‘লেখা ছাড়া আমাদের আর কোনো সামাজিক যোগ্যতা নেই’ একথা যখন ভাস্কর চক্রবর্তীকে লিখছেন সুব্রত চক্রবর্তী তখন তাঁর বয়স সদ্য তিরিশ পেরিয়েছে। কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিবিজান ও অন্যান্য কবিতা’। বাংলা কবিতার জন্য এক স্বতন্ত্র ভাষা ও ভঙ্গি খুঁজে পেয়েছেন সুব্রত চক্রবর্তী, ষাটের প্রতিকুল আবহাওয়াতেই। বন্ধুহীনতার তীব্র অসুখ নিয়ে এগিয়ে চলেছে তাঁর কবিতা। নগ্ন এক নিঃসঙ্গতার চোরাস্রোত টের পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। এই অসহায়ত্ব নিয়েই করে যেতে হবে জীবনের সমস্ত কাজকর্ম একথাও মনে রেখেছেন সুব্রত।আর তাই তাঁর কবিতা অসুখ আর মনখারাপ পেরিয়ে শেষপর্যন্ত মানুষের ছায়া স্পর্শ করেছে। কখনও বৃষ্টির দিনে নিঃসঙ্গ টেবিল পেরিয়ে একটি আশ্চর্য জবাফুলের সারল্য এগিয়ে আসে ক্ষমাহীন জীবনের দিকে। এই নির্জন আশ্রয় সুব্রতকে বিশিষ্ট করেছে। মৃত্যুভয় পেরিয়ে এক যথাযোগ্য উদযাপনের দিকে তিনি চলেছেন। নিরুচ্চার আর শান্ত শব্দের আক্ষরিক এক ঐশ্বর্য ফুটে আছে তাঁর কবিতায়।
বৃষ্টির ভেতরে ওই জবাগাছ, আমি তার ক্ষমা ও সারল্যে
যেতে চাই।…এই ঘর,ভূতে- পাওয়া সারাদিন, বিছানা ও কাঠের টেবিল,
নষ্ট মোম, আধখোলা কলমের নিস্তব্ধতা ছেড়ে
চলে যাব। বৃষ্টির ভেতরে ওই জবাগাছ আমাকে ডেকেছে
সুখী ফুলে, পাতার আনন্দে। ম্লান এই ঘর, এই যে জীবন,
থেঁতো দিন,ভূতগ্রস্ত শব্দগুলি,চাদর ও নিঃসঙ্গ টেবিল,
ক্ষয়া মোম,ঠান্ডা, মৃত খবরের কাগজ…
সব ছেড়ে বৃষ্টির ভেতরে ওই জবাগাছ, আমি তার সহজ সরল
ব্যর্থতায় চলে যেতে চাই।
(যেতে চাই/বালক জানে না)
‘বালক জানে না’ কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা পড়লাম আমরা। এখানে মর্মবিদারক নিঃসঙ্গতা আছে। আর আছে পেরিয়ে যাওয়া গৃহসংলগ্ন প্রান্তর। এই জীবন নয়, অন্য একটি জীবনের প্রত্যাশা। তার ঠিকানা জানে কবিরই পরিচর্যা জাত শান্ত জবাগাছ। সহজ সরল এক ব্যর্থতার দিকে ঝুঁকে রয়েছে এই কবিতা। এও এক সফলতা। যখন প্রমত্ত রাজধানীর চিৎকার, অসংলগ্ন নিরর্থক ভালো থাকা, নিজের ব্যস্ততা নিজেকে সুখী করে তোলে এই ভান ছেড়ে জবাফুলের ব্যর্থতা আসলে নিজস্ব এক পরিসর। বাইরের পৃথিবীর নকল ইঁদুর দৌড়ের পাশে এই নিঃসঙ্গতা কেবল প্রাকৃতিক নয় একান্ত মনের নিবিড় আত্মীয়তা।
ষাটের কবিরা এত ম্রিয়মান কেন এই কথা উঠেছিল একদিন। এর অনেক কারণ আছে। পঞ্চাশের কবিরা জড়ো হয়েছিলেন দুরন্ত যৌবনের বন্ধুত্বের তাগিদে। নিজেদের নিয়ে তাঁরা অলীক মিথ নিজেরাই তৈরি করেছিলেন। একটা গুরুচন্ডালি ভাষা এবং জীবন নিয়ে তাঁরা উপস্থিত হয়েছিলেন পাঠকের কাছে। তাঁদের ছিল কবিসম্মেলনের মঞ্চ সফলতা। ষাটের এসব কিছুই ছিল না। এমনকী বড়ো প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়া পঞ্চাশের কবিদের যেভাবে প্রমোট করেছে ষাট এসবের কিছুই পায়নি। বুদ্বদেব বসু বা দিলীপকুমার গুপ্ত তাঁদের কেউ নয়। মনীন্দ্র গুপ্ত এই প্রসঙ্গে বলছেন ‘সত্যি, পঞ্চাশ যেন সম্পূর্ণ দোহন করে নিয়েছিল সমকালীন সমস্ত কামধেনু গুলি।’ ষাটের কবিতার নিয়তি বিচ্ছিন্নতা। কেন্দ্রীয় কোনো দল তাঁদের ছিল না। যেটুকু বৃত্ত সেখানেও একাকীত্ব বেজে ওঠে ব্যক্তিগত হৃদয়ে। ভাস্কর -সুব্রত-শামসের এবং বুদ্ধদেব জীবন দিয়ে টের পেয়েছেন কলকাতার এক নীরবতার রাজনীতি। সুব্রত চক্রবর্তী এইসব বেদনা টের পেয়েছেন দূরে থেকেও। এমনকী একমাত্র লেখাতেই উদ্ধার আছে এই কঠিন বিশ্বাস তাঁর ছিল। সত্তরের দশকের শুরুতেই তাঁর মনে হয়েছিল ‘আমাদের সময়ের মূল মুস্কিলই হলো আমরা সংগঠিত হতে পারিনি, পূর্ববর্তীদের কোরাসে আমাদের গলা অনেক সময়ই ঢাকা পড়েছে।’ অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
সুব্রত চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪১ সালে আসামের তেজপুরে। ছিলেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে অকালমৃত্যু। যখন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ভাষাভঙ্গিতে শুরু করেছেন নতুন লেখা, অকস্মাৎ মৃত্যু চুরি করে নিল তাঁকে।প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিবিজান ও অন্যান্য কবিতা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। কবির বয়স তখন আঠাশ বছর। তখনও তাঁর অবচেতনে পঞ্চাশের কবিদের সদর্প প্রভাব। নিবিড় ছন্দের চর্চা আর শক্তির প্রভাব অনেকখানি রয়েছে। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ এবং কবির জীবদ্দশায় শেষ বই ‘বালক জানে না’ প্রকাশিত হয় প্রায় সাত বছর পর ১৯৭৬ সালে। এই একটি কাব্যগ্রন্থেই সুব্রত পেয়ে যান বাংলাভাষায় শক্তিশালী কবির আসন। অবশ্যম্ভাবী আর অনিবার্য কবি হয়ে ওঠেন এই একটি অসামান্য কাব্যগ্রন্থের জন্য। এর একমাত্র তুলনা হতে পারে পঞ্চাশের কবি যুগান্তর চক্রবর্তীর কবিতা। একটি বইয়ের জন্য চিরস্থায়ী আসন। তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পর অগ্রন্থিত কবিতা নিয়ে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে বন্ধুদের উদ্যোগে। ‘নীল অপেরা’ (১৯৯০) বাংলা ভাষার একটি প্রতিনিধি স্থানীয় বই। এখানে সুব্রত সম্পূর্ণ এক নতুন স্বর এবং ভঙ্গিমা খুঁজে পেয়েছিলেন। যা প্রত্যক্ষ আর নিবিড়। যেন এক ভাষা আক্রমণকারী নতুন পথের সন্ধানে বেরিয়েছেন। আসুন পাঠক আমরা অনুসরণ করি এই সময়ের একটি কবিতাকে
নেমেছে গ্রীষ্মের সন্ধ্যা; মাঠ থেকে মাঠে হেঁটে যায় একটি কুকুর।
ফুটন্ত ভাতের গন্ধে গ্রামের মানুষজন চলে গেছে শহরের দিকে…
রোপণকালীন গানে এই গ্রাম একদিন ভরে ছিল, আজ
হেজেমজে গেছে সব- কেউ নেই; শুধু কিছু বিদেশি পুলিশ
খালপাড়ে,ক্যাম্পে,অতিশয় আসর জাঁকিয়ে
আজো আছে; খাঁ খাঁ মাঠ- আর ওই গ্রীষ্মরজনীতে
মাঠ থেকে মাঠে মাঠে শজারুরা নিয়ে যায় রাশিরাশি আধপোড়া ভাত।
(গ্রীষ্ম/ নীল অপেরা)
যে সংগঠনহীনতা এবং পূর্ববর্তীদের কোরাসে চাপা পড়ে যাওয়া স্বরের কথা বলছেন সুব্রত সেই অভিযোগ খানিকটা ভিত্তিহীন মনে হতে পারে এই কারণে যে তাঁদের দল তৈরি হয়েছিল পঞ্চাশের কৃত্তিবাসীদের ভূমিতেই। ষাটের একটি শক্তিশালী ধারার (ভাস্কর- শামসের- তুষার- সুব্রত- যোগব্রত- বুদ্ধদেব- দেবারতি) জন্ম এবং প্রতিপালন কৃত্তিবাসের গর্ভেই। বোঝা যায় তাঁরাও খ্যাতির দূরবর্তী উপাসক। কবিতা নিয়ে যে দুঃসাহস এবং হেস্তনেস্ত করার মনোভাব তার পেছনে পঞ্চাশের কবিদের উৎসাহ এবং মদত ছিল। কিন্তু সুব্রত যখন একথা বলেছেন ততদিনে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরিয়ে গেছে। নতুন পথে হাঁটছে তাঁদের কবিতা। কৃত্তিবাসী মোহ ততদিনে ভেঙে গেছে। তবুও একটি কথা থাক তথ্যহিসেবে ভাস্কর চক্রবর্তী,সুব্রত চক্রবর্তী এবং শামসের আনোয়ারের কিংবদন্তি কাব্যগ্রন্থের (শীতকাল কবে আসবে সূপর্ণা, বালক জানে না, মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে) নাম কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার পাতায়। তাছাড়া দেবারতি এবং শামসের পেয়েছিলেন কৃত্তিবাস পুরস্কার।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে ভাস্কর চক্রবর্তীকে লেখা একটি চিঠিতে সুব্রত বলেছেন ‘আজ আমাদের একথা বোঝার সময় এসেছে যে ‘অভিনবত্ব’ আধুনিক যে-কোনো লেখার একটি জরুরি শর্ত’। একথা সুব্রত যখন বলছেন তার কিছুদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে ‘বালক জানে না’ এই বইতে সুব্রত সেই জরুরি শর্ত পালন করেছেন। সম্পূর্ণ নিজস্ব এক ভাষা। কোথাও পঞ্চাশের মায়াঞ্জন নেই। বরং দৈনন্দিন জীবন খুঁড়ে উঠে এসেছে কবিতা। এসেছে নিজের জীবন, নিঃসঙ্গ টেবিল, অনর্থক বিছানায় শোয়া এক পরাজিত মানুষ। তাঁকে সহজে চেনা যায় কিন্তু বহন করা কঠিন। সেই জীবনেরও আছে সম্ভাবনা। প্রকৃতির সামান্য দৃশ্যে। উজ্জ্বল হলুদ আলোর পাশে ঠান্ডা কোলাহল।অস্ত্রের গোপন আঘাতচিহ্ন। নিজের বিষণ্ণতা নিয়ে একজন মানুষ দূরে থেকেও টের পান আছে, আছে, সম্ভাবনা আছে। সুব্রতর কবিতা এভাবেই আবেগকে সম্ভ্রান্ত করে রাখে আর পাঠককে সর্বস্বান্ত করে দেয়। আসুন নিঃশব্দে তাঁর কয়েকটি কবিতা পড়ে নিই।
১.
বৃষ্টির ভেতরে ওই ধবল পোশাক পরে বালিকার ছুটে যাওয়া
আমাকে এমন
নিঃসঙ্গ করেছে।… চেয়ে দেখি তুমুল বৃষ্টিতে
স্তব্ধ বাড়ি, জবাগাছ, ঘুমন্ত কবর–
অনন্ত বৃষ্টিতে ভেজে দিগ্ বলয়, লাল পথ, প্রসারিত হাত;
একটি মহিষ ভেজে, সমাধিফলক ভেজে।…আর ওই বৃষ্টির ভেতরে
চকিত পাখির মতো– দূর থেকে আরো দূরে–
উড়ে যায় শৈশবের ধবল পোশাক।
(বালিকা/ বালক জানে না)
২.
দুঃখের দিনের সাথী,শাদা বই, তুমি স্তব্ধ কাঠের টেবিলে
আরো গাঢ় স্তব্ধতায় মিশে আছ। পাশে, ওই জানালায়, নিশীথকালীন
তীব্র জবা ফুটে থাকে; আর শান্ত পাতার মর্মরে,
যারা চলে গেছে দূরে, ওই সব মানুষের ঠান্ডা অভিলাষ
ভেসে আসে।… এ সব জানো না তুমি,শাদা বই, চিরজায়মান
কাঠের টেবিল থেকে সারারাত বেড়ে ওঠো চারিদিকে।
মরমানুষের
ঘুমন্ত শরীর থেকে শুষে নাও স্বপ্ন,প্রেম, স্বাধীনতা।… নিঃশব্দ সকালে
কালো মলাটের নীচে মানুষ পায়নি খুঁজে
অস্ত্রের আঘাতচিহ্ন, রক্তমাখা চুল।
(বই/ বালক জানে না)
৩.
শিবানীর প্রেম এসে ছুঁয়েছিল শিবানীর মাকে
একদিন। শিবানীর মা কি জানে এই কথা, শিবানী কি জানে!
উজ্জ্বল শাড়ির পাড়ে লেগে আছে অভ্রকণা– শিবানীর মা
একা-একা হেঁটে যান নীচু চোখে; আর দূরে, ধবল শামপানে
শিবানী ভ্রমণ করে। দীর্ঘ,খর,চেরা জিভে চেটে খায়
কুয়াশার জল…
এই তার ভালোবাসা, এই তার তৃষ্ণা- নিবারণ।
শিবানীর মা কি জানে অতশত!… চিবুকের নীচে,
শিথিল খোঁপায় তার কুয়াশা নিবিড় হয়,
উজ্জ্বল শাড়ির পাড়ে ঝলে অভ্রকণা।
(প্রেম/ বালক জানে না)
না-বলা বা না-লেখার একটা অদ্ভুত চোরাটান আছে সুব্রতর কবিতায়। দু-একটি দৃশ্যকল্পে তিনি যেন একটি রেখাচিত্র এঁকে দেন। শব্দ মধ্যবর্তী শূন্যতায় পাঠকের চূড়ান্ত অধিকার। কিছুই নেই অথবা অদৃশ্য আছে তাকে দেখতে পান কবি। দূর থেকে কখনও ঘরে বসেই। বলার কিছু নেই কিন্তু না-বলা নাছোড়। একটি কবিতা এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে।
লেখার মতন কিছু নয়, শুধু এক নিঃসঙ্গ মানুষ
দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্রিজে,সন্ধ্যাবেলা…
একজন নিঃসঙ্গ মানুষ, একটু ঝুঁকে
দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্রিজে,সন্ধ্যাবেলা
এই — আর নীচে
কালো জলে, এলোমেলো ভেঙে যাচ্ছে
কবেকার ঠান্ডা কালো জল।
(কালো জল/নীল অপেরা)
হে পাঠক, এই কবিতার পাশে রবীন্দ্রনাথের ‘আকাশপ্রদীপ’ কাব্যগ্রন্থের ‘প্রশ্ন’ কবিতাটি পড়ুন। দেখুন না বলা কত অপ্রত্যাশিত আর প্রত্যক্ষ হতে পারে।
সুব্রতকে একদা ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছেন ‘আমার মা, আমাকে উপহার দিয়েছে অসুখ। আমি সেই অসুখ জামার মতো ব্যবহার করি।’ এই এক উদাসীন অসুখ সঙ্গী ছিল সুব্রত চক্রবর্তীরও। দুজনেই দিনের পর দিন অবসাদে ক্ষয়ে গেছেন। এমনকী ঘুমের মধ্যে ও মনখারাপ আপাদমস্তক জাপটে রেখেছে সুব্রতকে। কোথাও পরিত্রাণ নেই। অনর্থক কয়েকটি শব্দ জড়িয়ে কীভাবে পেরনো যাবে নির্ঘুম দিনগুলি। জীবনের সর্বত্র অপমান কোণঠাসা করে রেখেছে সুব্রতকে। আর তাই তিনি ভাবছেন বন্ধুদের ভালোবাসা দরকার ‘প্রকাশ্যে এবং সদম্ভে’। চারদিকে বিষণ্ণতা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আগেই লেখা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন সুব্রত। কিন্তু কমলকুমার মজুমদার আপত্তি করে বলেন ‘লেখা ছাড়িও না, মনে রাখিও, লেখাও একপ্রকার তাঁহাকে ডাকা।’ সুব্রত লেখায় ফেরেন। ষাটের দশক পায় একজন অনিবার্য কবিকে। ভাস্কর, সুব্রত, দুজনের কবিতায় অসুখ আছে কিন্তু সুব্রত র কবিতায় অসুখের উদযাপন নেই। বরং আছে দৃশ্য পেরিয়ে জীবনছোঁয়া প্রতিরোধ। একজন শান্ত বালক অথবা ভোরের বালিকা, শান্ত জবাগাছ তাঁকে অসুখ থেকে পরিত্রাণ দেয়। আসলে দেশ সর্বোপরি মানুষ সম্পর্কে তাঁর ছিল ‘মতলবহীন অনুভূতিময় সচেতনতা।’ তিনি বুকের ভেতর রেখেছিলেন একটি নির্জন পথ। চেয়েছিলেন এই জীবনে একটুখানি ধুলো উড়ুক। সুব্রত ফিরেছিলেন এক গভীর সংবেদনশীল প্রদেশে। আকস্মিক মৃত্যু না হলে ষাটের কবিতা আরো সমৃদ্ধ হতে পারত। মৃত্যুর আগে লেখা কয়েকটি কবিতা পড়লে কেবলই মনে হয় সুব্রত ছিলেন জাত কবি, অভিনব কবিত্ব প্রতিভা তাঁর। শুধু দূরতর বন্ধুহীন প্রবাস তাঁর বিষাদকে তরান্বিত করেছিল
১.
বিকেলবেলার দুঃখী আলো এসে আমাকে বলেছে, দেখা হবে।
নৈশ রাজপথে এক আধপাগলা যুবতী ভিখিরি
অকারণে হাত নেড়েছিল।
একটি হলুদ পাখি, একদিন আমাদের মৃত জবা গাছে
বসেছিল কিছুক্ষণ- তারপর উড়ে গিয়েছিল…
একটি পালক শুধু ঝরে পড়েছিল তার। কেন আমি কুড়িয়ে রাখিনি।
বিকেলের আলো আজ দুঃখহীন, মায়াহীন, উদ্ভাবনহীন…
নৈশ রাজপথে এক চাঁদভোলা কুকুর শুধু অকারণে কেঁদে- কেঁদে ওঠে;
আজ কোনো পাখি নেই- একটি পালক শুধু মৃত জবা গাছে
বারবার কাঁপে- কেন আজো তাকে ভুলতে পারিনি!
(একটি পালক শুধু/নীল অপেরা)
২.
কিছু নয়- হঠাৎ, বাতাস ওঠে, এলোমেলো করে দেয় সব।
একটা শুকনো বাঁশপাতা ঘুরে ঘুরে পড়েছে টেবিলে…
কিছু নয়। চোখ থেকে চশমা খুলে কাছ মুছি। খোলা বই থেকে
ফুঁ দিয়ে ওড়াই ধুলো… তারপর, সামনে তাকালে,
দেখি, ওই, দুপুর অনন্ত হয়ে মিশে আছে অনন্ত দুপুরে।
(দুপুর- ২/ নীল অপেরা)
৩.
তাঁবু ছেড়ে আজ একা
চলে যাচ্ছে খর্বুটে জোকার
কীটের গুঞ্জনময়
স্তব্ধতায়। টুপির পালক,
একে একে খসে পড়ে…
আর, ওই নিঃসঙ্গ মানুষ
বিবর্ণ পালকগুলি
তুলে নিতে উবু হয়ে বসে।
(জোকার/ নীল অপেরা)
জীবনের শেষ দিকে সুব্রতর কবিতায় প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছিল মানুষের শ্রেণিচরিত্র। একা মানুষের নির্জনতা পেরিয়ে সমবেত মানুষের সুখ দুঃখে ভরে উঠেছিল তাঁর কবিতা। গূঢ় জীবনধর্ম এবং সমাজ বাস্তবতার গভীর অন্তর্দৃষ্টি শব্দে ধারণ করেছিলেন তিনি। উদাহরণ হিসেবে উদ্ধৃত ‘গ্রীষ্ম’ কবিতাটির কথা বলতে চাই। এমন নিবিড় দৃশ্যকল্প কার্যত তুলনাহীন। শুধু খিদের তীব্রতায় মানুষ, কুকুর আর শজারু রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেছে জীবনের অধিকারে। কোথাও মানুষ নেই, শুধু অন্ধকার। খালপাড়ে বিদেশি পুলিশের ক্যাম্প আরো বেশি উজ্জ্বল হয়েছে। শুধু পাঠক টের পায় হয়তো কোথাও রয়েছে শিথিল যৌনতার মর্মঘাতী শরীর।
তাঁর কবিতা এবং জীবনে ছিল আশ্চর্য স্ববিরোধ। সেই স্ববিরোধ যা আধুনিকতার মৌলিক শর্ত। একই সাথে ভয় এবং দুর্বলতা, তেজ আর সাহস। আছে ভোঁতামি আর ধারালো যুক্তি। পাশাপাশি সংযম এবং আন্তরিকতা। সুব্রতর কবিতায় ভান নেই। শিল্পের বিকল্পে জীবন বিকিয়ে দেওয়ার শর্ত নেই। আছে মতলবহীন নিবিড় আন্তরিক ভালোবাসা আর সংশয়। বিচ্ছিন্ন মানুষের ঘর ছেড়ে তাঁর কবিতা ফিরছিল সমবেত মানুষের কাছে। ধুনুরির ছেলে কিংবা ইটখোলায় কামিনের দুর্বোধ্য গান ফিরে ফিরে আসে যখন ফাল্গুনের দুপুর। শেষপর্যন্ত সব কিছু পেরিয়ে নিজের জন্য আন্তরিক মায়া। বনের আড়ালে থেকে সন্ধ্যার আদেশধ্বনি শুনতে শুনতে তাঁর কেবলই চলে যাওয়া, যখন ষাটের দশকও সাবলম্বী হয়নি- যখন পথ চলার আরও অনেক পথ বাকি ছিল।
Leave a reply