মদত চাহাতি হৈ
এ হাওয়া কি বেটি
যশোদা কি হামজিনস্
রাধা কি বেটি
পয়মবর কি উম্মত
জুলেখা কি বেটি
জিন্হে নাজ হৈ হিন্দ্
পার বো কাহা হৈ
কাহা হৈ কাহা
হৈ কাহা হৈ
— সাহির লুধিয়ানভি
সেলুলয়েড যুগের ভারতের প্রেম-বিরহের রাগ ধরা রয়েছে উর্দু-হিন্দি কবি গীতিকারদের শায়রি, গজল, নাজম, গীতের মধ্যে। গান আর কবিতার ফারাক ভারতীয় সাহিত্যে কোনওকালেই ছিল না। কত মহান কবিতাকে গান বলে আমরা চিনেছি, আর মহান গানকে কবিতা বলে। হিন্দি সিনেমার দৌলতে আমাদের উর্দু–হিন্দি কবিরা দেশ জোড়া তো বটেই বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন। বাংলা বা অন্যান্য ভারতীয় সাহিত্যের ক্ষেত্রে কবি ও গীতিকার আলাদা মানুষ। সারা ভারত জুড়ে হিন্দি সিনেমার দৌলতে হিন্দি-উর্দু কবিদের এমনই পরিগ্রহণ জনজীবনে ঘটেছে যে তাঁরা বিশেষভাবে লোকাদুরে (পপুলার) হয়েছেন। ভারতীয় সাহিত্যের সাধারণ নির্ণায়ক চিহ্ন হয়ে উঠেছেন এই সমস্ত কবি-গীতিকাররা। সাহির লুধিয়ানভি তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর কত নাজম, কত গজল শ্রেণী নিরপেক্ষভাবেই মানুষের মুখে মুখে ফেরে এখনও।
পাকিস্তানে থাকেননি সাহির, ১৯৪৯ এ লাফিয়ে এক ছুটে যেন চলে এসেছিলেন পাঞ্জাবে, সেখান থেকে দিল্লী, দিল্লী থেকে বম্বে। প্রকাশ পন্ডিত লিখেছিলেন, লাহোরে জীবিকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রায় এক ভাষা, এক ধর্ম, এক সংস্কৃতির দেশে তাঁর মন টিকছিল না। স্বাধীনতা ছিল না লেখার। মন খারাপ করছিল এদেশের বন্ধুদের জন্য। দেশভাগ হওয়ার পর লাহোরে তাঁর সম্পাদিত ‘সবেরা’ পত্রিকায় পাকিস্তান সরকারের সমালোচনা করা কমিউনিজম প্রসঙ্গে লেখালেখি করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।
ভারতীয় প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। বম্বেতে জীবন কেটেছে কৃষণ চন্দর, জাভেদ আখতারদের প্রতিবেশে। ফৈজ আহমেদ ফৈজের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন তিনি। শ্রমিক কৃষকের কথা বারবার তাঁর কবিতায় এসেছে। প্রগতিশীল আন্দোলনের ভাষা তৈরিতেও শরিক হয়েছে তাঁর কবিতা। প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনের সব থেকে গুরুত্বের দিক হল, এই আন্দোলন যেকোনও ভাষার সাহিত্যে নতুন শব্দ, বিষয় ও স্বর সংযোজন করেছে। প্রথাগত সাহিত্যের ‘অবহেলিত’, সাহিত্যে ভাষা পেয়েছে। “এ কারখানো মেঁ লোহে কা শোরি-গুল জিসমেঁ/ হৈ দফন লাখোঁ গরীবোঁ কো রুহ কা নাগমা”-র কবি ক্রমে ক্রমে বম্বেতে গীতিকার হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকলে, ভীত হন কৈফি আজমি। সাহিরও বুঝেছিলেন যে তিনি কম কবি ও বেশি গীতিকার হয়ে উঠছেন। কৈফি আজমি মেনে নিতে পারেননি সাহিরের এই পরিবর্তন, আক্ষেপ করে বলেছিলেন সাহিরের কাছে এখন সব আছে, তিনি চাইলে প্রযোজক বা পরিচালকও হয়ে উঠতে পারেন।
সাহিরদের যৌবন আর চেতনা তৈরি হচ্ছে এমন এক সময়ে যেখানে নিপীড়িতের লড়াই আর আখ্যান নতুন রাজনৈতিক ভাষা তৈরি করছে, সময়ের মনকে শাসন করছে, অন্যদিকে গান্ধী-হত্যা ও গান্ধীর মতাদর্শের ক্রম প্রাসঙ্গিকতা সাহিত্য-দর্শনে, উপনিবেশ পরবর্তীকালে নেহেরুর অর্থনৈতিক মডেলে তৈরি হবে মাদার ইন্ডিয়া প্রমুখ সিনেমার মধ্য দিয়ে। দেশ জোড়া বেকারত্ব, দারিদ্র ও খাদ্য সংকট ক্রমশ প্রাসঙ্গিক করে তুলবে মার্ক্সিয় দর্শনকে। এই সময়ের চরিত্র ধরেই দেখব যৌবন অতিবাহিত সাহির দেখবেন তাঁরই যৌবনের প্রসারিত সময়কে যখন দেশ জুড়ে হতাশ যুবক কখনও প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে, কখনও আংরি ইয়ং ম্যান, কখনও বা হাংরি কবি। প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনের কেন্দ্র ক্রমশ বিস্তৃত হবে দেশের নানা ভাষার মধ্যে। কবিতা, রাজনীতি আর দর্শন নির্মাণ করবে সময়ের চেতনা। অন্য অনেক চিন্তাশীল মানুষের মতো সাহিরও টের পেয়েছিলেন যে স্বাধীন দেশের ভিতরের শূন্যতা। স্বাধীনতা তো একটি নতুন চ্যালেঞ্জও বটে, সেই প্রজন্মের সবার কাছেই তা ছিল একটি নতুন অভিজ্ঞতা। স্বাধীনতা পূর্ব দেশের স্বপ্ন আর স্বাধীনতা পরবর্তী ঠোক্কর খাওয়া বাস্তবতা, সেই প্রজন্মকে হতাশাগ্রস্ত করেছে। কি জোরালো ভাষায়, কি তীব্র যন্ত্রণায় সাহির লিখেছিলেন তাঁর জাতি (নেশন) ও সমাজের কথা, “জালা দো জালা দো জালা/ দো ইসে ফুক ডালো এ দুনিয়া/ মেরে সামনে সে/ হাটালো এ দুনিয়া/ তুমহারি হৈ তুম হি/ সাম্ভালো এ দুনিয়া/ এ দুনিয়া আগার মিল/ ভি যায়ে তো কিয়া হৈ ”।
সময়ের অসহায়তা কবিকেও নিঃসঙ্গ করে, সাহিরও নিঃসঙ্গবোধ করেছিলেন, বারবার মন হার মেনেছে, সেই নিঃসঙ্গতার বোধ কবিতা হয়েছে। সাহিরের ভাব জগতের গভীর প্রকাশ যেন গুরু দত্তের প্যাসার লিরিকের মধ্যে। গুরু দত্তের প্যাসা (১৯৫৭) ছবির গীতিকার সাহির গানের মধ্য দিয়ে অস্তিবাদী সংকট, সমাজ কাঠামো বিশ্লেষণের মার্ক্সীয় পদ্ধতি গ্রহণ করেন। এই সিনেমা তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ তিনি মনে করতেন গুরু দত্তই প্রথম পরিচালক যিনি গান ও কবিতার ফর্ম নয় বিষয়বস্তুর দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সমাজ কাঠামো আর আবেগের প্রকাশ একসঙ্গে মিশে গেছে। গুরু দত্তের প্যাসারদর্শন মাত্রা পেয়েছে সাহিরের কবিতার দর্শনে। একজন বেশ্যার জীবন সমাজবাস্তবতা ব্যাখ্যার রূপক হয়ে উঠেছে। সাহিরের সমস্ত নাজম্ বা গজলের উৎস তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। একটি নাজমে তিনি বলেওছিলেন, অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তিনি যা পেয়েছেন কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি তা ফেরত দিচ্ছেন। সিনেমার কন্টেন্ট দেখে তিনি গান লেখেননি, অন্য অনেকের মতো। তাঁর ব্যক্তিত্বই এমন ছিল যে তাঁর অভিজ্ঞতা আর মেজাজজাত কবিতাই সিনেমাতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
অমৃতা প্রীতম আর সাহিরের ছায়া প্রেমকাহিনি প্রবাদের মতো পাঞ্জাবি-হিন্দি-উর্দু কাব্য রসিকদের মনে, সাহিরের ফেলে দেওয়া সিগারেটের বাট ঠোঁটে তুলে নিতেন নাকি আমৃতা, সাহিরের মননে এতটাই আকৃষ্ট ছিলেন তিনি। অমৃতা নাকি বলতেন তাঁদের দুজনের ছেড়ে দেওয়া সিগারেটের ধোঁয়া শূন্যে গিয়ে মিলে যাবে। সাহিররা কয়েক দশক জুড়ে প্রেম, ভালবাসা, বিরহের ভাষা তৈরি করেছেন। আকাশবাণী, বিবিধ ভারতী, দূরদর্শনের যুগের হৃদয়ের ভাষা, সেই সুর এখনও বেঁচে আছে দিব্যি ইউ টিউব, ক্যারাভানের যুগে। সেই মেলোডি আর এই মেমোরি-
“মৈঁ পল দো পল কা শায়র হুঁ
পল দো পল মেরী কাহানি হৈ
… মৈ ভি এক পল কা কিস্সা হুঁ
কল তুমসে জুদা হো জাউঁগা
বো আজ তুমহারা হিসসা হুঁ…”
- ঋণ-সাহির লুধিয়ানভী (রাজপাল প্রকাশন), রেখতা.কম, সাহির লুধিয়ানভী: পিপলস্ পোয়েট (অক্ষয় মানওয়ানি)।
Leave a reply