সারা জীবন আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করে থাকে?
সারা জীবন আমাদের জন্য কে অপেক্ষা করে থাকে?
সারা জীবন আমাদের জন্য একটি বাঁশি অপেক্ষা করে থাকে, নির্জন বনের গভীরে গুহার মধ্যে, যে ঊষর প্রান্তরে পা পড়ল এইমাত্র, হয়তো সেখানেও আমার জন্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে একটি বাঁশি।
রবীন্দ্রনাথের এই গানটির কাছে আগে যতবার এসে বসেছি ততবার মনে হয়েছে এ গান ‘সর্বনাশের কূল পেরিয়ে’ শান্ত হয়ে যাওয়া এক মানুষের গান। প্রবল জলোচ্ছ্বাস এসেছিল একদিন, উথালপাতাল করে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে; এক নিঝুম প্রান্তরে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে সেই মানুষটিকে। সে মানুষের আজ আর কোনও ব্যক্তি-বিশেষের জন্য অপেক্ষা নেই, সে মেনে নিয়েছে প্লাবন ও প্লাবন-পরবর্তী পরিস্থিতি। সে মেনে নিয়েছে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া জীবনের এই মুখটিকে; হেমন্তের নির্জন রাত্রির মতো জীবনানন্দের খোঁড়া-শালিখের বেঁচে থাকার মতো ভোররাত্রে বৈষ্ণবীর মতো শান্ত হয়ে এসেছে তার জীবন। কারণ গানটির মধ্যে এমন এক যুক্তিকাঠামো আছে, অন্তত একটি সময় পর্যন্ত যাকে তেমনই মনে হত, যার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হওয়া স্বাভাবিক দীর্ঘ ঘণ্টাধ্বনি পাহাড়ে মিলিয়ে যাবার পর একটি মানুষ তার কিছুটা নিরাসক্ত ‘অভিমান’ ফেলে রেখে যাচ্ছে গানটির শরীরে।
আজ আর তেমন মনে হয় না, এই মনে না-হওয়ার পিছনে তেমন কোনও কারণ নেই। কিন্তু এই গানটির কাছে আমি এখন বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারি না, চোখ ঝলসে যায়… পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলে ওঠে। এখন দেখি, যত দিন যায় তত বেশি তীব্র হয়ে ওঠে সেই দৃশ্য – মহাপ্লাবনের মতো একটা প্রলয় ঘটে গেছে, অন্ধকার নদী বয়ে যাচ্ছে। তীরে কেউ নেই, কিছু নেই… এমনকি বহুবার দেখবার চেষ্টা করেছি যদি দু-একটি বিপন্ন গাছের সন্ধান পাওয়া যায়… তাও নেই। শুধু ভয়াল অন্ধকার স্রোত… এই স্বপ্ন, না-স্বপ্নের মধ্যে শুধু দেখি ভেসে যাওয়া এক মানুষ। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া মুখ… চিত্রনাট্যের মতো অবিকল ঘটে যেতে থাকে ঘটনাগুলি। কোনও ব্যক্তি মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলবার কোনও দায় নেই আমার আজ, শুধু এই কথাটুকু বলে যাওয়া ছাড়া যে সে মানুষটি এক সময়ে স্রোত থেকে একটু মুখ তোলে… উঠে পড়ে এক টিলার উপর। অন্ধকার টিলা অন্ধকার সিংভূম। কেন সিংভূম কেন টিলা তার কোনও ব্যাখ্যা নেই… এবং সেই টিলাটির উপর অপেক্ষা করে রয়েছে একটি বাঁশি।
অঙ্গারবর্ণ এক মানুষ, স্রোতে ভেসে যাওয়া এক মানুষ, ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া এক মানুষ তারপর বাঁশির কানে কানে কথা বলতে থাকে… বাঁশি ও ব্যক্তির মধ্যে আর কিছু নেই… এমনকি বাতাসটুকু পর্যন্ত নেই। কারণ সে মানুষ ও বাঁশির মধ্যে চূড়ান্ত ও সর্বাগ্রাসী এক শূন্যতা না-থাকলে মানুষটির অতি-অস্ফুট কথা প্রবেশ করতে পারবে না বাঁশির বুকে। বাতাস নেই, চূড়ান্ত শূন্যতা অথচ বাঁশিটি শেষ পর্যন্ত মৃদু বেজে উঠছে… এই রহস্যের সমাধানের অন্তে পৌঁছানো আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠছে দিন দিন।
গানটির প্রথম লাইনটিকে বহু আগে মনে হত এক ‘সচেতন বিবৃতি’… assertion… এখন জীবনের এই বিশেষ সময়ে দাঁড়িয়ে এই কথাটিকে মনে হয় মরিয়া এক উচ্চারণ। কেউ যেন হাহাকার করা চরাচর জুড়ে রেখে যেতে চাইছে শুধু এটুকু উচ্চারণ… তার এই উচ্চারণ শ্রোতা-নিরপেক্ষ, সে আজ আর আকাঙ্খা করে না যে এই কথাগুলির কাছে কেউ এসে বসবে একদিন অথবা অশ্রুমোচন করবে। এই কথাগুলি বলে যাওয়াই তার নিয়তি… তাকে এই ভূমিকা পালন করে যেতে হবে।
২
আমার একটি কথা বাঁশি জানে, বাঁশিই জানে।।
ভরে রইল বুকের তলা, কারো কাছে হয় নি বলা,
কেবল বলে গেলেম বাঁশির কানে কানে।।
আমার চোখে ঘুম ছিল না গভীর রাতে,
চেয়ে ছিলেম চেয়ে থাকা তারার সাথে।
এমনি গেল সারা রাতি, পাই নি আমার জাগার সাথি –
বাঁশিটিরে জাগিয়ে গেলেম গানে গানে।।
গানটির প্রথম লাইনের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সেই উচ্চারণ – বাঁশি জানে, বাঁশিই জানে। শুধুমাত্র বাঁশির জানা assertion হিসাবে গণ্য করতে ইচ্ছা করে না, বরং ভাবি এক মরিয়া মানুষ অন্তিম-শ্বাস নেবার মতো বলে যাচ্ছে – আর কেউ না, আর কেউ না… শুধুমাত্র বাঁশি। ধুলো থেকে ঘাসের শীর্ষ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে তার এই কথা।
প্রথম লাইনের পরের দুটি লাইন প্রথম লাইনটিরই কিছুটা প্রসারণ, আর অন্য কোনও কানে এই গান ঢেলে দেবার ক্ষণ আসেনি, তাই বাঁশিই যে শেষ ও একমাত্র শ্রোতা হবে সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
চতুর্থ লাইনে এসে বাঁশি গান ও অস্ফুটে বলে যাওয়া কথার বাইরে আরেকটি কথাও পাওয়া গেল – ‘আমার চোখে ঘুম ছিল না গভীর রাতে’। কিন্তু শুধু সেই মানুষটির চোখেই ঘুম ছিল না তা নয়; একই রকম ভাবে নিদ্রাহীন ছিল তারা’ও। সমস্ত মহাজগত যেন অপেক্ষা করছে, নিদ্রাহীন অপেক্ষা করে চলেছে…এ অপেক্ষার কোনও শেষ নেই।
শেষ দু’লাইনে কবি জানিয়ে দিয়েছেন, এভাবেই সারা রাত কেটে গেছে, জাগার যে কোনও সাথি থাকবে না সেটা অনেকাংশে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল প্রথম লাইনেই। কারণ সেক্ষেত্রে কথাটি শুধু বাঁশির কান খুঁজে নিত না। তবে শেষের আগের লাইনে অত্যাশ্চর্য একটি শব্দ রয়েছে, যেটি গানটির ক্ষেত্রে ‘পিভিট্যাল’ ভূমিকা পালন করেছে। শব্দটি হল ‘এমনি’। রাত জাগার সমস্ত ব্যর্থতা এসে আশ্রয় নিয়েছে ওই শব্দটিতে।
গানটির মধ্যে লুকিয়ে থাকা বাণীর কারুকাজ শেষ লাইনে এসে শেষ হল না, বরং শুরু হল বলা যায়। সেখান থেকে শুরু হল আরেকটি সফর, কনসাসনেসের সফর।
ব্যক্তি ‘আমি’ বাঁশিটিকে জাগিয়ে দিয়েছে গানে গানে – এটি সরলরৈখিকভাবে মেনে নিলে এটিও মেনে নিতে হয় যে বাঁশিটির ভিতর সুপ্ত হয়ে ছিল এমন এক অবস্থা যা গানের দ্বারা জাগরিত হল এই মাত্র। সেক্ষেত্রে এটিও মেনে নিতে হয়, বাঁশিটির মধ্যে সুপ্ত হয়ে থাকা ‘কনসাসনেস’ গানের দ্বারা জাগরিত হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল, একটি রাতের গান শুধুমাত্র সমাপতন…এই সংযোগ একদিন ঘটতই। এই সংযোগের মাধ্যম যে ‘গান’ হবে সেটিও পূর্ব-নির্ধারিত ছিল; জাগরণের যে মহা-আয়োজন তা শুধুমাত্র সংযোগটিকে স্থাপন করবার জন্য। বাঁশি ও ব্যক্তি ‘আমি’ – আসলে দু’জনই এই সংযোগের জন্য উণ্মুখ হয়ে ছিল। গানের মধ্য দিয়ে তা ঘটে গেল আজ।
এরপর আরেকটি ‘কূট প্রশ্ন’ উঠতেও পারে; বাঁশিটি ব্যক্তি’র কাছে ‘দ্বিতীয়’ পছন্দের পথ বেয়ে এসেছে – এমনটা মনে করার অধিকার রয়েছে কারও কারও। কারণ ব্যক্তি প্রথমত রাত ‘জাগার সাথি’কেই চেয়েছিল। এই যুক্তির পথ ধরে মনে করবার যথেষ্ঠ কারণ রয়ে গেল যে, তারা’র সঙ্গ নয়…’ব্যক্তি’ তীব্রভাবে চেয়েছিল এক মানুষের সঙ্গ (সাথি)। এবার একটি কাল্পনিক বাস্তবতার সন্ধান করা যাক; ব্যক্তি যদি রাত জাগার সাথি’কে পেত তবে কি সে বাঁশিটিকে গানে গানে জাগিয়ে দেবার অবস্থায় পৌঁছাতে পারত?
এই ঘূর্ণির ভিতর দাঁড়িয়ে মনে হয়, এ গান যৌনতার ‘রক্তমাংস’কে অতিক্রম করে যৌনতার ‘সুরের’ গান। চমৎকারিত্ব লুকিয়ে রয়েছে, তীব্র যৌনতার বোধ’কে অস্বীকার না-করার মধ্যে। এমন অকুণ্ঠ স্বীকার আমাদের চোখ এড়িয়ে যায় অনবরত; অথচ গানটির রচয়িতা কী সাবলীলভাবে জানিয়ে দিলেন, শুধু যে গভীর রাতে ঘুম ছিল না তাই নয়, অপেক্ষা ছিল রাত জাগার সাথিকে পাবারও।
এখানে দাঁড়িয়ে, এক তারা-ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি দেখতে পাই এক মহাজাগতিক পাখি, তীব্র কাম-তাড়িত মহাজাগতিক পাখি ডানা ঝাপটে চলেছে। এই মহাবিশ্বে সে একা, তার কোনও সঙ্গী বা সঙ্গিনী নেই; শুধু তার ডানা ঝাপটে চলার প্রক্রিয়াটি রয়েছে আকাশের কোণে কোণে।
কিন্তু এই সত্যটি কি সেও জানে না?
জানে এবং জানে বলেই তার অসহায়তা আরও বেশি। জানে বলেই এক রুদ্ধতার সামনে এসে তাকে দাঁড়াতে হয় প্রতিদিন প্রতিরাত। জানে বলেই ‘বাঁশি’ তার কাছে দ্বিতীয় সম্ভাবনার পথ বেয়ে আসা অরূপরতন নয়, সেটিই তার প্রথম ও একমাত্র ‘সম্ভাবনা’র প্রকাশ। অনিবার্য সে পথেই তাকে হেঁটে যেতে হয় প্রতিটি রাত।
আসলে এই বাঁশি কোনও ‘বাহ্যিক’ উপাদান নয়, এ বাঁশি ‘ব্যক্তি’র সত্তার একটি অংশ। ‘বাঁশি’ ‘গান’ ‘তারা’ ইত্যাদি শব্দের উপস্থিতির কারণে যারা গানটিকে দেহাতীত প্রেমের প্রকাশ বলে দেখলেন তাদের নিশ্চয় সেভাবে দেখার অধিকার আছে; আমি শুধু দেখি নিজেকে ছিন্নভিন্ন করে রক্তে ভেসে যাওয়া উড়ন্ত কার্পেটে শরীর মেলে শুয়ে আছে এক মহা-জাগতিক পাখি।
যে মিলন সম্ভাবনাতীত এবার তা সম্পন্ন হবে, পাখি তার মৃত্যুসমান ‘অবরুদ্ধ’ শরীরের গান ঢেলে দেবে বাঁশির কানে কানে। বাঁশির জেগে ওঠা সেই রুদ্ধ-সংগীতের জেগে ওঠা।
আনন্দ অথবা বিষাদের কথা হল এই যে, গানটির পাঠ শেষ করার পর কী এক অজ্ঞাত কারণে যেন মনে হয়, এই বাঁশি’কে জাগিয়ে দেবার পদ্ধতি শুধু একটি দিনের নয়… ঠিক পরের রাত্রে পাখি আবার ফিরে আসবে বাঁশিটিকে জাগিয়ে দিতে… ক্যামোফ্লাজ করা এই ‘আত্মধ্বংসের’ গানের কোনও শেষ নেই। (ক্রমশ)
Leave a reply