“বাড়ি থেকে দু’পা বেরুলেই চারদিক ঘটনা।” লিখেছেন আলোক সরকার। কেমন সেই ঘটনা? ‘গাছ ঘটনা পাতা ঘটনা। সবাই আছে। চারদিক ভরে ঘটনা। একটা ছাই রঙের ফুল, তাও ঘটনা।’ আর সবাইকে দেখবে বলে চলা আরও দ্রুত হয়। ‘সবাই বলছে আছি, আছি এই যাচ্ছি।’ আসলে ‘শোনো জবা ফুল’ কাব্যগ্রন্থ জুড়ে সবটুকুই এক ঘটনাহীনতার বিস্তার। আলোক সরকারের পাঠক জানেন তাঁর কবিতায় কোনো ঘটনাই থাকে না। থাকে শুধু ঘটনাহীনতার নিবিড় বিস্তার। নির্বস্তুক আলোর বলয় অথবা বলা যাক অন্ধকার উৎসব। আলোক সরকারের কবিতা শেষ পর্যন্ত কিছুই বলে না, কেবল বেজে ওঠে। পাঠকের মনে বেজে ওঠে আনন্দময় বিষাদঘন আত্মউজ্জীবন। আনন্দ উৎসব। কিন্তু সে খুব মুখর নয়। আলোক সরকারের কবিতা এক অবয়ব স্থিরতার কথা বলে। ভেতরে ভেতরে বেজে ওঠে নিঃসীম অস্থিরতাও, যা অস্তিত্বকে বিহ্বল করে তোলে। তাঁর কবিতা পূর্বাপর শান্ত অভিনিবেশী ধ্বনিপ্রবাহ, বিমূর্ততা। শব্দের সঙ্গে শব্দ যুক্ত হয়ে বেজে ওঠে এক মায়াবী নিস্তব্ধতা। চরাচর জুড়ে একদিন কবে শুনতে পেয়েছিলেন এক ক্রন্দনধ্বনি, আর তার ভেতরে ক্রমজায়মান জিজ্ঞাসা। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন ‘একটি ভিক্ষাপাত্র আস্তে আস্তে ভরে উঠছে’ আর সে ভিক্ষাভাষা, সে থেমে থেমে বলছে…
সেই অপরিজ্ঞাত ধ্বনিপ্রবাহ– যে একটু একটু করে কেবল হয়ে উঠতে চায়। একটু একটু করে সমগ্রতায় পৌঁছাতে চায়, সুন্দরতায় পৌঁছাতে চায়। এই চাওয়াও তো এক অনুধ্যান না; অভিনিবেশ ভরা জিজ্ঞাসা–
‘শোনো জবাফুল
তোমার মাটি সরস আছে তো?
তোমার গায়ে রোদ্দুরের কাপড় আছে তো?
তোমার জন্য আমাদের খুব ভাবনা হয়–‘
মাটি না হলে, গায়ে রোদ্দুরের কাপড় না থাকলে কেমন করে অত সুন্দর হবে তুমি! এই যে সুন্দরতার জিজ্ঞাসা, এই জিজ্ঞাসার ভেতর যে অনন্ত ধ্বনিপ্রবাহের ভেসে যাওয়া– কোথায় যাচ্ছে, সে নিয়ে কাদেরইবা এত ভাবনা! এ কেবল কবি আলোক সরকারেরই একলার জগৎ। এই সব আর্ত কথাবলাগুলি। এর বাইরে বলবার মতো ঘটনা আর কিছুই নেই। এভাবেই অন্তর্লোক আলো করে পৃথিবীতে একটা সকাল হয়। পুবদিক রাঙা হয়ে ওঠে। নিঃসীম কিছু সংলাপ সবার আড়ালে নৈঃশব্দের ভেতর কথা বলে–
‘একজনের বলা কথা আর একজন বলছে।
ভালো আছ তো? তোমরা সকলে খুব ভালো আছ তো?
হাওয়া বলছে গাছকে, পাখি বলছে
শিশিরকে। সরু আঙুল দুলিয়ে।
সোনালি বলছে আকাশকে।…’
এই বলার ভেতরেই গমগম করে ওঠে ধ্বনি। আনন্দধ্বনি।
‘আকাশ বলছে
নদী বলছে
কাশফুল আনন্দধ্বনি।’
আনন্দধ্বনি কখনো অসত্য বলে না। তার কোনো কৃত্রিম পোশাক নেই। আনন্দধ্বনি ভেতর পর্যন্ত ছুঁয়ে যায়। গোটা এই বই জুড়ে নিভৃতলোকের এই শীলিত সংলাপ ছুঁয়ে শুধু একাকীর গান বাজে। একাকী ভয় বাজে। তখন নিজের দিকে মুখ ফেরানো। সমস্ত কিছুর মধ্যে কোথায় একটা ভয় গমগম করে। সমস্ত রাস্তা, সমস্ত পরিপার্শ্ব অচেনা মনে হয়। তার ভেতরে শুধু নিজের নামই একমাত্র নির্ভরযোগ্য সম্পদ। মনে হয় ‘নাম কত ভালো।’
‘পথে নামলেই ভয় হয়
ফিরে আসতে পারবো তো!
ওরা আমাকে চিনে নিতে পারবে তো!
সব সময় নিজের কাছে থাকি।
নিজের নাম খুব জোরে জোরে বলি
নাম কত ভালো
দূর থেকে ডাকলেও এদিক-ওদিক করা।
নাম যদি হাড়ায়! বুক থমথম করে ভয়ে।’
ভয় সমস্ত নিস্তব্ধতাকে নিবিড় করে তোলে। নিস্তব্ধতার দেবতার সঙ্গে চলে বিহ্বল আলাপন।
‘শব্দ না করে সে থেমে থেমে বলে
ওগো নিস্তব্ধতার দেবতা
তুমি আমাদের আর ভয় দেখিয়ো না।
তুমি সব ভয়ের কথা জান
খুব গোপন– সারা পৃথিবীজোড়া
সব ভয়ের কথা।’
আমগাছের ভেতর দিয়ে, শিরীষগাছের ভেতর দিয়ে কোনো বৈশাখ দুপুর এভাবেই অফুরন্ত হয়ে ওঠে।
‘শোনো জবাফুল’ এভাবেই অফুরন্ত এক অন্যপৃথিবীর কথা বলে। এগ্রন্থের কবিতাগুলির পৃথক কোনো নাম নেই। শুধু সংখ্যা চিহ্নিত হয়ে কবিতাগুলি বিন্যস্ত হয়েছে। অন্তর্লোকের জাগরন ভরা জীবনযাপনের পৃথিবী– দৈনন্দিনের ঘটনা, আপাততুচ্ছতা দিয়ে সে পৃথিবী গড়ে উঠেছে। ক্রমশ গড়ে ওঠা এক আত্মউন্মোচন। সে পথ সকাল-বিকাল-সন্ধ্যায় ভরা; নিস্তব্ধতায় জাগরুক। ক্রম প্রকাশমান এক মহাপৃথিবীর গল্প। কোনো দেখাই সেখানে ফুরোয় না। দেখা আর শেষ হয় না। দ্রষ্টা কবি কেবল বেরিয়ে পড়েন। পথ চলা তার শেষ হয় না।
‘একা একা চলতে চলতে বুঝি
অনেকের সঙ্গে চলেছি
চেনা অচেনার কথাই ওঠে না…’
আর সারি সারি, হারিয়ে যাওয়া– দেশহীন সময়হীন গৃহহীন এক হারিয়ে যাওয়া’… তার পরিপার্শ্ব জুড়ে বেজে ওঠে, কিছু শোনাতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। নিঃসঙ্গ ফুল সুন্দর হয়ে উঠছে, সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে চায় সে। সম্পূর্ণ হতে চেয়ে প্রতিমুহূর্তের জীবন চর্চা জুড়ে বেজে উঠছে নিভৃতলোক। আলোক সরকারের কবিতা এই নিভৃতলোক, এই অন্তর্লোকের অনুধ্যাননা।
One comment on “মুহম্মদ মতিউল্লাহ”
Rudra Kinshuk
ভালো লাগলো। ভালোবাসা, মতিদা।