‘গীতবিতান’ সেই মহাগ্রন্থ যার যে কোনও অংশ থেকে পাঠ শুরু করা যায় ও চলে যাওয়া যায় যে কোনও অংশে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, ‘গীতবিতান’-এর এক একটি গানের সঙ্গে আমাদের অদৃশ্য সংযোগ তৈরি হয়েই থাকে; তারা অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করতেই থাকে সংযোগ-মুহূর্তটি চিনিয়ে দেবার জন্য। আসলে অপেক্ষাটি দু’পক্ষেরই, পাঠক ও ‘গীতবিতান’-এর এক একটি গানের।এখানে ‘পাঠ’ শব্দটির দিকে মৃদু নজর দেওয়া প্রয়োজন; কারণ আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের গানের পাঠ তার গীত-হওয়া রূপের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই গানগুলি পাঠ করবার সময় আমি ধীরে ধীরে তার গা থেকে খুলে ফেলতে থাকি সুরের ধারাপাত; সে ধারাপাত নিশ্চিত ভাবে অসামান্য। কিন্তু এ আমার ব্যক্তিগত সন্ত্রাস বা প্রক্রিয়া। সব সময় যে সেটি সার্থক ভাবে করে ওঠা সম্ভব হয় তাও নয়; কারণ দিনের পর দিন যে সুর স্নায়ুর মধ্যে প্রবেশ করেছে তাকে হয়তো সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা যায় না, তবু এটিই আমার প্রক্রিয়া।
যে অপেক্ষার কথা হচ্ছিল – রবীন্দ্রনাথের কোনও একটি গানের দ্বারা আক্রান্ত হবার এক বিশেষ মুহূর্ত আছে। সেই গূঢ় সংযোগের মুহুর্তে আবিষ্কার করা যায়, আপনি গানটির দ্বারা আক্রান্ত হলেন। তারপর আপনি বহুবার সে গানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাবেন, বর্ষার মাঠের মতো সে গানের বুকের উপর শুয়ে থাকবেন, অনন্ত হাহাকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত ভাবে আবিষ্কার করবেন একটি হাত আপনার দিকে এগিয়ে আসছে…আপনার হাত ধরে সে নিয়ে যাচ্ছে আলো অথবা ‘পবিত্র’ অন্ধকারের দিকে; কিন্তু গানটির সঙ্গে আপনার সংযোগ স্থাপিত হবার মুহুর্তটি নির্দিষ্ট। সে দরজা খোলার সময় না-এলে খুলবে না, অপেক্ষা করে যেতে হবে শুধু। এ যেন মহাকাশের ওপার থেকে…হাজার হাজার গ্যলাক্সির ওপার থেকে ভেসে আসা রহস্যজনক সংকেত, আর পাঠকের ভূমিকা সেখানে বনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা, আকাশের দিকে মুখ তুলে রাখা এক মানমন্দিরের। সংকেতটিকে ধারণ করবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা ভীষণ জরুরি।
এক আষাঢ়-সন্ধ্যায় তাঁর একটি গানের পাঠিয়ে রাখা সংকেত এমন ভাবেই ঢুকে গিয়েছিল আমার মধ্যে। বুঝতে পেরেছিলাম এক ইঙ্গিত প্রবেশ করছে আমার ভিতর…এর থেকে বেশি হয়তো আর কিছুই নয়। কোনও দিনই হয়তো তার রহস্য আর গভীরতার তল পুরোপুরি পাওয়া সম্ভব হবে না, বারবার শুশুকের মতো ঘাই মেরে সে তার আভাসটুকু দিয়ে যাবে। তবে এটিও মনে রাখা ভাল, গানটির সঙ্গে সন্ধ্যার অনুসঙ্গ যুক্ত হয়ে আছে বলেই যে সেটি আষাঢ়-সন্ধ্যায় তার সংযোগ স্থাপন করল, বিষয়টি এমনও নয়। এই ঘটনাটি ঘটতে পারত কোনও হেমন্তের রাত্রে বা গ্রীষ্মের দুপুরেও; কিন্তু সেটি ঘটল সেই সন্ধ্যায়।
রবীন্দ্রনাথের সে গানটি তুলে ধরা যাক,
‘সন্ধ্যা হল গো—ও মা, সন্ধ্যা হল, বুকে ধরো।
অতল কালো স্নেহের মাঝে ডুবিয়ে আমায় স্নিগ্ধ করো।।
ফিরিয়ে নে মা, ফিরিয়ে নে গো—সব যে কোথায় হারিয়েছে গো
ছড়ানো এই জীবন, তোমার আঁধার-মাঝে হোক-না জড়ো৷৷
আর আমারে বাইরে তোমার কোথাও যেন না যায় দেখা।
তোমার রাতে মিলাক আমার জীবনসাঁজের রশ্মিরেখা।
আমায় ঘিরি আমায় চুমি কেবল তুমি, কেবল তুমি—
আমার ব’লে যা আছে, মা, তোমার ক’রে সকল হরো।।
— এই গানটির কাছে বসে ছিলাম সেদিন অনেকক্ষণ। গানটির দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম রোদসীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা জলভরা চোখের এক প্রাণ’কে, ঈষৎ অভিমানী ঈষৎ দিশাহারা এক প্রাণ।
গানটি শুরু হয়েছে কিছুটা রিভার্স-প্রক্রিয়ায়, দিন শেষে সন্তান তার মা’কে সচকিত করে তুলছে সন্ধ্যা নেমে আসার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে। ‘সন্ধ্যা হল গো’…এই তিনটি শব্দের পর যে স্পেস সেখানে গিয়ে ঘুরে ঘুরে কেঁদে ফিরেছে শব্দ তিনটি…তাদের গা থেকে ঝরে পড়ছে অভিমানের গাঢ় রস।
কিন্তু হঠাৎ আরেকটি কথাও মনে হওয়া স্বাভাবিক; এই সন্তান কি সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছে মাতৃক্রোড়ে ফিরে আসবার বাসনা বুকে নিয়ে? গানটি আসলে শুরু হবার অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে, সারাদিনের জমে থাকা অভিমান ও আকুতি ঝরে পড়ছে সন্ধ্যায়।
কিন্তু এ গানের সব থেকে আশ্চর্য ও ঘাতক অংশ দ্বিতীয় লাইনে লুকিয়ে রয়েছে, সন্তানের সচেতন আকাঙ্খা – এক অতল কালো স্নেহের মধ্যে ডুবে স্নিগ্ধ হবার। ‘স্নেহ’-র বিশেষণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে ‘অতল কালো’। এবং এই দুটি শব্দের ব্যবহারে রবীন্দ্রনাথ আমাদের চোখ ফেরাতে বাধ্য করলেন এক সত্যের দিকে, যে সত্য আমাদের কাছাকাছি অবস্থান করছিল, কিন্তু আমরা সচেতন ভাবে লক্ষ্য করিনি তাকে – অতলের দিকে ক্রমশ কমে যেতে থাকে আলোর তীব্রতা।
যে মাতৃপ্রতিমার জরায়ুর মধ্যে প্রবেশ করতে চেয়ে সন্ধ্যার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে সে প্রাণ, সেই মাতৃপ্রতিমাও অন্ধকারের প্রতিমা। যে জীবন ছড়িয়ে গেছে সে আজ আশ্রয় নিতে চাইছে মাতৃজরায়ুর অন্ধকারে।
এখানেও একটি বিস্ফোরণ ঘটে যায় তলে তলে – তবে কি অন্ধকারের সে মহা-আশ্রয়ের অভাবেই ছড়িয়ে গেছে জীবন? সারাদিন ধূলি-ধূসরিত পায়ে পথে-প্রান্তরে আলোর অতি-প্রকাশ্য জগতে ঘুরতে ঘুরতে কি খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে অস্তিত্ব? সত্তার সেই খণ্ড খণ্ড অংশগুলি কুড়িয়ে পাওয়া যাবে মাতৃ-অন্ধকারে।
ষষ্ঠ লাইনে এসে আরেকটি চিন্তাসূত্রের জন্ম হয় – এতক্ষণ যে প্রাণ’কে মনে হয়েছে দিশাহারা বালক সে আসলে জীবনসাঁজের কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকা এক মানুষ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক দীর্ঘ যাত্রা জরুরি ও আবশ্যক মাতৃ-অন্ধকারে প্রবেশ করবার জন্য। হয়তো এটি একটি আবশ্যিক শর্ত’ও বটে। মাইল মাইল কালাহারি অতিক্রম করার পর সে প্রাণ লীন হয়ে যেতে চাইছে, সে চাইছে এই অন্ধকারের অস্তিত্বটুকু ছাড়া তার আর সব মুছে যাক।
রবীন্দ্রনাথের পৃথিবী সব থেকে বেশি অধিকার করে আছে বৃহতের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক। ব্যক্তির নিঃশর্ত সমর্পণ এবং এই সমর্পণের মধ্য দিয়ে তার ম্যাক্রোর অংশ হয়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে ভরিয়ে রেখেছে। মহাপ্রাণের সামনে ছিন্নপ্রাণের অবস্থান তাঁর অতি-প্রিয় বিষয়। এই দুই-এর মধ্যে যে অদৃশ্য টানেল সেখান দিয়ে ছিন্নপ্রাণ ক্রমশ এগিয়ে যায় মহাপ্রাণের দিকে, ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায় তার ভিতর। ছিন্নপ্রাণের লেশমাত্র থাকে না সেই মিলনের পর।
অনেকগুলি সূত্র বুকে ধরে ছুটে যাচ্ছে এই গান, সে সূত্রের হাত ধরে বহুদূর ভেসে যাওয়া যায়। যে ছিন্নপ্রাণ আজ আশ্রয় চাইছে মাতৃক্রোড়ে, সে যে আগুনের হলকা লেগে পুড়ে যাওয়া এক অস্তিত্ব সে নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু সে কি ভ্রমের বশে একদিন স্বেচ্ছায় দূরে চলে যাওয়ার দোষে দুষ্ট? এই আকুতির মধ্যে কি কোথাও লুকিয়ে রয়েছে সচেতন অশ্রুমোচন এবং অবলুন্ঠিত হবার মধ্য দিয়ে সে কি অশ্রুনদীটিকে পেরিয়ে যেতে চাইছে? না হলে কেনই বা তার আকুতি, ‘ফিরিয়ে নে মা, ফিরিয়ে নে গো’?
এই গানটির মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রগাঢ় অন্তর্দাহ গানটিকে শিবিকায় চাপিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে দূরের এক জগতে, এমনই মনে হয় আমার। বহির্মুখী সব চলাচলের শেষে এক মহা-আশ্রয়ের সন্ধান চলেছে। জন্ম ও জন্মজনিত পাপ-প্রবাহের পাশ্চাত্য sin-সম্ভূত ধারণার উলটো পিঠে অবস্থান করছে এই মাতৃমূর্তি। ইদিপাস গূঢ়ৈষণার একমাত্রিক চলনের ক্ষমতা নেই এই অন্বেষণের সন্ধান পাওয়া। জন্ম-মৃত্যু সৃষ্টি-ধ্বংসের অন্তে সে এক আশ্রয়…এই বিপুলা পৃথিবীতে দিশাহারা প্রাণ খুঁজে চলেছে তাকে।
সন্ধ্যা আরও গভীর হয়ে এল, আষাঢ়ে-মেঘের ফাঁকে জেগে উঠছে একটি-দু’টি তারা। দিনের শেষে এই তো শ্রেষ্ঠ সময় মাতৃক্রোড়ে ফিরে যাবার। (ক্রমশ)
4 comments on “পার্থজিৎ চন্দ”
রিনি গঙ্গোপাধ্যায়
অসম্ভব সুন্দর একটা লেখা। অবশ্যই সুরেলা।
thealoprithibi
সঙ্গে থাকবেন। ধন্যবাদ।
Pankaj Chakraborty
চমৎকার লেখা। অসামান্য লাগল।
thealoprithibi
সঙ্গে থাকবেন। ধন্যবাদ।