যারা প্রতিরোধে নামে, তাদের সবার জন্য এই এক ঘুমপাড়ানি গান
ঘুমোতে যাওয়ার সময় যারা প্রতিরোধে নামে, তাদের সবার জন্য এই এক ঘুমপাড়ানি গান। যখনই বলে কেউ: আলো বন্ধ, একটাও কথা নয় আর, ক্লান্ত বন্ধুরা – ওহে, আপামর পানশালা জুড়ে চেয়ারেরা স্তূপ হ’য়ে উঠে গেছে টেবিলে-টেবিলে, পোস্টার বদলেছে – তাই ফিসফিসিয়ে উঠছে বিলবোর্ড, ব্যাঙ্কের খাঁ-খাঁ হলঘরগুলি ধরা পড়ছে ক্যামেরায়, জ্ব’লে উঠছে রাতবাক্স সব, রাতের সমস্ত বাস শহরের আলো-ঝলমল গির্জার বুক চিরে গরগর শব্দে ছুটে যাচ্ছে ওই; ঠিক তখনই যারা একটা যুদ্ধ গ’ড়ে তোলে, এই এক ঘুমপাড়ানি গান তাদের সকলের। আমরা ছবিতে কথা বলছি। কিন্তু ‘অন্ধকার’ কীভাবে লেখা হয়, সে ব্যাপারে আমাদের কারোরই কি ধারণা রয়েছে? আমার ক্লান্ত, রাতকানা বন্ধুরা – শোনো, আমরা সুসংবাদের প্রতীক্ষায় আছি, যদিও সুসংবাদ আজকাল বড়োই দুর্লভ, তবু আমরা অপেক্ষা করছি সেইসব দু’টো-তিনটে গুঞ্জনরত, সুন্দর স্বপ্নের, চারটি শান্তিচুক্তির, গভীর ঘুমে মগ্ন পাঁচটি আপেলের, আমরা অপেক্ষা করছি ছ’খানি গির্জা আর সাতটি স্বাস্থ্যবতী গাভীর, আটঘণ্টা প্রশান্ত নিদ্রার, আমরা অপেক্ষা করছি ন’জন নিখোঁজ বন্ধুর। কর গুনে চলেছি আমরা – অনর্গল।
আমরা প্রতিরোধ করছি এখনও। আমরা কেউ ঘুমোতে যাব না।
জার্মান ভাষা বিষয়ক সংবাদ ২০২৬ খৃষ্টাব্দ
বার্লিন। এ যদি সফল হয় তবে আমি হ’য়ে উঠব রাইসরিষায় পূর্ণ এক মাঠ, হরিণীকে দেব আচ্ছাদন আর একের উপরে এক স্তূপীকৃত তেরোটি তৈলচিত্রের মতো হব উদ্ভাসিত। এ যদি সফল হয় এই এক্ষুনি, তবে আমি ফেনা হব ইরাকি খেজুররসের, হ’য়ে যাব তুর্কি মধুর কিউব, সিরিয়ার কবিতা, নুড়িপাথরের মতো সুগোল ও মসৃণ কোনও জ্যামিতিক রূপ, তৃণক্ষেত্রের ফুল, সুভাষিত হে, এ-কথা বোলো না: উজ্জ্বল, কালো তালা হাতে পৃথু কিশোরের মৃদুভাষ আমি, যা তার অন্ত্যমিল রেখে যায় সূক্ষ্ম বিস্ফোরকে, খাবি খেতে খেতে বলে: কুকুরের কাছে নয়, এখানে সবাই ঘুঘুপাখিদের কাছে যাবে। (এ যদি সফল না হয়, তাহলে আমাকে আমার ভাষা ভুলে যেতে দাও। একফসলী জমি আমি, কর্ষণ বিঘ্নিত ক’রে মাথাটি ঘোরাই। যদিও, সত্যি বলতে, আমি আর নেই আজ আমার স্বদেশে)। কিন্তু এ যদি সফল হয় তবে আমরা, অর্থাৎ তুমি, আমি – আমরা সবাই, ঐকতানে গেয়ে উঠব কোনও ঘুমপাড়ানি গান, যেন রাইসরিষায় পূর্ণ এক মুখ, সাদা কাগজের গায়ে আমরা হব তরল আঠাটি। আমরা হব লঘু এবং গুরু। তবে তারও চেয়ে বড়ো কথা হ’ল, হ’য়ে উঠব আমরা সবাই।
এ-কবিতা নিখুঁতভাবে স্বচ্ছ
এ-কবিতা নিখুঁতভাবে স্বচ্ছ
এ-কবিতা সহজপাঠ্য নয়। না-থাকার মতোই সুন্দর
এই কবিতাটি। এ-কবিতা লিখিতই হয়নি
এখনও। নির্ভুল কবিতাকে শুধু
গাওয়া আর বলা যেতে পারে, বাজিয়ে
শোনার পর আবারও বাজানো যেতে পারে:
সুবিপুল মীনগর্ভের মতো
অন্ধকার ইমারতের অন্তর্গত শব্দেরা
আলোকিত বাতির নির্মাণ। এখনও কিছুই দেখতে পাচ্ছ না তুমি?
তবে, দয়া ক’রে, ঠিক পাশটিতে দ্যাখো – এবং অতীতে।
অভিনয় শেষ হ’য়ে গেলে
অভিনয় শেষ হ’য়ে গেলে, ম’রে এলে সব হাততালি, বাচ্চা-কোলে নারীটির শেষ ছায়াটুকু অন্ধকার হলঘরে যখন আর চোখেও পড়ে না, সমস্ত দর্শক যখন ফিরে গেছে বাড়ি – আপন শিশুর কাছে, তাদের পালন করেছে আর কোনও এক অজ্ঞাত কারণবশত ক্রমশই ছোট হ’তে হ’তে শেষমেশ অদৃশ্যই হ’য়ে গিয়েছে একদিন, এমনকি হলঘরটিও যখন আর সেইখানে দীর্ঘকাল দাঁড়িয়ে না-থেকে তার সব সৌন্দর্যের নিরুপম প্রমাণস্বরূপ রেখে গেছে শুধু নীলনকশা আর হাতভর্তি হলদে-হওয়া ছবি, সুবিপুল মীনগর্ভের মতো ছিল তার অভ্যন্তর, আওয়াজও তেমন – তারই যেন প্রমাণ হিসেবে – তারপর একে একে চ’লে গেলে সেই সবকিছু, প’ড়ে থাকে খালি এই প্রাচীন রটনা, একদা সেখানে একটা কিছু ছিল – প্রকাণ্ড ও অবিশ্বাস্য সুন্দর একটা কিছু, একটা গানের বাড়ি – ছাদের বদলে ছিল দু’টো শিঙা – আলাদা মাপের, দু’কোণার মাঝে ব্যাপৃত ছিল ফিনফিনে সহস্র দেওয়াল, মতান্তরে স্রেফ সার্কাসের তাঁবু –
একা কিংবা দলবদ্ধ প্রকৃত প্রাণীদের সাথে গেয়ে উঠব ব’লে একখানি সান্ত্বনার গান, এবং মুক্ত প্রশস্ত চোখের গভীরে তার সেই প্রাচীন দুষ্ট এক ভয় চেয়ে দেখব ব’লে
বিদায়, ছোট্ট পাখি
সবকিছু বড়ো ভালো আছে
বিদায়, হে ছোট্ট ইঁদুর
দূরে গিয়ে রক্তকে চুমু খেয়ে এসো
বিদায়, সিংহের মুখ
সব দাঁত ঝ’রে গেছে তার
বিদায়, হে প্রিয় প্রবীণ ঘোড়াটি
একটি কেশরও তার অবশিষ্ট নেই
এবং বিদায়, বিদায় ওহে ক্ষুদ্র মোরগ
আর কিছু ভালো হবে না কো
এরপরে ফের
উলরিক আমু স্যান্ডিগ (জার্মানি, ১৯৭৯)
১৯৭৯ সালে পূর্বতন পূর্ব জার্মানির গ্রোবেনহেইন গ্রামের জাতক উলরিক আমু স্যান্ডিগ তাঁর জীবন শুরু করেন একরকমের গেরিলা কবি হিসেবে, বন্ধুদের সাথে লিপজিগের রাস্তায়-রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টে কবিতা সাঁটানো আর বিনামূল্যের পোস্টকার্ড কিংবা প্রচারপত্রে লেখা কবিতা বিলি করার মাধ্যমে। প্রচলিত কাঠামো থেকে কবিতাকে মুক্ত ক’রে পাঠকের, বিশেষত আগে কখনই কবিতা না-পড়া পাঠকের, কাছে পৌঁছে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় একেবারে শুরুর এই দৃশ্যশ্রাব্য প্রকল্পগুলি থেকেই। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জুন্ডার’ (‘টিন্ডার’, ২০০৫), প্রাচীন যে-শব্দের অর্থ ‘খড়কুটো’, প্রকাশিত হয় কবিতার জগতে চরিত্রগতভাবে জোরালো এক আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে। উদ্ভাবনশীলতার নিরিখে সর্বত্রগামী বিস্তারে এই কবিতাগুলি ছিটকে আসে সশব্দে। এমনকি বইটি প্রকাশের ইতিহাসের দিকে তাকালেও এর গভীরতা খানিকটা আঁচ করা যায়: ২০০৯ সালে এই কাব্যসংগ্রহের একটি সংস্করণ ও পুনর্মুদ্রণ ঘটে, যেখানে পূর্বে অস্বীকৃত কয়েকটি কবিতাকে বেশ কিছুটা ক’রে বদলে দেওয়া হয়। স্ট্রিউমেনে (২০০৭) ফুটে ওঠে অপসরণ ও প্রত্যাবর্তনের টানাপোড়েন, যা প্রভাবিত করবে তাঁর পরবর্তী সংকলনগুলিকেও। বাস্তব ও কল্পনার মাঝামাঝি ক্রমাগত দোদুল্যমান থাকে এই কবিতাগুলি, যাকে পুষ্ট করে অজানা দিগন্তের প্রতি তীব্র কামনা। ‘ডিকিক্ট’ (‘থিকেট’, ২০১১) ব’লে যায় কোনও এক কল্পিত উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে আবেগঘন ভ্রমণের কথা, তবে, শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট, এ-বইয়ের কবিতারা সব ঢুকে পড়ে নানা ‘ঝোপঝাড়ে’, যাদের অবস্থান একইসাথে এই পৃথিবীতে, বোধে ও ভাষায়। একক ব্যক্তিমানুষের জরুরি গঠনে ক্রমাগত নিজেদের গ্রথিত ক’রে চলে সুবৃহৎ ঐতিহাসিক নানান সংস্রব। ২০১৬ র্যাপসংগ্রহ, শিল্পদক্ষ ‘গাম্ভীর্যের’ চক্র (‘গ্রিম’ সাইকেল) যার অন্তর্গত, ফ্যাসিজম, বলপূর্বক অভিপ্রয়াণ, জেনোফোবিয়া ও অত্যাচারের বিবিধ অনুষঙ্গে তা এই ধারারেখাটিকেই প্রবহমান রাখে। তবে তাঁর কাব্যভাষা স্পষ্টত গীতধর্মী স্বীকারোক্তিমূলক নয়, বরঞ্চ স্থাপত্য-সমতুল, বিজ্ঞাপনী স্লোগান থেকে শুরু ক’রে সাহিত্য, বাইবেল বা শিশুতোষ ছড়া – সমস্ত উৎসকেই যা খেলাচ্ছলে অনন্য এক মায়াস্বর দেয়। একটি কবিতায় যেমন পাব: ‘আমি এক দ্বি-স্বরীয় পাখি’। কঠোরভাবে সমকালীন, অথচ সংযমী, কখনও কখনও আবার শ্লেষাত্মক কিংবা স্মৃতিমেদুর হওয়ার পাশাপাশিই তাঁর লেখা গভীর গহনে সাংগীতিকও বটে। এই সুপ্ত সঙ্গীত যেমন অন্তর্নিহিত থাকে তাঁর নিজস্ব অনুষ্ঠানগুলিতে, তেমনই ধরা পড়ে অন্যান্য কবি, সঙ্গীতস্রষ্টা কিংবা চলচ্চিত্রনির্মাতাদের সাথে তাঁর যৌথ উদ্যোগের কাজগুলিতেও, যাদের মধ্যে ইউক্রেনিয়ান কবি ও সঙ্গীতকার গ্রিগরি সেমেনচুকের সঙ্গে গ’ড়ে তোলা তাঁর কবিতার ব্যান্ড ল্যান্ডসক্যাফটের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
Leave a reply