চৈত্রের শালবনের মাথার উপর চাঁদ উঠেছিল একদিন, একদিন শালজঙ্গল থেকে ছুটে আসা রোদে-পোড়া লালমাটির গন্ধ হারিয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যা-বাতাসের ভেতর। কিশোর বয়সের সে এক পুরুলিয়া, মাথার উপর ফুটে উঠেছিল হাজার হাজার তারার দল। দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে আজ আর বলা সম্ভব নয় সেটি পূর্ণ, না শূন্যের আদল ধরে রেখেছিল। তবে তার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায়, সেদিন যে দৃশ্যটি মাথার ভেতর, স্নায়ুর ভেতর প্রবেশ করেছিল তা শুধুমাত্র ‘সুন্দর’ ছিল না। আসলে দৃশ্যটি ছিল ‘সুন্দর’-এর প্রথাগত ও সংস্কারের ফলে গড়ে ওঠা ধারণার থেকে বহুদূরে অবস্থান করা রহস্যময় এক দৃশ্য।
কিছু কিছু দৃশ্য এমন হয়, মানুষ তাকে মাথায় ধরে ঘুরতে থাকে দিনের পর দিন; দিনের পর দিন হয়তো সে দৃশ্যের সঙ্গে যোগ করে চলে এক একটি মাত্রা। অনেক অনেক দিন পর ‘দৃশ্য’টি হয়ে ওঠে বিবর্ধিত, ‘প্রকৃত’ এক চিত্র। জীবনের এ পর্বে এসে স্থির বিশ্বাস জন্মেছে, যতদিন-না দেখা দৃশ্যটির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ‘অলীক’ সেই মাত্রাগুলি ততদিন দৃশ্যটি ‘প্রকৃত’ হয়ে ওঠে না। যে কোনও দৃশ্যের প্রকৃত হয়ে ওঠার রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এই অলীক-পদ্ধতির ভেতর।
কিন্তু যে ‘সুন্দর’-এর কথা হচ্ছিল, সে ‘সুন্দর’ আসলে কী? বস্তু’ই কি সুন্দর? বস্তু ও মানুষের মধ্যে পড়ে থাকা কোনও অলীক সেতু কি সুন্দর করে তোলে দৃশ্যকে? না কি ‘সুন্দর’ সংস্কার মাত্র? হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সংস্কারের ফলে আমরা প্রথামাফিক কিছু বস্তুর সঙ্গে, কিছু ধারণার সঙ্গে আরোপ করে চলেছি সুন্দরকে?
যদি আমাদের সৌন্দর্যচেতনা ‘নির্মিত’ হয়ে থাকে তবে তা অবস্থান করছে আমাদেরই স্নায়ুর ভেতর। আর যদি সেটি নির্মিত না-হয় তবে তার অবস্থান অনেক বেশি জটিল রূপ ধারণ করে রয়েছে।
এ খেলার সামনে পড়ে ছিল চৈত্র-সন্ধ্যার শালবন; আজ তার দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই তারা-ভরা এক বিশাল আকাশ। সে আকাশ ও ছায়াপথ ক্রমাগত রূপান্তরিত হয়ে চলেছে এক বিশাল শান্ত-অজগরে, তার চোখের দিকে তাকিয়ে শিকারের বিহ্বল হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও পরিত্রাণ নেই। ধীরে ধীরে সে শিকারকে গ্রাসের ভেতর টেনে নেব। অথবা শিকার নিজে থেকে প্রবেশ করবে তার গ্রাসের ভেতর।
কিশোর বয়সে ‘দৃশ্য’টির চারপাশে কুয়াশার মতো ঘন হয়ে থাকা বিষয়টিকে কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। এখনও যে খুব বেশি বুঝতে পারি তা হয়তো নয়, তবে সেই কৈশোর আর আজকের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের সামনে বসে থাকার প্রহরগুলি। রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে এখন বুঝতে পারি একদিন ‘দৃশ্য’টির চারপাশে ঘন কুয়াশার মতো যা চেপে বসেছিল তা আসলে ‘মৃত্যুবোধ’।
মানুষের সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে মৃত্যুবোধ অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে রয়েছে। আরেকটু সাহস অর্জন করে বলা যায়, মানুষের সৌন্দর্যবোধের উৎপত্তি তার মৃত্যুবোধ থেকে।
একটি মুদ্রা কুয়াশায় পাক খেতে খেতে দেখিয়ে চলেছে দুটি পিঠ।
যে মানুষের মৃত্যুচেতনা যত গভীর তার সৌন্দর্যচেতনা তত গভীর। রবীন্দ্রনাথের গানের ভেতর বয়ে চলেছে এ যুগল-প্রবাহ। এ যুগল-প্রবাহের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে একটি’ই কমন-ফ্যাক্টর, সেটি হল ‘বিস্ময়’। বিস্মিত হবার থেকে বেশি মৌলিক অনুভূতি সম্ভবত আর কিছুই নেই। এই বিস্ময়ই একদিন এনে দাঁড় করিয়েছিল চৈত্রের শালবনের সামনে, একদিন যা সুন্দর বলে মনে হয়েছিল এ বিস্ময় তাকেই বহুদিন পর উপস্থাপিত করেছিল তীব্র ‘মৃত্যু’ হিসাবে।
এই বিস্ময়-দ্বীপের পারে ফুটে উঠছে রবীন্দ্রনাথের একটি গান, ‘সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি তারায় তারায় খচিত-’। গানটি পড়বার সময় মনে হতে বাধ্য, প্রথম লাইনে ‘বটে’ শব্দটির ব্যবহার কেন? এই শব্দটি কি নিঃসংশয় হবার প্রক্রিয়াকে বোঝাচ্ছে? না কি কল্পনাতীত সুন্দরকে সূচিত করছে? বারবার পড়ার পর আমার নিজস্ব মত, এই ‘বটে’ সুন্দরের অকল্পনীয় বিস্তারকে সূচিত করছে। দ্বিতীয় লাইনটিতে ‘র’ ও ‘ন/ণ’-বর্ণযুক্ত শব্দের ব্যবহার তীব্র গতিময়তা তৈরি করছে। লক্ষ করার, আট’টি শব্দের মধ্যে ছয়-টি শব্দ’ই এই ধারা মেনে প্রয়োগ করা হয়েছে। ব্যবহৃত হয়েছে দুটি বিশেষণ, ‘শোভন’ ও ‘লোভন’।
এ দুটি শব্দকে এখন আর নিছক বিশেষণ হিসাবে গণ্য করতে মন সায় দেয় না, মনে হয় স্নায়ুর ভেতর প্রবেশ করে যাওয়া সুন্দরের গায়ে যেন অনুভবের অতিকায় ইন্দ্রিয় সংযুক্ত করে চলেছে এক একটি মাত্রা। ‘অলীক’ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সুন্দর ক্রমশ ‘মূর্ত’ হয়ে উঠছে।
এই গানটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় লাইনের মধ্যে যে অকল্পনীয় উল্লম্ফন রয়েছে তাকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘খড়্গ তোমার আরো মনোহর লাগে বাঁকা বিদ্যুতে আঁকা সে’।
‘খড়্গ’ শব্দটি দ্বিতীয় লাইনে তৈরি হওয়া প্রবল গতিকে আশ্রয় করে দ্রুত ভেসে চলে যাচ্ছে, কিন্তু বারবার ঝলসে উঠছে। কালো অন্ধকার নিকষ সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে ঝকঝকে এক খড়্গ। সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে আমাদের সংস্কারজনিত ধারণার সঙ্গে ‘খড়্গ’ শব্দটি প্রাথমিক সংঘাত সৃষ্টি করবে। সেটাই স্বাভাবিক, এবং এই স্বাভাবিকতার পথ বেয়ে একদিন মনে হতে বাধ্য, সুন্দর কি তবে কোনও অবিমিশ্র বিষয় নয়! এমনকি অস্ত-আকাশে রবীন্দ্রনাথ দেখছেন ‘গরুড়ের পাখা রক্ত রবির রাগে…।’ এই রক্তপাতের মধ্যেও কি লুকিয়ে রয়েছে সুন্দরের আভা?
এ প্রশ্নের আসলে কোনও উত্তর হয় না, যিনি এ মহা-জিজ্ঞাসার সব থেকে কাছাকাছি যেতে পারেন তিনি রবীন্দ্রনাথ; তিনি পঞ্চম লাইনে এসে লিখছেন, ‘জীবনশেষের শেষজাগরণসম ঝলসিছে মহাবেদনা -’। একটি সংযোগ যেন এখনও রয়ে গিয়েছে জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে, এবার সেটি ছিন্ন হবার সময় আগত। কিন্তু সেখানে মহাবেদনার ঝলক দেখা দিচ্ছে কেন? এ বেদনা কি প্রাণকে ছিন্ন করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বার বেদনা?
এখানে এসে বিস্তর দ্বন্দ্ব তৈরি হতে শুরু করে; যে চেতনা লক্ষ করে ‘তাঁর’ খড়্গ, যার কাছে মনোহর লাগে বাঁকা-বিদ্যুতের মতো খড়্গের আকার তার এই বেদনার কারণ কী?
তা হলে কি মানুষ আসলে সুন্দরের ‘পরিচিত’ পরিসর ছেড়ে ‘অপরিচিত’ পরিসরের দিকে চলে যেতে ভয় পায়? এই ভয়ই কি মৃত্যু-ভয়? মৃত্যু কি আসলে সুন্দরের পরিচিত পরিসর ছেড়ে অপরিচিত পরিসরে চলে যাবার এক প্রক্রিয়া?
অথবা মহাবেদনার কারণ অন্যত্র’ও লুকিয়ে থাকতে পারে; জীবনের এই ক্ষণটিতে দাঁড়িয়ে একটি নির্দিষ্ট অবস্থান থেকে, একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে সে সুন্দরের অঙ্গদ দেখার সৌভাগ্য জন্মাচ্ছে, প্রতিমুহূর্তে। কিন্তু জীবনের এ পরিসর অতিক্রম করে চলে যাবার পর বহুকিছু ঘটতে পারে, ভিন্ন অবস্থান ভিন্ন দৃশ্যের জন্ম দিতে পারে, এমনকি দ্রষ্টার পৃথক অবস্থান লুপ্ত হয়ে গিয়ে সে লীন হয়ে যেতে পারে সুন্দরের সঙ্গেই – কিন্তু ‘এই’ বিশেষ বিন্দুটিকে হারিয়ে ফেলতে হবে চিরকালের মতো।
সুন্দরের দিকে তাকিয়ে থাকার বিশেষ বিন্দুটি মুছে যেতে যেতে জন্ম দিয়ে যাচ্ছে মহাবেদনার, এমন সিদ্ধান্তেও পৌঁছানো অসম্ভব নয়।
এবং প্রায় এই ধারণার কাছাকাছি ঘুরে চলেছে ষষ্ঠ-লাইনটি, ‘নিমেষে দহিয়া যায় যাহা-কিছু আছে মম তীব্র ভীষণ চেতনা’। এ চেতনাই সুন্দরকে সুন্দর করে তুলেছে দিনে দিনে, এ চেতনা বস্তু-নিরপেক্ষ নয়; আবার একমাত্র বস্তু-সংলগ্ন’ও নয়। গরুড়ের পাখা রক্ত রবির রাগে তাকে পিষে দিয়ে… ‘দহিয়া’ যাচ্ছে। অর্থাৎ সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেল যে ‘মৃত্যুপথযাত্রী’ ও ‘মৃতের’ মধ্যে পার্থক্য ওই চেতনার বিলুপ্তি। যে চেতনা সুন্দরকে সুন্দর করে তুলেছে তার বিলুপ্তি।
এই গানটির শেষ দুটি-লাইনে আর তেমন কোনও উল্লম্ফন নেই; এসেছে বজ্রপাণি ও ‘চরম শোভার’ উল্লেখ। কিন্তু তা গরুড়ের পাখা গুটিয়ে নেবার প্রক্রিয়া, অনেকাংশে। গানটি শেষ করার পর যে কথাটি বারবার মনে হয় তা হল, সমস্ত মৃত্যু’ই আসলে ‘সৌন্দর্যের মৃত্যু’।
এই গানটিতে যে experience-এর দেখা পাওয়া যাচ্ছে তাঁকে গানের মাঝ-পথে এসে মৃত্যুপথযাত্রী বলে মনে হতে পারে। কিন্তু গভীরতর পাঠ উন্মোচন করবে, তাঁর কাছে সুন্দর তার সবটুকু উজাড় করে দেখিয়ে দিচ্ছে। এবং এর পরই যেন বন্ধ হয়ে যাবে মহাজাগতিক দরজা। শেষবারের মতো পিপাসার্ত এক প্রাণ তাকিয়ে দেখছে সুন্দরকে। দিগন্তে বসিয়ে রাখা কর্পূরদান থেকে শিখা লাফিয়ে উঠছে আকাশে, দপ করে নিভে যাবার পর যে অন্ধকার সে অন্ধকারের রূপ ছড়িয়ে রয়েছে গানটির শরীরে। এ গান সমস্ত শিল্পের মতই ‘পবিত্র প্রতারক’; কারণ গানটিতে যতই সুন্দরের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসা বর্ণনা থাক-না কেন, তার নীচেই লুকিয়ে রয়েছে শেষজাগরণের ঝলসে ওঠা মহাবেদনা।
আরও এক ‘প্রতারণা’ রয়েছে গানটিতে, সেটি অবশ্য ‘সুন্দরের’ ধারণা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিতে পারে। লক্ষ করার, সুন্দরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যেন কিছুটা ইচ্ছা করেই ব্যবহার করছেন ‘স্বর্ণ’ ‘রত্ন’ ‘বর্ণ’ ইত্যাদি শব্দ। এই শব্দগুলি বিবর্ধক এবং প্রতারক। এগুলি সুন্দর’কে benign করে তুলছে ধীরে ধীরে; রবীন্দ্রনাথ এই অবসরে গানটিতে দু-দুবার ব্যবহার করছেন ‘খড়্গ’ শব্দটি। যেন নটরাজের পায়ের আঘাতে দুলে উঠছে পৃথিবী; প্রলয়ের প্রস্তুতি। আত্মধ্বংসে মগ্ন সুন্দরের মহা-ছায়া ঘন হয়ে উঠছে চারপাশে। বজ্রপাণির থেকেও বেশি প্রকট হয়ে উঠছে তাঁর খড়্গ। এই খড়্গ’ই হয়তো শেষ সত্য। সমস্ত সুন্দরের মধ্যে সে বসে থাকে, জেগে থাকে নিজের রুধির নিজে পান করবে বলে।
সুন্দর ঘাতক, আত্মধ্বংসে রত; সে ব্যক্তির। সুন্দরকে দেখার প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে মৃত্যু ঘটে ব্যক্তির।
প্রতিটি তীব্র অনুভূতিশীল মানুষের মতো সুন্দরও আত্মধ্বংসপ্রবণ। কারণ প্রতিটি অনুভূতিশীল মানুষ আসলে সুন্দরের হাড়মাংস দিয়ে গড়া এক একটি অলীক মানুষ।
Leave a reply