা নিয়ে? এতকিছু!
আর পঁচিশের বাইরে যারা? তাদের কি গুরুত্ব দিচ্ছি না? পাঠক হিসেবে স্বীকারই করছি না? লজ্জিতও হচ্ছি না বিন্দুমাত্র?
লুকিয়ে-থাকা লেখারা এতকিছু জানে না। তারা উত্তর চায়। লিখলে কেন? লিখলেই যখন, লুকিয়ে রাখা কেন? প্রকাশ্যে যা, তার চেয়ে অনেক বেশি আড়ালে — এই অসাম্য কাটছে না কেন কিছুতেই? জবাব দিই, তোমরা অনুশীলনের ফসল। দুটো স্টেশনের মধ্যেকার সিগন্যাল পোস্ট। থমকে, থেমে, তারপর পরবর্তী গন্তব্যে যাওয়া। মাঝের থামাগুলো মনে রাখে না কেউই।
ধেয়ে আসে পরের প্রশ্ন – তুমি কার নিরিখে বিচার করছ, দুর্বল না সবল? কোনো দুর্বল লেখাও সঙ্গেও কেউ সংযোগ স্থাপন করতে পারে, আবার কোনো সবল লেখাও হয়তো কাউকেই প্রভাবিত করল না। অপূর্ব নির্মাণ হয়েই থেকে গেল। তাহলে?
— প্রাথমিকভাবে, আমার নিরিখেই। নিজেকে নিয়ে যা ধারণা, তার সাপেক্ষে বিচার। হল, নাকি হল না।
— কবিতা কি হওয়ার? এই ‘হওয়া’ মানে কী?
— নিজের যে লেখা নিজেরই ভালো লাগে, এবং পাঠকেরও, তাকেই মাপকাঠি ধরি। সেই স্তরে না পৌঁছলে কেন প্রকাশ্যে আনব? কবিতার হওয়া, হয়ে ওঠা কী, তা জানি না। সবাই বলে, তাই বলি। কীসে যে হয়, আর কীভাবে, সেটা প্রত্যেক পাঠকের কাছে আলাদা।
— তোমার বিচার নির্ভুল? এমনও তো হতে পারে, যে লেখা দুর্বল ভেবে অবহেলায় সরিয়ে রাখলে, সেটাই হয়তো অনেকের ভালো লাগত। সেই পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাবে না? তুমি কি ঝুঁকিই নিতে চাও না? সুরক্ষিত একটা ইমেজের মধ্যে বন্দি থাকতে চাও?
— তা নয়। আসলে…
কথা হারিয়ে ফেলি। এর উত্তর কী দেব! কীসের নিরিখে যে বিচার-পরিমার্জন চলে মাথার মধ্যে, তার কোনো স্পষ্ট হদিশ তো নেই। বরং, নিজে প্রাথমিক সমালোচক হয়ে থাকলে, বাইরের সমালোচনাও নেওয়া যায় সহজে। ভুল বললাম। সহজে নয়। কেউ যদি বলে ‘তুমি কবিতা লিখতে পারো না’, খারাপ লাগে। লাগা স্বাভাবিকও। কিন্তু তা শুনে ছেড়ে যাওয়া নয়, বরং আরও-আরও চেষ্টা, যাতে পারি লিখতে।
ওই একটি-দুটি মানুষের কথা শুনে মেনে নেব, লিখতে পারি না? এর উত্তরে ফিরতি প্রশ্ন জাগে – ‘লিখতে পারো, এ-কথাই বা বলল কে?’ ‘কেন? অনেকেই তো…!’ ‘তোমার সত্যিই মনে হয়, পারো? পারলেও, তারপর? কোথাও থেকে যায় সেইসব লেখা?’
আবার বিপদ। মনে ভেসে ওঠে সমসাময়িকদের লেখা। অনুজ-অগ্রজদের। বন্ধুদের। কুণ্ঠায় গুটিয়ে ফেলি নিজেকে। কী লিখছি— লিখেছি এসব? অন্যদের লেখা পড়ে ঈর্ষা জাগে। কেন পারি না অমন? ওই-ওই লেখাটা লিখতে পারলে হয়তো খেদ থাকত না। পারি না বলেই আমি ওরা নই। হতেও পারব না কোনোদিন। পারব না যখন, ভাবছি কেন এত? নিজের ব্যর্থতা-সীমাবদ্ধতা জেনেই কেন লিখব না? কেউ তো মানা করছে না!
এখানেই আরেক দ্বন্দ্ব। লিখব। লিখব তো বটেই! জীবনের দিকে তাকালে, লেখালিখি ছাড়া আর সবকিছুই যখন ব্যর্থ মনে হয়, কবিতা নামক ‘আলেয়া’টিকে নিয়ে অহং না থাকলে বাঁচব কী করে! সব খুইয়ে নিঃস্ব হতে নেই। বরং নকল বুঁদির গড়ের মতো এই কবিতাই থাকুক, আমাকে ভুল-বোঝানোর বন্ধু হয়ে। বলুক, আমি পারি। নেশায় আচ্ছন্ন করে রাখুক আমায়। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিক প্রতিমুহূর্তে, যাতে তাকেও চমকে দিতে পারি পরের লেখায়। লিখব। লিখতে তো মানা নেই কোনো!
কিন্তু প্রকাশ্যে আনা? সেখানে জুড়ে যায় বাইরের পাঁচজনও। মনের মধ্যে বিচার-সংশয়-সন্দেহ না থাকলে চিন্তা ছিল না। কিন্তু সেসব যখন আছে এবং প্রবলভাবেই আছে, লেখা এবং লুকিয়ে রাখা – এর ফাঁদ গলে বেরোতে পারে খুব কমজনই। লুকিয়ে রাখার মধ্যেও একটা নেশা আছে। সঞ্চয়ীর জমানোর স্বভাব। কিংবা ‘নেহাত প্রকাশ্যে আনছি না বলে বাকিরা জানতেও পারল না’ ভেবে গর্ব অনুভব করা। ত্যাগীর ভেক যেন বা। এও এক মনোবিকৃতি। তাহলে এতক্ষণের দুর্বলতার কথা, চিন্তা কি মিথ্যে? লুকিয়ে রাখার কারণ সেটা নয়? শুধু এবং শুধুমাত্র আত্মপ্রসাদ লাভের জন্যেই?
গত কয়েকদিনে, একটি বিশেষ কাজের জন্য বই-পত্রপত্রিকা মিলিয়ে প্রায় দু-তিন লাখ কবিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। দশকের পর দশক জুড়ে জন্ম নেওয়া সেসব লেখা, অজস্র কবির। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, কত কবিতা সেই পাতার বাইরে বেরোতেই পারল না আর। কত কবিতা চমকে দিল, অথচ কয়েক দশক পেরিয়েও তা যথেষ্ট পাঠকের সমাদর পেল না। বইয়ের একটি কবিতা হয়েই থেকে গেল। তাই হয়তো হওয়ার ছিল। হয়ও। সময়ের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একটি কবিতার অমরত্বের জন্য শহিদ হতে হয় সঙ্গী হাজার কবিতাকে।
তবু থামা চলে না। লিখে যেতেই হয়। নিজের জন্য। কখনও প্রকাশ্যেও আসে সেসব লেখা। হয়তো আলাদা করে চোখে পড়ে না। হয়তো পড়ে। দু-তিন লাখ কবিতা পড়তে পড়তে, আমি কি মনে-মনে কবিদের করুণা করছিলাম? নাকি ভয় পাচ্ছিলাম, আমার সঙ্গেও এমন হবে একদিন? অনেক-অনেক লেখা ওল্টাতে ওল্টাতে ভবিষ্যতের কেউ বলে উঠবে – ‘ধুস! ফালতুই লিখে রেখেছে এসব। থাকুক গে বইবন্দি হয়ে।’
নিজের লেখা নিয়ে কুণ্ঠিত হতে নেই? যা লিখেছি, প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পাঠকের সামনে পেশ করাই উচিত? অনেকেই পারেন। তাঁদের সেই পারা-কে ঈর্ষা করি। লেখা হিসেবে কেমন, মনে-মনে তার বিচার তো চলেই, সেইসঙ্গে অবাকও হই, তিনি এই লেখা প্রকাশ্যে আনতে পারলেন। আমি হলে পারতাম না। কিন্তু বিচার কেন করি? কেন তন্নতন্ন করে কাটাছেঁড়া করি প্রতিটা প্রয়োগ? আমি কি সৎ পাঠক হতে পারছি?
পাঠকের পাশাপাশি আমি থেকে যাচ্ছি শিক্ষার্থী হয়েও। দেখতে চাইছি, সেই কবিতার থেকে কিছু শিখতে পারি কিনা। জমিয়ে নিতে পারি কিনা অবচেতনে। যদি না পারি? তাহলেও ক্ষতি নেই। কখনো-কখনো নিজের ভেতরকার পাঠককেও জায়গা করে দিতে হয়। পড়া এবং মুগ্ধ হওয়া – এই প্রাথমিক ধাপ পেরিয়ে তবে শিক্ষার্থীর প্রবেশ। আর যদি কোনো কবিতা ভালো না লাগে? মনে-মনে দুর্বল ভাবি সেই কবিকে? বিচার করে বসি একটামাত্র কবিতা দিয়েই?
প্রশ্নের শেষ নেই। শেষ নেই উত্তরেরও। এত জটিলতা কোনো কবির থাকতে নেই। থাকলে, তার মন জটিলতাতেই ঘুরপাক খায়। সেসব পেরিয়ে মূল আনন্দে পৌঁছতে পারে না কিছুতেই। পড়া আর লেখার বাইরে আর কোনো চিন্তা যদি চেপে বসে, দিনে-দিনে মুখ্য হয়ে ওঠে সেসব। ‘লোকে কী বলবে’ আর ‘আমি কী বলছি’ – এই ইমেজ-আবর্ত পেরনো যায় না আর। যা ছিল একসময়ের আশ্রয়, সেই কবিতাই হারিয়ে যায় কোথাও।
আমি কবি নই। ব্যাকেটে, ‘প্রমাণিত’। ছোটোবেলায় কষা অঙ্কের সমীকরণ যেন। জটিল ধাপ পেরিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো। আমি কবি নই। হতে পারবও না কোনোদিন। ব্যাস। শেষ।
21.06.21
Leave a reply