সেদিন সকালে বেশ কিছুদিন পর পৃথিবী ভাসিয়ে দেওয়া রোদ উঠেছে। এ রোদ্দুরের আনন্দই আলাদা, কারণ তার আগে খ্যাপা শ্রাবণ ছুটে এসেছিল শরতের আঙিনায়, বারবার। রবীন্দ্রনাথের একটি গান মাথার ভেতর ঘুরঘুর করতে শুরু করেছিল; সব কাজের মধ্যে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল। প্রাত্যহিক কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর মতো উপস্থিতি নয় তার, সে শান্ত-সন্ত্রাসের ধারা স্নায়ুতে ঢুকে পড়া। সে ছারখার করবে না, আবার হাত ছেড়েও যাবে না। ফিকে হয়ে যেতে যেতে রহস্যময় বারুদের মতো দপ করে জ্বলে উঠবে।
লাইনটি হল, ‘কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে…।’ মাত্র এই পাঁচটি শব্দকে মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, এই পাঁচটি শব্দের মধ্যে দিয়ে একটা চলে যাওয়া রাস্তা দেখতে পাচ্ছিলাম; সে রাস্তার শুরু অন্ধকার সমুদ্রের ধারে এক লঞ্চিং-প্যাড থেকে। সে রাস্তার কোনও শেষ নেই, সে রাস্তা ধরে যাওয়া একটি ছোট্ট গাড়ির বন্ধ জানালার কাঁচে চোখ রেখে বসে আছে একজন মানুষ। স্মৃতি ও স্মৃতির কামড়ে ক্ষতবিক্ষত হওয়া একজন।
জানালা দিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে তীব্র গতি’তে সরে সরে যাচ্ছে মহাজাগতিক বস্তুপুঞ্জ… মরুপ্রান্তরের দিকে ক্রমশ এগিয়ে গেলে যেমন কমে আসতে শুরু করে গাছের সার ঠিক তেমনই এই ইভেন্ট-হরাইজনের দিকে চলে যাওয়া, ভেসে যাওয়া গাড়ি ও তার সওয়ারি কি দেখতে পাচ্ছে ক্রমশ কমে আসছে বস্তুপুঞ্জ? শুধু এক অন্ধকার, প্রতি মুহূর্তে দ্বিগুণ থেকে চতুর্গুণ হয়ে উঠছে সে অন্ধকার।
অন্ধকারতম অন্ধকারের সঙ্গে অন্ধকারতম অন্ধকার গুণ করলে কী পাওয়া যায়? অনন্তকে দ্বিগুণ করলে যে দ্বিগুণ-অনন্ত পাওয়া যায়, শূন্যকে দ্বিগুণ করলে যে দ্বিগুণ-শূন্য পাওয়া যায় তার রূপ কেমন? মানুষ কি কোনও দিন সাক্ষাৎ পাবে তার?
মানুষ তাকে পাবে শুধু রবীন্দ্রনাথের গানে।
যেদিন প্রথম ইভেন্ট-হরাইজনের কথা পড়েছিলাম শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত নেমে গিয়েছিল। তটহীন সমুদ্রের বুকে স্থির হয়ে আছে কালো তরল, তরল অন্ধকার, একটা জাহাজ চলে যাচ্ছে সামান্য অর্ধবৃত্তাকার দিগন্তের দিকে, ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে আসছে তার শরীর। এবার সে খসে পড়বে আরও কোনও অন্ধকারের পেটের ভেতর। জাহাজটি আছে, কিন্তু তার শরীর থেকে আর কোনও সংকেত-তথ্য ভেসে আসছে না। জাহাজটি আছে, অথচ নেই।
এর বহুদিন পর পড়েছিলাম de Sitter রেডিয়েশনের কথা, যে রেডিয়েশনের ফলে গণন-প্রক্রিয়া থেমে যাবে, যেখান থেকে শুরু হবে experience-এর অসহায়তা।
‘কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে…’ পঙক্তি’টিতে যে ফুলটি ঝরে পড়ল তা কি সেই ইভেন্ট-হরাইজন’কে অতিক্রম করে অন্ধকার সমুদ্রের ধারে ফুটে থাকা কোনও ফুল? যে প্রান্তর থেকে কোনও তথ্য আসে না, আসে শুধু রবীন্দ্রনাথের গানের কয়েকটি পঙক্তি এবং কেঁপে ওঠে আমাদের আনখশির অস্তিত্ব।
এই পঙক্তিটির মুখোমুখি হয়েছি যতবার ততবার দেখতে পেয়েছি তরল অন্ধকারের বুকে খসে পড়ছে একটি ফুল এবং কেঁপে উঠছে সমুদ্র।
রবীন্দ্রনাথের এমন কোনও গানের মুখোমুখি আমি আজ পর্যন্ত হইনি যেখানে শব্দের আশ্চর্য প্রয়োগ দেখিনি। এখানেও তার অন্যথা হয়নি; এই গানটির গঠন এবং হয়ে ওঠাও অদ্ভুত।
বারো–লাইনের এই গানটির গঠন রিভার্স-পিরামিডের মতো। এই গানটির প্রথম লাইনটিকে কেউ যদি শেষ-লাইন হিসাবে ব্যবহার করেন তো দেখবেন গানটির মধ্যে এক উলটো স্রোতের খেলা শুরু হয়েছে। ‘কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে’র মতো একটি লাইনকে গানের প্রথমে ব্যবহার করা অকল্পনীয়, কিন্তু এটি না-করে সম্ভবত আর কোনও উপায়ও ছিল না। কারণ বিপুল সুগভীর ভিত্তি ছাড়া গানটির অপরাপর অংশগুলি স্থাপিত হতে পারত না।
গানটির প্রথম লাইনের পাঁচটি শব্দের মধ্যে সব থেকে ঘাতক শব্দটি হল ‘বিপুল’। ‘অন্ধকার’-এর আগে এই বিশেষণটি অন্ধকারকে প্রসারিত করে চলেছে প্রতি মুহূর্তে। ‘বিপুল’ শব্দটির শেষে ‘ল’ বর্ণটি অন্ধকারকে সামান্য পেলব করে দিচ্ছে, সন্দেহ নেই।
‘বিপুল’-এর এই ধরণের প্রয়োগের প্রতি কি রবীন্দ্রনাথের বিশেষ দুর্বলতা ছিল? তাঁর বহুগানে ‘বিপুল’ শব্দটি এসেছে; আমার শুধু এ মুহূর্তে মনে পড়েছে ‘আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসি’র কথা। লক্ষ করার বিষয় সেখানেও রবীন্দ্রনাথ ‘সুদূর’-এর আগে ‘বিপুল’ ব্যবহার করেছিলেন। আরও আশ্চর্যের, এই দরবেশের খেলা ও ম্যাজিক এমনই যে দুটি ক্ষেত্রেই (‘অন্ধকার’ ও ‘সুদূর’) ‘বিপুল’ ব্যবহৃত হয়ে তাদের অভিঘাতকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দকে সামান্য ওলটপালট করে দিয়ে বারবার উচ্চারণ করা আমার প্রিয় অভ্যাস। এর কারণ আছে, অনেকেই বিশ্বাস করবেন না জানি, তবু বলতেই হবে – এটা করতে গিয়ে আমি বারবার আবিষ্কার করেছি অন্য কোনও শব্দ… একই ওজন ও মাত্রার শব্দ রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত শব্দের ধারেকাছে আসছে না। তারা কখনও কখনও প্রতারণা করে, মনে হয় এই বিশেষ শব্দটি কেন ব্যবহার করলেন না রবীন্দ্রনাথ? সেটিই তো বেশি সুপ্রযুক্ত হত। যেমন এই গানটির প্রথম লাইনের ‘কী’ শব্দটির বদলে ‘যে’ বসিয়ে বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করবার চেষ্টা করেছিলাম।
একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে ‘কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে’র পরিবর্তে যে ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে লিখিত হলে গানটির মধ্যে ক্লোজ-এন্ডেডনেস ঘনিয়ে উঠত। সে ক্ষেত্রে সমস্ত গানটিই যেন হয়ে উঠতে একটি দীর্ঘ বাক্য, ইংরেজিতে যাকে বলে প্যারেনথেসিস, তেমন অংশ প্রবেশ করে থাকত গানটিতে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কেন ‘কী’ ব্যবহার করলেন?
এই ‘কী’-এর মধ্যে তো ‘যে’-এর নিশ্চয়তা নেই, তবু কেন ‘কী’? কী ফুল ঝরে গেল তা কি কবি জানেন না? সেক্ষেত্রে ‘কী’-এর পরিবর্তে ‘যে’-এর ব্যবহার অনেক বেশি সুপ্রযুক্ত হত। আসলে কবি ফুলের নিশ্চয়তার বদলে ফুল ঝরে যাবার দীর্ঘ… সুদীর্ঘ প্রক্রিয়াটির দিকে বেশি দৃষ্টি দিতে চেয়েছেন। ‘কী’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকা দীর্ঘ-ঈ সেই দীর্ঘ প্রক্রিয়াটিকে সূচিত করে চলেছে। ফুলের পরিচয় অতিপ্রকাশ্য করবার দিকে কবি তাকিয়ে ছিলেন না মনে হয়। ফুল ঝরে পড়বার যে রাজকীয় প্রক্রিয়া সেটি ওই ‘কী’ ব্যতিত প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না।
রবীন্দ্রনাথের গান এমনই, দুটি শব্দের মধ্যে ফুটে থাকে অনন্ত রহস্য। যেমন এ মুহূর্তে কী আশ্চর্যভাবে ঘনিয়ে উঠছে আরেকটি রহস্য। যতবার প্রথম লাইনটির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি ততবার ফুটে উঠছে তরল-অন্ধকার স্রোতের কাছে ঝুঁকে থাকা একটি গাছ; একটি মাত্র ফুল।
গানটির মধ্যে নিশ্চয় এমন কোনও উপাদান রয়েছে যা অবচেতনে বারবার একটি মাত্র গাছে একটি মাত্র ফুল ফুটিয়ে চলেছে। কিন্তু সেটি কেন? বারবার এই জায়গাটিতে ঘুরপাক খেতে খেতে বিদ্যুতচমকের মতো মনে হয়, ফুলের অতিরিক্ততা ‘কী’-এর অভিঘাতকে ম্লান করে দিত। আর একটি সম্ভাবনাও রয়ে গেল; গানটিতে ‘এক্সপেরিয়েন্সার’ একক মানুষ। তার ‘এক্সপেরিয়েন্স’এর এককত্ব’কে সম্পূরণ করে চলেছে একটি মাত্র ফুল। কারণ রবীন্দ্রনাথ গানের তৃতীয় পঙক্তি’তে লিখছেন, ‘একা এসেছি ভুলে অন্ধকারের কূলে।’
তৃতীয় লাইনে রবীন্দ্রনাথ যে ভুলের কথা বললেন তা আসলে মহত্তম ও পবিত্রতম ভুল, এ ভুলের জন্য অপেক্ষা করে থাকে একজন ‘একক’ মানুষ। এ ভুল থেকে শুরু হয় দীর্ঘ দীর্ঘ সফর; আলো-অন্ধকারমাখা সফর।
এ গানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ লাইন তুলনায় কম অভিঘাতময়, প্রথাগত। কবি লিখছেন, ‘ক্ষীণ দেহে মরি মরি সে যে নিয়েছিল বরি / অসীম সাহসে নিস্ফল সাধনারে’।। ক্ষীণ দেহের উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ দেহের অস্তিত্বকে ছাপিয়ে দেহাতীতের দিকে চলে গেলেন। মুহূর্তের জন্য ফুটে উঠল ধ্যানে বসা বুদ্ধের ছবি, মার-সৈন্য ঘিরে রয়েছে তার চারদিকে। বাইরের প্রলোভন তুচ্ছ করে একটি ক্ষীণ দেহ ক্ষীণতর হতে হতে ডুবে যাচ্ছে আলোর অন্ধকারে। পার্থক্য শুধু একটাই, এখানে সে প্রেমের পথে থিতু।
রবীন্দ্রনাথের প্রেম ‘অরূপরতন’; তাকে যে পাওয়া যাবে না, পেয়েও হারাতে হবে তা যেন নিয়তী-নির্দিষ্ট। এখানেও সেটিই ঘটছে, তার রূপ চোখে দেখা হল না। কিন্তু এরপর খুব শান্ত এক সন্ত্রাস, ‘জানি না কী নামে স্মরণ করিব ওকে।’ রবীন্দ্রনাথের গান আমাকে অসহায় ভাবে স্মৃতি-কণ্ডুয়ণের দিকে নিয়ে যায়, এক একটি শব্দ থেকে ছিটকে পড়ে অজস্র আলো। ঠিক যেমন এখন মনে পড়ছে এক বৌদ্ধ-বিশ্বাসের কথা। বৌদ্ধদের একটি অংশ বিশ্বাস করে, বুদ্ধের জন্মের আগে এ পৃথিবীতে কোনও বস্তুর কোনও নাম ছিল না; বুদ্ধ পৃথিবীর সমস্ত বস্তুর নাম দেন। এভাবেই তিনি ছড়িয়ে রয়েছেন প্রতিটি বস্তুর ভেতর, ধূলিকণা থেকে ধূলিকণায়।
এটি জানার পর বেশ কয়েকবার ভাবতে চেষ্টা করেছিলাম সে পৃথিবীর কথা; প্রান্তরের পর প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বস্তুপুঞ্জ; কিন্তু কোনও বস্তুর ‘নাম’ নেই। ধীরে ধীরে বস্তুর ভেতর ‘নাম’ প্রবেশ করছে এবং সেগুলি ‘বস্তু’ হয়ে উঠছে আমাদের কাছে।
সর্বগ্রাসী প্রেমও তো তাই-ই, নামহীন এক বিশুদ্ধ আলো।
কিন্তু কে ফিরে গেল বিরহের ধারে ধারে, রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘আঁধারে যাহারা চলে সেই তারাদের দলে / এসে ফিরে গেল বিরহের ধারে ধারে’। এখানে আঁধার ও তারাদের দল শব্দগুলি লক্ষ করার; তারাদের নিজস্ব আলো আছে, অথচ তারা চলেছে অন্ধকার মহা-সমুদ্রের মধ্যে। ‘সে’ নিজেও আলোর স্বরূপ, অথচ তাকে ঘিরে রয়েছে ঘন আঁধার। কিন্তু কে ফিরে গেল বিরহের ধারে?
ফিরে গেল যে একা এসেছিল সে; তার করুণ মাধুরী নিয়ে সে ফিরে গেল। একটি করুণ শঙ্খের ভেতর থেকে জেগে উঠছে দুটি স্বর, দুটিই সেই খুঁজে মরা প্রাণের। একটি স্বর আরেকটি স্বর’কে প্রশ্ন করছে; এ যেন এক পরিনামহীন, অন্তহীন দীর্ঘ স্বগত-সংলাপ। নিজের সঙ্গে নিজের কথা। আত্মার একটি টুকরো আরেকটি টুকরোকে প্রশ্ন করছে, ‘কেন এসেছিলে রাতের বন্ধ দ্বারে’।।
সে কি জানে না, করুণ মাধুরীমাখা প্রেম কি জানে না কেন সে বারবার রাতের অন্ধ দ্বারে ফিরে ফিরে আসে! তার সব সাধনার অন্তে যে বিরাজ করছে নিস্ফলতা তা তার চির চেনা। তবু সে আসে, বারবার আসে; ক্ষতবিক্ষত হয়। মরতে মরতে সে ফিরে আসে, মুখ রক্ত তুলে ফিরে আসে। ক্ষতবিক্ষত নিজের দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে, এই প্রশ্ন করার পরিসর নির্মাণ করাই তার সব থেকে বড় অর্জন। বারবার ফিরে না-এলে সে এই প্রশ্ন করার যোগ্য হয়ে উঠত না, হয়তো।
গানটিতে ছড়িয়ে রয়েছে তরল অন্ধকার, কোটি কোটি মাইল ব্যাপি অন্ধকার সমুদ্রের ঢেউ। কতবার চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করেছি, সে সমুদ্রের কি শব্দ আছে কোনও?
প্রতিবার মনে হয়েছে সে আসলে এক উত্তাল বিপুল সমুদ্র, অথচ শব্দহীন। তার বুক থেকে ফুঁসে উঠছে ঢেউয়ের পর ঢেউ, অথচ সে শব্দহীন।
এ সমুদ্র আসলে সেই প্রেম, সেই করুণমাধুরীমাখা প্রেম যে ‘কহিতে জানে না বাণী।’
সে বোবা-সমুদ্রের ধারে একটি মাত্র গাছ, গাছে একটি মাত্র ফুল; এইমাত্র সে ফুল খসে পড়ছে বিপুল অন্ধকারে।
অনিশ্চিত অনিবার্যতার মাঝখানে এটুকুই মাত্র ঘটনা, বাকিটা অন্ধকারে ঢাকা, উত্তরহীন।
Leave a reply