‘যে ছায়ারে ধরব বলে…’
‘কবিতা’ শব্দটার মধ্যেই বুঝি ঢেউ আছে! উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই মনের তারে তারে দোলা লাগে। সীমার মাঝেই যেন অসীমের নাগাল পেতে চায় মন,দু’দণ্ড বিশ্রাম চায়, আশ্রয় খোঁজে কবিতার নিভৃতির কাছে।
যদিও কবিতা চরাচর বিচ্ছিন্ন নয়, চারপাশের চোখে পড়া দৃশ্য, কানে শোনা বিষয় থেকেই জেগে ওঠে তার মৌল উপাদানটি। গৃহস্থের লাউ মাচায় ঝুলে থাকা ছোট্ট সাদা ফুল দেখেও মন বলে ওঠে, “যা গিয়ে ওই উঠোনে তোর দাঁড়া,/ ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল সন্ধ্যার বাতাসে।…ফুরয় না তার যাওয়া, ফুরয় না তার আসা,/ ফুরয় না সেই একগুঁয়েটার দুরন্ত পিপাসা।” কবির মনের চোখে দেখা এই লাউ ফুলের দোলাচল কখন যেন আমার হৃদস্পন্দনের সঙ্গে মিলে যায়। অনায়াসেই তখন একটা পংক্তি নিছক চোখে দেখার সীমানা ছাড়িয়ে সুদূর অনন্তের পথে যাত্রা শুরু করে। মাত্র কয়েকটা শব্দের অনুরণন পাঠকের মনে সুর-তাল-লয়ের বিস্তার ঘটাতে থাকে। প্রাত্যহিকতার গ্লানি মুছে সেই জাদুকরী পংক্তিগুলিই জীবনে কখন যেন হয়ে ওঠে মুক্তির মেঘমল্লার। চোখ-মন অথবা হৃদয়ের দাবি মেটাতে আমরা যেমন বেড়াতে যাই সমুদ্রে,পাহাড়ে। বসতে চাই নদীর পাশে,আনমনে হেঁটে যাই দিগন্তরেখার দিকে। কবিতাও তেমনই এক দিগন্তবিস্তারী আলোকরেখার পথে নিয়ে যেতে চায় পাঠককে, যার অমৃত স্বাদ পেলে মানুষ আর ফিরতে পারে না তার কাছ থেকে।অক্ষরকে স্পর্শ করে সে অসীমের স্পর্শ পায়।
যখন যন্ত্রণার ঢেউগুলি আছড়ে পড়ে হৃদয়ে, জীবনের অনুচ্চারিত শব্দেরা হঠাৎ উচ্চকিত হয়ে উঠতে চায়, যখন আমার আমিকে ভেঙেচুরে দুমড়েমুচড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছা করে তখনই পায়ে পায়ে চলে আসি কবিতার কাছে। তার হাত ছুঁয়ে বসে থাকি আজীবন অনুচ্চারিত শব্দদের স্পর্শ পাই বলে। মনের ভেতরে তোলপাড় চলে। অতর্কিতে ডানা মেলে শব্দেরা, কবিতার জন্ম হয়। যদিও সে যা জানাতে চায় তার অনেকটাই অনুচ্চারিত থেকে যায়। ভাবনার সংকেত থেকে বুঝে নিতে হয় সেই না বলা কথাটি। ছোট্ট একটা শব্দ বা দুটো পংক্তির মাঝখানের কুয়াশা প্রান্তরে লুকিয়ে থাকে তার আত্মরূপ,লুকনো স্বরূপ।
একটু চোখ মেললেই দেখি প্রকৃতি তার অশ্রুত কবিতাটি লিখে রেখে গেছে ঘন নীল রঙের ফুলের পাপড়িতে একবিন্দু সোনালি অক্ষরে। যা বাস্তবের পৃথিবীর তেমন কোনো কাজে লাগে না, কেবল সৃষ্টির অরূপ প্রবাহকে নিয়ে চলে সুন্দরের দিকে। প্রাণের পরে বসন্তবাতাসের এই চলে যাওয়াটাই বুঝি কবিতার ছন্দ! এই অমৃত ছন্দে লেখা কবিতা কখন যেন আমারও হাত ধরে, আনন্দ-বেদনা-আশা-নিরাশার ছায়াপথে আলো দেখায়। সময়ের গণ্ডি ভেঙে সহজ পরিভ্রমণের পথ খুঁজে দেয়, আবিষ্কার করতে শেখায় অনাবিস্কৃত এক নীহারিকাকে, কবিতা যার নাম।
এক নিভে যেতে চাওয়া গোধূলির আধো অন্ধকারে শুনেছিলাম দূরাগত কয়েকটি পংক্তি, “যেথা নিখিলের সাধনা পূজালোক করে রচনা/সেথায় আমিও ধরিব একটি জ্যোতির রেখা…”, তখন মনে হয়েছিল কেউ যেন পরমাত্মীয়ের মত হাত ধরে আমাকে জ্যোতির্ময় এক পথের দিকে টেনে নিয়ে চলেছেন। আস্তে আস্তে সরে গিয়েছিল অন্ধকার। ওই অমোঘ পংক্তির বারংবার উচ্চারণে মনে এক অদ্ভুত শক্তি ফিরে পেয়েছিলাম। এভাবেই কবিতার মাত্র একটি পংক্তিও কখনো কখনো আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে জীবনের পথপরিক্রমায়।
কতবার একা একা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সঙ্গী হয়েছে জীবনানন্দের কয়েকটি লাইন “আলো অন্ধকারে যাই মাথার ভিতর/স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে;/স্বপ্ন নয় -শান্তি নয়–ভালোবাসা নয়,/হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;/আমি তারে পারিনা এড়াতে,/সে আমার হাত রাখে হাতে;” বোঝা এবং না বুঝতে পারার মধ্যে দোলায়িত এই ‘বোধ’ আমাকে অন্যের থেকে আলাদা করেছে। কতবার দেখেছি প্রাত্যহিক অজস্র কাজের মধ্যে থেকেও নিজের অজান্তেই নীরবে উচ্চারণ করে চলেছি এই শব্দগুলো। উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই এক দ্বান্দ্বিক অনুভূতিতে জারিত হয়েছে আমার মন ও মনন ।
‘আমাকে তুই আনলি কেন ফিরিয়ে নে’ এই কবিতা যখন প্রথম পড়ি তখন নিজের সমগ্র অস্তিত্বকে মাতৃজঠরের অন্ধকারের মধ্যে অনুভব করেছিলাম। অনুভব করেছিলাম এই বিপুল বিশ্বে নিজের অস্তিত্বের অসহায়তাকে। বহুবার পতনোন্মুখ মুহূর্তে সঙ্গী হয়েছে এই পংক্তিগুলি। নীরবে উচ্চারণ করেছি,”আমি যখন অনঙ্গ অন্ধকারের হাত দেখি না, পা দেখি না,/তখন তোর জরায় ভর করে আমায় কোথায় নিয়ে এলি।…তবে হয়তো মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে…আমাকে তুই আনলি কেন ফিরিয়ে নে।”
কবিতা কি শুধুই অন্তর্গত যন্ত্রণার সঞ্জীবনী হয়ে থেকেছে আমার কাছে, তা তো নয়। উজ্জ্বল স্মৃতির ভেতরে বহুবার দেখেছি তার ‘অশ্রু ঝলোমলো’ মুখ।
বরাবরই কবিতা এক জলজ আয়না হয়ে আমার সামনে এসেছে। কখনো তার কাকচক্ষু জলে দেখেছি নিজেরই মুখচ্ছবি। কখনো তা ভেঙেচুরে গেছে। জীবনের প্রাত্যহিকতার মধ্যে পাওয়া নানা অনুভূতি প্রকাশের তাগিদে আকুলি বিকুলি করেছে মনের ভেতরে। যে কথা উচ্চারণে স্পষ্ট হয়না সেই অস্পষ্ট অনুভূতি কখনো রূপকে বা প্রতীকে সেজে উঠেছে। কখনো সব সাজসজ্জা খুলে ফেলে আপনার আবেগে আপনি প্রকাশিত হয়েছে। এই না বলতে পারা কথাগুলি কবিতার রূপ নিয়ে নিজেকে আবিস্কারের নেশা জাগিয়ে তোলে মনের ভেতর। ‘আনা কারেনিনা’র লেভিনের মত কবিও বলেন, ‘আমি কে তা না জেনে আমি বাঁচতে পারি না’ সারাটা জীবন জুড়েই তাই চলে এই আত্মানুসন্ধান। এই জানতে চাওয়া আর তার সঙ্গে সঙ্গেই জগৎ, জীবন আর ঈশ্বরকে জানবার বাসনাও জেগে ওঠে। শেষে রূপনারায়ণের কূলে জেগে উঠে কবি দেখেন যে, কে আমি?তার উত্তর মেলে না। প্রথম দিনের সূর্য সে উত্তর দেয়না, জীবনের শেষ সূর্যোদয়টিও থাকে নিরুত্তর।তবুও এই জিজ্ঞাসা থাকে। এই জিজ্ঞাসাই জীবনকে উন্মোচিত করতে থাকে।জাগতিক সব কিছুকেই সে অন্যভাবে দেখতে শেখায়। রক্তমাংসের কবির শরীরে জেগে ওঠে তৃতীয় নয়ন। কবি তাই দ্রষ্টা। এই তৃতীয় নয়নের দৃষ্টিই ক্রমাগত কবিকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র করতে থাকে। নিঃশব্দসঞ্চারী অনুভূতির শব্দরূপ তৈরিতে তখন ব্যাকুল হয়ে ওঠে মন। মহাজাগতিক অচেনা গন্ধে ভরে ওঠে তার চিরচেনা চরাচর। সাদাকালো শব্দ থেকে উৎসারিত হয় বিচিত্র সব বর্ণ-গন্ধ। এক অতলান্ত অনুভূতি নিঃশব্দে মনের গহনে ঢুকে পড়ে একটা চিত্রনাট্য তৈরি করে যা হয়ে ওঠে তারই কবিতার চিত্রভাষা। এই চিত্রকল্পে ঢুকে পড়ে চেনা অচেনা দেখা-অদেখা কতকিছুই।
অবচেতনে ঘুমিয়ে থাকা কত অনুভূতি জারিত হতে থাকে এই অতীন্দ্রিয় বোধের সঙ্গে। এর ক্রমিক দহন উষ্ণতা দেয় কবির আবিস্কৃত শব্দকে। কবির সঙ্গে কবিতার পরাগমিলন হয়। নিজের শব্দ, বর্ণ বাক্যের মধ্যে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন কবি। সদ্য জন্ম নেওয়া কবিতায় প্রকাশিত হয় তার বোধের অনাবৃত শব্দরূপটি। জগৎসংসার যেন একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে পথ করে দেয় কবিকে। চোখের সামনের দৃশ্যমানতা কমে অন্তর্লীন এক চেতনায় বুক ভরে ওঠে। তাই একজন কবির কাছে একটা কবিতার জন্ম দেওয়ার চেয়ে আনন্দের আর কিছুই থাকতে পারে না। কবির তখন ঈশ্বরত্ব প্রাপ্তি হয়। কবিতার নিজস্ব ভুবনে কবি অবলোকিতেশ্বর হয়ে ওঠেন।
Leave a reply