পূর্ণচ্ছেদ আর একটি (কল্পিত) জিজ্ঞাসা-চিহ্নের মাঝখানে মহাতরঙ্গের মাথায় দোল খাচ্ছিলাম্ ঘণ্টার পর ঘণ্টা। উত্তর নিজের মতো করে কিছু-একটা পেয়েছিলাম, সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে।
আপাতত দেখা যাচ্ছে বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যতের উঠোন আলো করে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি ফুল্ল-শিরীষ। ফুল্ল শিরীষের কল্পনামাত্রই ঘটনাটি ঘটে যায় – ঋজু, প্রবল প্রাণের সঙ্গে তার ফুটে ওঠার প্রক্রিয়া মিলেমিশে তৈরি হয় উদ্দাম উৎসব, মাতামাতির প্রহর। একটি গানের মধ্যে বারবার মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে শিরীষ’টি – তার প্রাণশক্তির মধ্যে রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ততার অদম্য প্রকাশ।
এই গানটির কাছে বসে মনে হয়, প্রশ্নময় স্বতঃস্ফূর্ততাও তা হলে সম্ভব! এই গানটির প্রতিটি শব্দের ভেতর কান পেতে মনে হয় – স্বতঃস্ফূর্ততা আসলে প্রশ্নময়। যেখানে প্রশ্ন নেই সেখানে স্তব্ধ হয়ে আসে স্বতঃস্ফূর্ততা।
গানটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম, সন্ধে নেমেছে, ফাল্গুনের নিঃস্তব্ধ সন্ধে। ‘ক্ষান্তকূজন শান্তবিজন সন্ধ্যাবেলা’। সে সন্ধ্যায় আর কিছু নেই – শুধু একটি শিরীষগাছ আর হাওয়ার মাতন রয়েছে। সমস্ত সন্ধেটি যেন নিজেকে নিঃশেষ করে বেছে নিয়েছে দুটি মাত্র উপাদান – একটি শিরীষ আর হাওয়ার মাতন। এই হাওয়ার সমুদ্রের কোনও শুরু নেই, শেষ নেই। এবং অনিবার্য ভাবে এই দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছেন এক মানুষ, সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে তিনি শুষে নিচ্ছেন শিরীষের মাতন ও হাওয়ার গান। কিন্তু সে মানুষ পুরোপুরি রবীন্দ্রনাথ নন, এমনকি পোয়েট-পারসোনা অর্থেও রবীন্দ্রনাথ নন। আধো আলো-অন্ধকারের সেই সিল্যুয়েটে রবীন্দ্রনাথ নন, বসে রয়েছেন অন্য কেউ, তিনি রবীন্দ্রনাথের খুব কাছাকাছি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নন।
এই গানটির মধ্যে মারাত্মক এক দ্বিবাচনিকতা রয়েছে, সেটি আবিষ্কার করা যাবে একদম শেষের দিকে।
রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে এক জাদুকর যে বাস করেন সে নিয়ে আমার সন্দেহ নেই, তিনি হাতের খরগোশ’টি দেখা্ন ও স্নায়ুর ভেতর থেকে যুক্তি-তর্ক-বিন্যাস ইত্যাদির যে অনুচ্চ স্তরে আমাদের দীর্ঘ যাপন সেটিকে উপড়ে নেন, সেখানে প্রবেশ করিয়ে দেন অদৃশ্য আরেকটি মাত্রা। এই গানটিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি, ফুল্ল-শিরীষ নিজে পূর্ণ। কিন্তু এই সান্ধ্য-হাওয়ার মধ্যে খেলা করে যাচ্ছে তার প্রশ্ন ‘এসেছে কি – এসেছে কি।’
দ্বিতীয় স্তবকে গিয়ে আমরা পাই অতীত-সফর, গত-ফাগুনেও শিরীষের শাখা এমনই ফুলে ফুলে ভরা ছিল, সে প্রশ্ন’ও করেছিল, ‘আসে নি কি – আসে নি কি।’ লক্ষ্য করার বিষয়, এখানে এসে খুব সন্তর্পণে গানটির মধ্যে প্রবেশ করল ঈষৎ নেতিবাচক স্বর – যে প্রশ্ন এতদিন ছিল ‘এসেছে কি – এসেছে কি’ তাই এখন পরিবর্তিত হয়ে গেল ‘আসে নি কি – আসে নি কি’।
তৃতীয় স্তবক গিয়ে আরেকটি নীরব উল্লম্ফন ঘটে গেল, এখানে উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে ব্যবহৃত হল ‘আশ্বাস’ শব্দটি এবং গানটির হাত ধরে ভবিষ্যতের শিরীষ ফুটে উঠতে শুরু করল প্রাঙ্গণে। বর্তমান ও অতীত যদি অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত হয়ে থাকে তো এখানে এসে কবি আশ্রয় গ্রহণ করলেন কল্পনার। যা ঘটেনি কিন্তু যা ঘটতে পারে তেমন একটি অবস্থার কথা উপস্থাপিত হতে শুরু করল – ভবিষ্যৎ-শিরীষের ডালগুলি কান পেতে রয়েছে। সে শুনতে পাচ্ছে পায়ের শব্দ; কিন্তু ব্যক্তির উপস্থিতি তার কাছে নেই। সে ‘অলখ’ বলেই কি শিরীষের ডালে ডালে এই শিহরণ? এখানে শিরীষের প্রশ্ন – ‘সে কি আসে – সে কি আসে।‘ তা হলে কি ভবিষ্যৎ শিরীষের কাছে এই ‘আশ্বাস’ ও ‘বিশ্বাস’-এর ভূমিকা অনেক বেশি? এখানে এসেও রবীন্দ্রনাথ সংশয় ও অনির্ণীত অবস্থাটিকে বজায় রেখে দিলেন। কী সেই আশ্বাস ও বিশ্বাস তা আমাদের কাছে উন্মোচন করলেন না তিনি। কিন্তু গানটির এ পর্যন্ত এসে মনে হয় ফুল্ল-শিরীষের কোথাও একটা প্রশ্নাতীত প্রত্যয় রয়েছে – সে আসে এবং সে আসে। বিশ্বাসের আগে ‘কী’ শব্দটি বিশ্বাসের উৎসটিকে রহস্যময় করে তোলে, বিশ্বাস’কে নয়।
গানটির সমাপন এখানে হয়ে গেলেও গানটি অসামান্য একটি গান হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে থাকত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখানে এসে আরেকবার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেবেন। তিনি অতিক্রম করে চলে যাবেন সে দিগন্তরেখা যাকে আমরা চরম বলে ভুল করেছি। তিনি নবতর প্রান্তর চিহ্নিত করে দেবেন আমাদের কাছে। এতক্ষণ ফুল্ল-শিরীষের কাছে বসে নীরব শ্রোতার ভূমিকা পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, সে হয়ে উঠছে নিজেই এক প্রশ্নকর্তা।
নিমেষ গণনে বহুকাল কেটে গেছে, হয়তো আরও বহুকাল কেটে যাবে কিন্তু এখনও সে প্রহর আসেনি। ‘ভাগ্য-রাত’ শব্দ দু’টির মধ্যে নিয়তির ইশারা রয়েছে, সেই নিয়তি যার মাথার কাছে ধকধক করে জ্বলতে থাকে নীলাভ এক তারা। এই নীলাভ ব্যাথার মধ্যে অপেক্ষা করতে করতে মরুঝড়ের রাত্রি পেরিয়ে যাবে, ব্যক্তি ক্রমশ বুঝতে পারবে অপেক্ষার কোনও শেষ নেই। সারা চরাচর জুড়ে এ–অপেক্ষা কেঁদে কেঁদে ঘুরবে, ক্লান্ত হয়ে মাঝে মাঝে শান্ত হয়ে যাবে, আবার আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে উঠে আসবে সেই প্রশ্ন – ‘সে কি এল – সে কি এল।’
এই গানটির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এক অনন্ত আর পবিত্র প্যারাডক্স। এই ফুল্ল-কুসুমিত শিরীষ, ফাল্গুন-মাস, হাওয়ার দাপাদাপি ও ব্যক্তির অপেক্ষা এক সূত্রে বাঁধা। যে মুহুর্তে কোনও একটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে সে মুহূর্তে আরেকটির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়তে বাধ্য।
সে যে আসবে না এর থেকে বড় সত্য আর কিছুই নেই; তার না-আসার ফলে অপেক্ষার যে দীর্ঘ টানেল তৈরি হবে সেটিই একমাত্র সত্য।
কিন্তু গানটি শেষ হবার পর, গানটির প্রতিটি শব্দ বারবার পাঠ করার পর সেই প্রশ্ন তাড়া করে ফিরতে বাধ্য – এই ‘সে’ কে? ‘সে’ কি ‘আত্ম’র বহির্দেশে অবস্থান করা কোনও অংশ? না কি সে ‘অপেক্ষারত’ সেলফের অবিচ্ছেদ্য অংশ?
এই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন’ও গুঁড়ি মেরে ঢুকে পড়তে চাইবে – এই ‘সে’ কি আসলে ‘আমি’র সচেতন নির্মাণ? ‘আমি’ কি এই ‘সে’ কে নির্মাণ করে প্রহরের পর প্রহর এক আলো-অন্ধকারের মধ্যে নিজেকে আবর্তিত করে চলে? এই আবর্তনের মধ্যেই কি তার বেঁচে থাকার মানে ও রহস্য লুকিয়ে থাকে?
গানটির মধ্যে অপূর্ণতার হাহাকার আছে, অথচ আপাতভাবে সমস্তই পূর্ণ। শিরীষের শাখা পূর্ণ। কিন্তু ‘সে’ আসেনি, এই অপূর্ণতাটুকুই হয়তো অপেক্ষার প্রাণশক্তি। এই অপূর্ণতা আর অপেক্ষা একে অপরকে পুষ্টতা দিয়ে চলেছে অবিরাম।
কিন্তু এই হাওয়া এই শিরীষ এই ফাগুন কি সত্যিই ‘হাওয়া শিরীষ আর ফাগুন’? যে দ্বিবাচনিকতার সৃষ্টি হয়েছে কবিতাটি জুড়ে তা আসলে কবির তৈরি দ্বিবাচনিকতা। এই হাওয়া এই শিরীষ কবির সৃষ্টি। তিনিই শিরীষের ডালে ফুল ফুটিয়ে প্রশ্ন করবার অবকাশ তৈরি করছেন, বা বলা যেতে পারে প্রশ্ন করবার জন্যই এই আয়োজন। সমস্ত গান জুড়ে কবিই ভূমিকা বদল করে করে চলেছেন। এবং এখানে আরেকটি মাত্রাও যুক্ত হতে পারে, ভরা শিরীষের কাছে কবির করা প্রশ্ন ততটা অস্বাভাবিক ও অসঙ্গত লাগে না যতটা অস্বাভাবিক ফুল্ল-শিরীষের ‘তার’ আসার অন্বেষণ। তা হলে সে কি ‘আপাত অর্থে পূর্ণ’ হয়েও অপূর্ণ? না কি কোনও এক দুর্জ্ঞেয় ‘তার’ আগমন ব্যতিত সব পূর্ণতা খণ্ড-পূর্ণতা? আত্মার একটি টুকরো যেন হাতড়ে চলেছে আরেকটি টুকরো’কে। অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে বারবার, কিন্তু সে সেই আশ্চর্য আলোর ইশারা এখনও বিসর্জন দেয়নি, তাকে পাবে না জেনেও দেয়নি।
শিরীষের দোল-লাগা এই গানটির সঙ্গে সেদিন এসে মিশে যেতে চাইছিল আরেকটি গান, সেখানে শিরীষ দর্শক, শিহরিত দর্শক। কিন্তু শিরীষের সেই শিহরণ ছাড়া গানটি যেন পূর্ণতা পাবে না কিছুতেই।
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘হে মাধবী, দ্বিধা কেন, আসিবে কি ফিরিবে কি –‘। জগতজোড়া যে আনন্দযজ্ঞ সেখানে মাধবী ফুটে উঠতে চাইছে।
প্রতিটি প্রকাশের ভেতর তবে কি রয়ে যায় ভীরুতা, এমন এক দ্বিধা যা প্রকাশ্যকে আড়াল করে চলে প্রতিনিয়ত? কিন্তু এই প্রকাশের সবটুকু কি মাধবীর নিজস্ব? এই বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে রয়েছে সেই রহস্য যা প্রতিক্ষণ মাধবীকে ডাক পাঠিয়ে চলেছে।
মাধবীর সঙ্গে সঙ্গে বকুল চামেলি করবী সেই ডাক শুনেছে, তাদের সংশয় দূর হয়েছে, শুধু মাধবী…শুধু মাধবীর সংশয় যেন কিছুতেই দূর হতে চায় না আর। প্রাণ থেকে প্রাণে, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি’তে এভাবেই হয়তো পরিবর্তিত হয়ে যায় প্রকাশের ধারা। এই গানটি আমার কাছে এককের এক পরম মূর্তি তুলে ধরে। সেই একক, যে বহুর মাঝেও নিজের দ্বিধা দ্বন্দ্ব সংশয় নিয়ে উজ্জ্বল ও স্বতন্ত্র। লক্ষ্য করার বিষয়, গানটিতে মাধবীর ফুটে ওঠার সংশয় ঘনিয়ে রয়েছে, ছেয়ে রয়েছে এক অসামান্য দ্বিধা। কিন্তু ‘মাধবী’ শব্দটি মাত্র একবার ব্যবহৃত হয়েছে। মাধবীর ফুটে ওঠা কবির কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার ফুটে ওঠার পূর্ব মুহূর্তটুকু।
কিন্তু শুধুই কি তাই? গানটির কাছে সেদিন বসে থেকে বুঝেছিলাম এই গানে শিরীষের শিহরণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। শিরীষের ‘শিহরি’ ওঠা শিহরণ জাগিয়ে তুলেছে, একটা বিদুৎ-ঝলক মাটির দিকে নেমে গেছে, মাটির ভেতর ঢুকে ঘুরে বেড়িয়েছে বহুক্ষণ।
শুধু মনে হয়েছে শিরীষ কাকে দেখে শিহরিত হয়ে উঠল? প্রাইমডিয়্যাল স্যুপের মধ্যে ঢুকে পড়ছে ‘প্রাণ’, শিহরিত হয়ে পড়ছে বস্তুপুঞ্জ।
সেই শিহরণটুকু সে বহন করে নিয়ে যাবে কোটি কোটি বছর ধরে, নিজেকে সৃষ্টি করবে, নিজের চারদিকে পাক খেয়ে ঘুরবে কোঁচবকের মতো।
প্রাণ আসলে ওই শিহরণ, যে শিহরণের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠছে শিরীষ।
প্রেম’ও তাই, ওই শিহরণটুকুই প্রেম।
মাধবীর দ্বিধা চোখ মেলে সেই বিশ্বজোড়া প্রাণের দিকে, প্রেমের দিকে তাকানোর দ্বিধা।
এই দ্বিধার উপর দিয়েই বারবার ছায়া ফেলে উড়ে যায় কোঁচবক, বৃষ্টির দুপুরে।
Leave a reply