শেষ বইমেলায় কবি সায়ন রায় পড়তে দিয়েছিলেন ‘রভস’ কবিতার বইটি। কয়েকদিনের মধ্যে কিছু কবিতা পড়েছিলাম ঠিকই, এবারে একটু বিশদে পড়লাম, আসলে তখন একটা মনোনিবেশ দাবি করেছিল বইটা। এবারে পড়ে দু-চার কথা লিখতেও ইচ্ছে করল। হয়তো এমনটা ঘটে।
সায়ন প্রচল আবহমান বাংলা কবিতা লেখে। এই বইটাতে তা স্পষ্টতা পেয়েছে। শুধু উৎসর্গপত্রে লেখা আছে বলে বলছি না। একজন কবি কী লিখবে, কেমন করে লিখবে এবং কোন ভাষায় লিখবে তা সম্পূর্ণ তাঁর ভাবনার স্বেচ্ছানুসার ও তাঁরই এক্তিয়ারভূক্ত। এ নিয়ে কোনও বিতর্কের জায়গা থাকতে পারে না। আমিও তা নিয়ে কোনোরকম প্রশ্ন তুলতে চাই না। যাই লেখা হোক, যেভাবেই লেখা হোক, কবিতা হওয়াটাই মূল। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সায়নের বেশ কিছু লেখা অন্তত আমার মতে কবিতা হয়ে উঠেছে। পদ্য-মুখোসের আড়াল খোঁজেনি তাঁর সেইসব লেখা। পদ্য ও কবিতার পার্থক্যের কথা পাঠককে একবার যেন স্মরণ করিয়ে দেওয়া তাঁর। আবহমান লিখলেই তা পদ্য হয়ে দাঁড়াবে, এই ভাবনাচলনের বিরোধাভাস পাওয়ায় ভালোলাগার একটা জায়গা তৈরি হয়ে যায়। কেননা আমি মনে করি বহুদিন ধরেই আবহমানের মধ্যেও অনেক হৃদয়গ্রাহী কবিতা লেখা হয়েছে। পদ্য লিখে ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন করার কোনও অর্থ হয় না। এখানে একটা কথা উল্লেখ না-করলে অপরাধবোধে ভুগব। কোনটা কবিতা হলো কোনটা হলো না, তা মাপার কোনও প্যারামিটার নেই। যদি থাকতও তবে তা হতো ব্যক্তিচিন্তানুসারী প্যারামিটার। স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধিতে, চিন্তা-চেতনায়, অনুভব-অনুভাবনা, রসে-নান্দনিকতায়, স্পর্শ করা ও উদ্দীপ্ত করার ক্ষমতাসম্পন্ন সাহিত্যকর্মকেই আমি কবিতা হিসেবে এখানে ধরে কথা বলতে চাইছি; কথা বলতে চাইছি কোনটা কবিতা নয় এই অপেক্ষাকৃত সহজ উপলব্ধিকে সম্বল করে।
ভাবনার ব্যক্ততা-অব্যক্ততা, অনুভবের অনুসৃতি, অভিজ্ঞতা-জ্ঞান-চেতনা-চৈতন্য যখন অক্ষর-শব্দ-ভাষায় লিপিবদ্ধ হয় এবং তা পাঠকের কাছে আরও ভাবনার উদ্রেককারী হয়ে ওঠে, বা পাঠকের হৃদয়ানুভবে বেজে ওঠে, বা তাকে কোনোভাবে স্পার্ক করে বা ট্রিগার করে, তাহলে তা কবিতার উদ্দেশ্যকে সিদ্ধ করে বলে আমার মনে হয়। সায়নেরবইয়ে বেশ কিছু কবিতায় আমি এই গুণ লক্ষ করেছি। যেমন বইয়ের নাম-কবিতায় মানুষের ‘মিলিত হবার আকুল প্রয়াস’ বা বাসনা যখন ‘দূর কোন দ্বীপ’ থেকে ‘সাদা পালকের ডানা প্রেম’ নিয়ে আসে, নিয়ে ‘আসে শান্তরস’ তখন তা আনন্দের ক্ষণ। এই-তো প্রার্থিত। পাঠক তখন রভসে কবির সঙ্গে সমমেলে বেজে ওঠেন। যদিও ‘রভসে’র আগে ‘প্রাচীন’ বিশেষণটি কেন, তা নিয়ে একটু খটকা থাকছেই আমার। কেন ‘নয়া রভসে’ নয়, বা শুধুই ‘রভসে’ নয়, প্রশ্নটা জাগে।
‘বেদনাবকুল’-এর পাঁচটি টুকরোয় আমি লিরিকের মেজাজ খুঁজে পাই। যদিও বলা হয়ে থাকে বাংলা কবিতায় ‘লিরিকের যুগ’ কবেই শেষ হয়ে গেছে। আধুনিকতার ফলস্বরূপ যে রোমান্টিসিজম প্রতিস্থাপিত হয়েছিল, কালে কালে তাও শেষ যাত্রার পথে। তবু বাংলা কবিতার আবহমান ধারায় আজও লিরিক ভিন্ন মেজাজে লেখা হয়ে থাকে। সায়ন সেই ভিন্ন স্বাদ ও সুরের লিরিক প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছ এই খণ্ডকবিতাগুলিতে। “এত যে নদীর জল তুলে নিয়ে রক্ত ঢেলে দিই/ তুমি শুধু সৎকার দেখেছো” বা, “বেদনা বকুল আরও শ্বেত শুভ্র ব্যথা/ ঢেকে থাকে ঘুমঘোরে হাওয়ার মতন”, বা, “এমন বিরল দিনে ভেসে যায় নাও/ ভেসে যেতে থাকে/ আকাশ মেঘলা মনে জলের খোয়াব/ ঝিল্লিদের কথকতা সমূহ বাতাসে” ইত্যাদি, মনোভাবনার সুন্দর প্রয়োগ। এইসব কবিতায় প্রেমানুভবও কম নয়। তাই লিরিক্যাল মেজাজের সঙ্গে রোমান্টিসিজম মিলেমিশে একে ভিন্নতার সৃষ্টি করেছে।
আবার উপরোক্ত কথাগুলোর বাইরেও এই বইয়ে কিছু কবিতা আছে, যা যাপনকেন্দ্রিক ব্যক্তি অনুভবের স্তর থেকে প্রতিফলিত হয়ে উঠে এসেছে। এখানে লিরিসিজম-রোমান্টিসিজম আদৌ নেই। যেমন ‘বিপদ’ কবিতাটা শুরুই হচ্ছে এইভাবে— ‘আলোকিত পানপাত্র। অসমাপ্ত সুরা’। স্পষ্টতই এক ভিন্ন মাত্রা যা কল্পনাকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিস্তৃত করে নির্মিত। ‘অসমাপ্ত সুরা’ আধুনিকতার সফল প্রয়োগ। “ঠোঁট ও কাচের ফাঁকে যেটুকু বিশ্বাস”— দূরত্ববোধের সঙ্গে তুলনীয় হচ্ছে বিশ্বাস নামক মনুষ্যগুণ। খুব সুন্দর। এই চলনটাই শেষাবধি অন্ধকারের দিকে মুখ ঘোরালে পাঠক হিসেবে ব্যক্তি আমার কিছু অস্বস্তি হয় বৈকি। “গোটা একটা অন্ধকার অবশেষে/ ঢুকে পড়ে ঘরে”। কবিতা তৈরির মোহ ধরা পড়ে যায় কবির কলমে। কেননা এই ‘অন্ধকার’ বহুচর্চিত বাংলা কবিতায়। একজন তো (জীবনানন্দ দাশ) মিথ হয়ে আছেন, এ বিষয়ে। অলক্ষে যেন তিনি এসে যান কবিতায়। যদিও আমি জানি সায়নের প্রেরণায় তিনি হয়তো আছেন, কিন্তু অনুকরণপ্রিয়তা তাঁর ধর্ম বলে মনে হয়নি কখনও। সেক্ষেত্রে সায়ন এক আলাদা শিল্পী। আরেকটা কবিতার কথা উল্লেখ করে এই ধন্দটা পুরোপুরি মিটিয়ে দেবার চেষ্টা করা যেতে পারে। “শিশুটি সহজ হলে মাটি ভিজে ওঠে/ শিশুটি আকাশটাকে কুটিকুটি ছিঁড়ে/ ছড়াল বাতাসে/ কিছু বা অবাক চোখে তার দিকে দেখি” (দোসর/ প্রথম স্তবক) এই ভাবনাচিত্রে কোনও অবচেতনার স্থান নেই। সচেতনভাবে কল্পনার বিস্তৃতিতে এই চিত্রানুভব, যা জীবনানন্দীয় ভাবনার চেয়ে আলাদা। আবার এ-কথাও ঠিক কবি সায়ন রায়, তাঁর এই বইয়ের কবিতায় মাঝেমধ্যেই অবচেতনার কথা ও কিছু অনুষঙ্গকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিয়েছেন।
এই বইয়ে তাঁর কবিতায় আমি দু-রকমের ভাষা প্রয়োগ লক্ষ করি। কিন্তু এই দুই রকম এত কাছাকাছি যে পার্থক্যটা চিহ্নিত করতে কোনও কোনও পাঠক কিছুটা বেগ পেতে পারেন। আমি এখানে দুটো কবিতার নাম উল্লেখ করে এবং তার থেকে দু-চারটে লাইন তুলে বিষয়টা খোলসা করার চেষ্টা করছি। যেমন, কবিতার নাম— ‘নটী’। কয়েকটি লাইন— “সদা হাস্যময় প্রতি রাতের রদেভুঁ/ চোখে আলো জ্বেলে দেয়/ ঘন নীল আলো/ সুনিপুণ মঞ্চমায়া, এই আলো প্রকৃত মেধাবী/ চুম্বক প্রতিম, ফিরে আসো পুনর্বার/ মুদ্রার জাদুতে আর দেহ-ছন্দ-গুণে/ অপূর্ব সংলাপ দৈব মোহের বিভাবে/ ঢেউয়ের চূড়োয় হীরের দ্যুতির মতো/ ভেসে ওঠে বারবার অন্ধকার দর্শকের চোখে”। কবিতাটি অন্ত্যমিলহীন অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা। আরেকটু বললে বলা যায় পঙ্ক্তিতে মাত্রা ভেদ আছে। ভাষাচলনে গদ্যরীতি, বয়নে চলিত ভাষার রূপ, কিন্তু শব্দ চয়নে সাধু ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের আধিক্য। অর্থাৎ তৎসম শব্দের ব্যবহার বেশি। দেখা যাক— ‘চোখে আলো জ্বেলে দেয়’, বা ‘ভেসে ওঠে বারবার অন্ধকার দর্শকের চোখে’; গদ্যরীতির চলন, ক্রিয়াপদের ব্যবহারে চলিত ভাষা্র রূপ। এবার এটুকুতেই শব্দ ও শব্দবন্ধগুলি খেয়াল করলে তা, ‘হাস্যময়’, ‘সুনিপুণ’, ‘মঞ্চমায়া’, ‘প্রকৃত মেধাবী’, ‘চুম্বক প্রতিম’, ‘পুনর্বার’, ‘মুদ্রা’, ‘দেহ-ছন্দ-গুণে’, ‘অপূর্ব সংলাপ’, ‘মোহের বিভাবে’, ‘দ্যুতি’, ইত্যাদি। এখন এই চলিত ভাষারূপের সঙ্গে এই শব্দরাজির মিলন ঘটানো যথেষ্ট কঠিন কাজ। অবশ্য সায়ন তা অনেকটাই করে দেখিয়েছেন। আরেকটা রকমের কথা বললে কবিতা হিসেবে ‘আলপনা’ কবিতাটা তুলে ধরা যেতে পারে। “ট্রিগারটা টিপতেই/ দমকে দমকে নানা রং/ রংহীনতাও। শিল্প শিবিরের মতো/ এফোঁড়-ওফোঁড় করে ছুটে যায় মাঝ বরাবর/ ঘননীল নিঃশব্দতা শুনশান জনশূন্য মাঠ/ এইবার জন্ম নেবে শব্দগাছ ফুল লতা পাতা/ মধুবনি আলপনা রঙিন কাগজে।” এই কবিতাও পঙ্ক্তিতে ভিন্নমাত্রা রেখে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা, এবং অন্ত্যমিল নেই। এখানেও গদ্যরীতির ভাষাচলন, এবং চলিতভাষার বয়ন। পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য এর শব্দ চয়নে, এখানে আদৌ তৎসম বা অর্ধতৎসম শব্দ বা শব্দবন্ধের ঝনঝনানি নেই। চলিত ভাষায় ব্যবহৃত শব্দকেই মূলত বাছাই করা হয়েছে নির্মাণে। এমনকী দেশি এবং কথ্য শব্দও ব্যবহৃত হয়ে চলিত ভাষার প্রকৃত রূপটিকে আশ্রয় করে কবিতা নির্মিত হয়েছে। এতে ভাষার গতিও বেড়েছে বলে মনে করি।
আমার মনে হয়, কবিতার ইতিহাস মূলত ভাষার ইতিহাস; আর কিছুটা আঙ্গিক-প্রকরণ ও উপস্থাপনাগুণ। বিষয়ভাবনার পরিবর্তন খুবই ধীরগামী, শ্লথ, এবং মানুষের মননের গুণ-দোষ, ভালো-মন্দ প্রায় একইরকম থেকে যায়। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তন হয় ভাষায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়, আর স্থান বা পরিসর পরিবর্তনে বদলায়। তাই কবি কতটা সচেতনভাবে তাঁর নিজস্ব কবিতার ভাষা গড়ে তুলবেন, তা নির্ভর করে কবির অভিরুচি, অনুসন্ধান, দীক্ষা ও চর্চার ওপর। তিনি নিজের ভাষা গড়ে তুলবেন না পূর্বজদের ভাষা অনুসরণ করেই প্রচলে থাকবেন সেটা তাঁরই ব্যাপার। আবহমানের মধ্যেও স্বতন্ত্রতা থাকতে পারে, থাকে। বইটি পড়ে আমার যেটা মনে হয়েছে, কবিতার ভাষা নিয়ে কবির অনুসন্ধান এখনও জারি রয়েছে। এটা ভালো লক্ষণ এবং গুণ। নাথিং আলটিমেট। আমি এই বইয়ে এমন এক-আধটা চেষ্টাও দেখেছি, যেখানে কবি প্রচল থেকে সামান্য বাঁক নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যেমন— ক) “দাঁড়ে বাঁধা পাখি। উড়ন্ত চাকার দাগ/ কালশিটে চেপে বসে ভিতর খুলিতে” (উড়ন্ত কুক্কুট); খ) “আজ আঁকিবুকি কাটা মন চিরে চিরে ফালা/ তোমার লাভার স্রোত অসময়ে পৃথিবী ভাসাবে” (বাসনা ভ্রমর-১)। এখানে কবিকে আমার যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ মনে হয়েছে। ভাষা এমনভাবে ব্যবহৃত হয়েছে যে বিমূর্ততার সৃষ্টি হয়েছে, যা কবিতাকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যেতে সমর্থ। কিন্তু এই ভাষ্যরূপ তাঁর বইয়ের কবিতাসমূহে প্রাধান্য পায়নি। সম্ভাবনার বেশ কিছু গুণ লক্ষ করায় আর ভাবনাঞ্চল অনেক ক্ষেত্রেই স্পর্শ করায় বইটা আমার ভালো লেগেছে। তাঁকে আরও পড়ার আগ্রহ রইল।
Leave a reply