হারমোনিয়াম
আচমকা বেজে ওঠে হারমোনিয়াম
মেঘ বালিকা কবিতাটা কেমন সারাদিন ঝিম করে রাখে
গোঁসাই ঠাকুর কী করে যেন মনের কথা লেখেন!
আজকাল মন বোঝে না কেউ।
বয়সের গন্ধ সারা বাড়ি, উঠোন, এমনকি গেট পেরিয়ে দূরের রাস্তায় পাখির মতো ওড়ে…
হারমোনিয়ামে মা গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত
অথচ বাবা কী অবলীলায় ভেঙেছিল সমস্ত গান
পুরুষ কী বোঝে কান্নারও একটা সুর হয়?
সেই সুরে কত গান শিউলির মতো ঝরে
ছোট ছোট গাছ গুলো ফিনফিনে পাতায়
তিরতির করে কাঁপে
পশলা বৃষ্টির পর মাটির গন্ধে মিশে যায় নুন
মা গাইতে শুরু করে, শ্রাবনের ধারার মতো পড়ুক ঝরে।
সেই যন্ত্রে হাত রাখিনি বহুদিন
এক ফেরিয়ালা হাজার টাকায় নিয়ে গেল
মায়ের সমস্ত জল মেঘের মতো পিছু নিল
এ ভালোবাসা বুঝিনি কোনোদিন।
আজ সে খালি গলায় গায়।
রোজ একটা করে বেজে ওঠে রিড
কত না শোনা কথা, সুর
মা যেন ঝরণার জল…
সেই হারমোনিয়ামের শব্দ কানে আসে বড়ো আজকাল।
হাওয়ায় তার ভাঙা নিঃশ্বাস অতৃপ্ত আত্মার মতো
মেঘবালিকারা তার কথা শুনতে পায়।
তারপর বৃষ্টি নামে,
মা গেয়ে চলে, যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে!
সোনার হরিণ
তোমাকে উদ্ধারকর্তা ভেবে বন্যায় ভেসে যাওয়া গ্রাম
আজ চোখ খুলে দেখে, ছড়ানো খড় আর ভিজে কাঠের
ওপর মাটির সংসার গলে পড়ছে টপটপ করে।
যেন ঠিক হাতের পাঁচটা আঙুল বেয়ে গড়াচ্ছে রক্ত।
হ্যারিকেনে পুড়ে যাওয়া কব্জির ওপর
চেপে বসেছে সোনার ব্রেসলেট। আলোর ঝলকানিতে
মিথ্যেও সোনার হরিণ মনে হয়।
স্তব্ধ গ্রাম, ফিকে হয়ে আসা রোদ
কতবার রাস্তা দেখতে দেখতে ভেবেছে
যেখানে নিঃস্ব হয়েছে এত প্রেম, একবারো কি
মনে পড়েনি?
যখন সদ্য বৃষ্টিতে ভিজে পিচরাস্তায় আলোগুলো
মিশে যায় ছায়ার মায়ায়, তখনও কি
কোনো হাওয়া এসে ঘেঁটে দেয় না আঁচড়ানো চুল?
নিষ্ঠুর কত হতে পারে মানুষ?
হারালেও যারা বোঝেনা কি হারিয়েছে তারা কি
আজও নিজেদের প্রেমিক বলে?
মাধুকরী
ভিক্ষা চেয়েছ ভিক্ষুকের কাছে,
উদাসী ধুলোপথে একাকী নূপুর
বাজতে বাজতে তার তালা লেগে যায় কানে।
নিঃস্ব হাত বাড়িয়ে দেয়, খোলা আকাশ
ধূসর কালিমাখা নগ্নতা ঢাকবে কে?
এ সাধ্যি কার?
ভিক্ষুক চেয়ে থাকে
যেন এক তির বিদ্ধ করছে ভূমি
ভাবো সে এক পাগল,
এত শূন্য কি করে হতে পারে কোনো মানুষ?
আসলে তারা জানে না, হারানোয় কি এক নেশা!
হারাতে হারাতে ভুলে যাওয়া মৃত্যুও কত ভয়ানক
হতে পারে!
শূন্য হাওয়ায় ভিক্ষুক উড়িয়ে দেয় সারাদিনের মাধুকরী!
ছোঁয়াচে
নিভন্ত উনুনে ধোঁয়া
কী আপ্রাণ চেষ্টা! সহস্র জ্বালা…
যতদূর চোখ যায় হু হু করে পথ
ভিড় ভিড় শুধু ভিড়
তবু কুড়ে কুড়ে খায় নিঃসঙ্গতা।
বন্ধু খোঁজার চেষ্টা বয়স থামিয়েছে কবেই
এখন শুধু আত্মহত্যা
কাকে আজ ‘তুমি’ বলে ডাকি?
চিতার ওপর বসে কবিতা লিখি রোজ!
এক একটা জঞ্জাল জমা হয়।
এসব পোড়াতে গেলেও হাত কাঁপে।
মনে হয় সারা শরীর দগদগে চামড়া আর ঝুলে পড়া মাংস।
কিভাবে কতদূর পথের পর পথ?
শেষ বাঁকে পড়ে থাকা স্ট্রেট হ্যান্ডেল সাইকেল
দুজন চোখে চোখ রেখে ভাগ করে নিচ্ছে সমস্ত ব্যথা…
যত ভাবব না ভাবি, ততবার জাগিয়ে রাখে।
দুঃখ বড়ো ছোঁয়াচে।
একদিন থেকে ক্রমশ বাড়তে বাড়তে গোটা জন্মটা নিয়ে নেয়!
সেবার রায়গঞ্জ যাওয়ার সময়
এসি কাচে আটকে যাচ্ছে শ্বাস
হাওয়ার স্পর্শ নেই
কাচের এপারে বদ্ধ হয়ে উঠছে প্রকৃতির চিৎকার
ধাক্কা খায়, ফিরে যায় বাধ্য হয়ে।
ছোটবেলা এমন তো ছিল না!
হাওড়া থেকে রাজস্থান কিংবা কন্যাকুমারি
স্লিপারক্লাস
চায়ের গন্ধ, মিঠা পান
কেক চানাচুর বিস্কুট আরো কতকি।
লোটা নিয়ে গলায় গামছা ঝুলিয়ে
তাকিয়ে আছে প্রৌঢ়, হয়ত ভাবছে না কিছুই আবার
অনেক কিছু…
হঠাৎ চিৎকার করে ওঠা বয়স্ক মহিলাটি
ঝগড়া করছে অকারণে কলা বিক্রেতার সাথে
সেসব দৃশ্য ওরা দেখে না আজ।
ভার্চুয়াল রোবট মানুষ
ছুটন্ত ট্রেনে দৌড়ে বেড়ায় না আর।
ভিডিও গেমে বিভোর হয়ে ওঠে ট্রেনের জার্নি।
কিছু গল্পের বই রেখেছি তাই।
উপেন্দ্রকিশোর, কখনও বা স্মল স্টোরিস।
পড়ছি আর ওর মুখের ওপর বসতে দেখছি
ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি।
ট্রেনের ভেতর আবার আকাশ ঢুকে পড়ছে হুড়মুড় করে
রাতের ঠান্ডা হাওয়া…
ওর চকচকে চোখে ক্রমশ জেগে উঠছে আমার শৈশব।
Leave a reply