প্রথম আদি তব শক্তি–
আদি পরমোজ্জ্বল জ্যোতি তোমারি হে
গগনে গগনে।।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের মধ্য দিয়ে উপনিষদের এই মূল বাণীটিকে ধরতে সমর্থ হয়েছিলেন। উপনিষদের ঋষিদের মতোই তিনি ক্রমে এই সত্যে উপনীত হলেন যে ব্রহ্ম সারা বিশ্বব্যাপী এক প্রচ্ছন্ন সত্তা। মহাবিশ্বের প্রতি কণায় এই ব্রহ্ম উপস্থিত। অর্থাৎ আত্মা বা সৃষ্টির আদি উৎস বিভিন্ন জীবের মধ্যে প্রকাশিত। সুতরাং একই আদি সত্তা বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত। সর্বভূতে সেই অনাদি অনন্ত পরমেশ্বরের প্রকাশ। এই মহাবিশ্বের প্রতিটি মানুষ একই শক্তির অংশবিশেষ।
কোন্ আদিযুগে নিবিড় আঁধারে উপনিষদের ঋষির ধ্যানে মহান সত্যের যে ধ্রুবতারা জ্বলে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথ তাকে অন্তরে লালন করে বিশ্বব্যাপী মানবাত্মার এক মহামিলনের সাধনা করে গিয়েছেন। সারা বিশ্বময় মানবপ্রীতির এক নিগূঢ় শৃঙ্খল রচনা করতে চেয়েছেন। যে শৃঙ্খলে বাঁধা পড়লে মন আরো উন্মুক্ত হয়, উদার হয়। ঘুচে যায় মানুষের সাথে মানুষের সব বাধা ব্যবধান। যে উপলব্ধি আজকের বিশ্বের অনিবার্য শুশ্রূষা। এই আমার রবীন্দ্রনাথ যাঁকে আজকের পৃথিবীর খুব প্রয়োজন।
রবীন্দ্রনাথ একজন সার্বভৌম স্রষ্টা। বিচিত্র রূপের সমাবেশে তিনি এই জগতকে দেখেছেন। আর তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সেই রূপ দক্ষতার সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। আবহমান কালের মানুষের সান্নিধ্য তিনি যেমন উপভোগ করেছেন তেমনি তাদের অন্তরের মর্মমূলে প্রবেশ করেছেন। সমস্ত রকমের তুচ্ছতা, সংকীর্ণতা ও সম্প্রদায়গত বিভেদের উর্দ্ধে উঠে তিনি এক অনির্বান প্রদীপ জ্বালানোর সাধনায় নিজেকে আজীবন ব্রতী রেখেছিলেন। আমরা তাই রবীন্দ্রনাথকে যতটা উন্মোচিত করতে পারব আমাদের ধ্যানে, চিন্তনে, মননে ততই আমাদের সামনে খুলে যাবে এক উন্মুক্ত পৃথিবীর দুয়ার। আমরা উপলব্ধি করতে পারব আসলে আমাদের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ নেই।অহং ব্রহ্মাস্মি।
আর রেখো না আঁধারে,আমায় দেখতে দাও।
তোমার মাঝে আমার আপনারে দেখতে দাও।।
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত বিশ্বাস করতেন
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে
দিন রজনী কত অমৃত রস
উথলি যায় অনন্ত গগনে…
জাগতিক দুঃখ, মৃত্যু, বিরহদহনকে তিনি সত্য বলে জেনেছিলেন। কিন্তু সেই তাঁর সব সত্য ছিল না। তাঁর ছিল ঋষির প্রজ্ঞা। তাই আনন্দ ও অমৃতকে সবার উপরে স্থান দিয়েছিলেন। ব্যাক্তিগত শোক, দুঃখ, বিষাদ কখনো তাঁকে বিমূঢ় করতে পারেনি। অত্যন্ত সচেতন ভাবেই তিনি গোপন করে রেখেছেন নিজের যাবতীয় কষ্ট। কারণ তিনি দুঃখজয়ী হতে চেয়েছিলেন। নিদারুণ শোকের মুখোমুখি হয়েও তিনি কখনো প্রকাশ্যে অশ্রুবর্ষণ করেননি। গীতায় কৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত বাণীর মতো শোকে দুঃখে নিরুদ্বিগ্নমনা থেকেছেন। এও তাঁকে জীবনযুদ্ধে এক অভূতপূর্ব শক্তি জুগিয়েছে। উপনিষদের মতো গীতার পাঠও তিনি আত্মস্থ করেছেন। কিন্তু এসব করতে গিয়ে তিনি নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। তথাপি আমাদের সামনে এক অমৃতময় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যাতে আমরা উপলব্ধি করতে পারি মানুষ আনন্দ ও অমৃতের সন্তান। তাই আমাদের চরমতম দুঃখের দিনে নিবিড়তম শুশ্রূষা বলে যদি কিছু থাকে সে আমাদের শাশ্বত রবীন্দ্রনাথ। তিনিই প্রথম ঘোষণা করলেন জগতের অসংখ্য বন্ধনের মাঝেও পাওয়া যায় মুক্তির উচ্ছ্বাস–
অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ!
রবীন্দ্রনাথ সেই যুগপুরুষ যিনি আমাদের ভাবতে শেখালেন বিশ্বভাভৃত্ববোধ। আমাদের চৈতন্যকে জাগ্রত করে তিনি অনুভব করতে শেখালেন বিশ্বের অন্তরের নিহিত সত্যকে।
দুর্বল প্রাণের দৈন্য,
হিরণ্ময় ঐশ্বর্যে তোমার
দূর করি দাও,
পরাভূত রজনীর অপমান সহ।
রবীন্দ্রনাথের এই প্রার্থনা আমাদেরও প্রার্থনা। জগতের ঐশ্বর্যের আলোয় আমরা যেন দূর করতে পারি আমাদের প্রাণের দৈন্য। চতুর্দিকের অমানবিক হানাহানি আর কুৎসিত জাতিবৈরিতায় উৎকীর্ণ এই সঙ্কটময় সময়ে আমাদের একমাত্র আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ। তাঁর পরশখানি স্বীকার করে আমরা যদি মনের প্রদীপ জ্বালাতে পারি তাহলে এই কদর্য অন্ধকার থেকে উপলব্ধির আলোয় মুক্তি ঘটবে আমাদের। জয় হবে শাশ্বত মানবতার।
One comment on “অনিমেষ মণ্ডল”
শীর্ষা
সুন্দর লেখা। রবীন্দ্রনাথ সত্যিই একাধারে ঋষি ও দার্শনিক। তাঁর প্রতিটি লেখার যেন দুইটি তল আছে। প্রথমটি যেরকমটা আমরা পরীক্ষাসাপেক্ষ বিশ্লেষণ করি। আর দ্বিতীয়টি অনন্ত গহীন। যার তল পেতে গেলেও নিজেদের বোধকে জাগ্রত করে তুলতে হয়। নিজেদের এক একান্ত চিন্তন মননের জগৎ গড়ে তুলতে হয়। বহুদিন পর রবীন্দ্রনাথ নিয়ে পড়া এই লেখা আন্দোলিত করল বেশ।