শূন্যরাষ্ট্র ও চুল্লিমুখ পতিত আত্মার
১
শূন্য শুধু শূন্যই থাকে না, নিত্যকর্মে
মিশে থাকে বাবার গম্ভীর, চন্দ্রমুখী মা আমার
মেঘ-বীজের খিচুড়ি চড়ান
কাছেই জীবনানন্দের মেঘ বাড়ি, হে গম্ভীর,
একাকীত্বে লীন
নদী খেত ঘরদোর চিহ্নহীন শূন্যে ভাসে, স্থির
শূন্যতাই অর্থবান চতুর্বেদ করুণা পাহাড়
আমি শুধু হৃদিঅপাহিজ বিদ্যুৎ-সাইকেলে দিকশূন্যপুর খুঁজি
নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে খুঁজে মরি দেশহীন দেশ
তারা- শিশুদের অপমৃত্যু হলে দেখি
নক্ষত্রের দোষ ছিল কীনা
কালশিরার অসুখ ছিল কীনা
আমার অসহ্য চীৎ-এ ঈশ্বরের না-গোধূলি
কখনো ভেঙেছে, অশীৎকারে কখনো মথিত
২
আমাদের বৈষ্ণবীয় বাড়ি। মাংস ডিম
ঢোকেনা হেঁশেলে শুধু মাছের নিষেধ নেই কোনও
ইলিশের আত্মারা বেড়াতে বেরুলেই
এ ব্রহ্মেও সকসক করে ওঠে জিভ
জিভাত্মার দোষ আর কোথায়, তাহার
স্মৃতিময় বাংলাদেশে জলের সৌন্দর্য-প্রাণ
কতভাবে জুড়ে আছে জানে জল
জানেন কূর্মাবতার
৪
শিশু মুন্ডামেঘ সঙ্গে, উড়ি
উড়িপুড়ি ডানাহীন
দিশাহীন এই লোকে
শিশুটি চতুর জানে কোন গুপ্ত ঘুলঘুলি
খুললেই এ শহর কলিকাতা দিব্য দেখা যায়
আহা ট্রাম আহা বাস আহা প্রাচীন ভার্সিটি আহা
করুণ ভিখারি আহা কলেজ-ফেরত বালিকারা আহা
মাদামোয়াজ্জেল, তুমি কি এখনো
ভাবো স্মৃতিত আমাকে?
তোমার চুলের ছায়া যত কথা বলেছিল
হাউজের দুপুরবেলায়, গোঁসাঘরে
এমনকী তোমার অসুখ
৫
তোমার হেঁসেল দেখা গেল
কুকারের ধ্বনি বুঝে নিতে নিতে
জানালায় দেখি কাক প্রসাদীতে উন্মুখর
কাকেদের এখনো খাওয়াও, চড়ুইদের দানা?
ভাব সেই আহাম্মক কবিটির কথা?
বারান্দার টবে ফুল এলে
যে এপ্রিল খেলা করেছিল
যে উড়ন্ত ফিরেছিল শ্বাস
দেখো শীর্ন মধ্যমায়
নীল চিহ্নে মুদ্রা রেখে গেছে
৬
এই হাওয়া হাওয়াহীন এই গাছ বৃক্ষহীন মৃত্তিকাবিহীন এই মাটি
না-আকাশের গোত্র কী উপবীত এক
এই যে অচির বৃষ্টি তার টাপুর টুপুর নেই কোনও
এই যে না-মন্দাকিনী
কোন জল বুকে রাখে নিজেও জানেনা
জ্বলন্ত ধুমকেতু অন্তরঙ্গ ভেদ করে অথচ কোথাও তার অগ্নিক্ষত নেই
পিষ্ট হলে পায়ে তারাশিশু যে আর্তি ছোটায়
বনাবটি সেটি তাই পলকে হাপিস
এত এত কথা বলি তাও নৈঃশব্দ্য ভাষায়
এত পর্যটনে যাই সেও না-পর্যটন
আমাদেরও মাতৃভাষা ছিল হে মধুর
মা আমার হেঁসেল আদরে ঠেলে
কত যে গুনগুন গাইত, বাচ্চু মেঘ, বাংলা ভাষাতেই
মা-র বুকে আছড়ালে ধকধক যত ধ্বনি
সে-ও তো বাংলা ভাষার
৭
এই নদী মন্দাকিনী না-অপূর্ব না-যৌনের
সমুদ্র সঙ্গম নেই তার
পার হলে গান্ধর্ব কুটির শিশু মুন্ডামেঘ
আমাকে এনেছে
শৃগাল শরীর মুখ মানবিক বীভৎস সুন্দর
গন্ধর্ব গাইছেন ওহো গান
না-মেঘেরা ভিড় করে আছে
না-পাখিরা ভিড় করে আছে
না-হাওয়ারা ভিড় করে আছে
গন্ধর্ব গাইছেন আহা সুর ধরতেই পারছিনা
তবু চনমন করছে ভিতর
তবু উতরোল হয়েছে বাহির
দুলে দুলে শিশু মুন্ডামেঘ নাচে যেন
শিশুকৃষ্ণ আর
দুলে দুলে নেচে উঠছে গান্ধর্ব জগত
গন্ধর্ব, হে সুরী, তুমি
হেমন্তবাবুর গান জানো? রবীন্দ্রনাথের?
৮
বালকটি চতুর পরন্ত পন্ডিত, বলেছে
এটি পাঁচ জন্মান্তর তার সেখানে আমার মাত্র দুই
বলেছে এ আমরা আসলে অদৃশ্য কীট
ঘুরি ফিরি মন্দাকিনী পার হই মেঘশস্য খাই
বাতাসের ঘ্রাণ পান করি
নৈঃশব্দের ভাষা শিখে হরিগুণ গাই
সে বলেছে নিখিলের গর্ভে আমাদের বাস
গর্ভেই শিয়ালমুখো গন্ধর্বেরা
মন্দাকিনী জাদুবৃষ্টি নক্ষত্রের বন
গূঢ়ার্থৈ দোদুল দুলি কৃমিকীট যথা
নিখিলের হৃদপিণ্ড ধরে
এই দেখো কতভাবে দোদুল দুলেছ তুমি
আমিও আমিও কিন্তু
নিজেরাই বুঝিনি দোলন
৯
নিখিলের গর্ভ থেকে একবার সুতোকৃমি হয়ে
বাহিরে এসেছি
মনুষ্য হাতের হয়ে ধরেছি দু-স্তন
এর চেয়ে শান্তি নেই আর
এর চেয়ে অশান্তিও নেই
১০
বিশল্যকরণীর পাশেই বুনেছিলে পাপগুল্ম
নদীর পাশেই গাঢ় লাল হত্যাপুরী
দু চক্ষুর আলো গর্ভে ঢেলে
নিজেই নিজের বজ্র চিবিয়ে খেয়েছ
স্পর্শহীন এই স্পর্শ এ তোমার নয়
মেঘহীন এই মেঘ এ তোমার নয়
মাটিহীন এই মাটি স্থিত হতে দেবে না তোমায়
জলহীন এই জলে পিপাসাও মেটেনা কখনো
প্রত্যুষহীন প্রত্যুষে তোমার পতিত আত্মা
ব্রিজ খুঁজে দিশাহীন অলীক
অন্ধত্বে ঢুকে যাবে
চিহ্ন যাবে চিহ্নহীনে পাবেনা কোথাও অনুস্বর
ধূসরিত টাঙ্গাওয়ালা এইসব
শব্দহীন শাপ ছুঁড়ে মিলিয়েছে
আলোহীন
বার্তাহীন
অন্তহীন
চুপে
১১
এখন তোমার স্বপ্নে ঢুকে পড়তে পারি
টগবগে লালবর্ণ তোমার যে বাড়ি
অন্তরঙ্গে যতখানি অহেতু বাগান
আমারই আদগ্ধ লাশ
চতুরঙ্গে ছড়িয়ে রয়েছে
নাভিমূলে বুনোলতা
চোখ থেকে উড়ে যাওয়া মুনিয়া বাচ্চারা
আকাশে সুপর্ণ তার ডানার গম্ভীর
ওষ্ঠ তুমি কোথায় হারালে?
১২
আত্মার কি বর্ণ হয়?
মুন্ডামেঘ জানিয়েছে হয় পতিত আত্মার
মেঘের কনিষ্ঠ ভাই এখন বুঝেছি
এ আমাকে দেখে কেন শিউরে উঠেছিল
কেন বলেছিল রক্তমাখা কালোধাতু
এখনো সেসব তীরন্দাজদের ছায়াছবি দেখি যারা
লক্ষ্যবস্তু ভেবে আমাকেই বিদ্ধ করে গেছে
লক্ষ্য তির বুকে নেওয়া এ আত্মার ত্রাণ নেই
দারুচিনিদ্বীপ নেই
কখনো ছিল না
১৩
ওই যে সার সার টিলা অবর্ণীয় ধূসরের
ওরা সব তোমার আর-জন্মের মিলিজুলি পাপ
সবুজ শ্যাওলার মতো এই যে কলঙ্করেখা
প্রারব্ধ বঞ্চনা সব অপমান খেদানো সন্ত্রাস
আগামী জন্মের জন্য সবাই শলায় ব্যস্ত
কোন প্রকৌশলে ভাষায় আঙ্গিকে
তোমার শরীরে বাসা নেবে
১৪
যেন কোটি কোটি চরকার ঘর্ঘর
কোটি কোটি বালতি যেন অতীত কুয়োয়
যেন মূঢ়ামুগ্ধা এই আত্মা বিপ্রলম্ভে এসে
ছত্রিশ হাজার মুখে হাহাকার চিৎকৃত করেছে
নিদ্রাস্বপ্নজাগরন জড়িয়েছে দৃশ্যাতীত জিভ
যেখানে হৃদপিণ্ড সেই শূন্যে ঘূর্ণাবর্ত
মারীর ব্যঞ্জনা নিয়ে যেন মৃত্যুভিক্ষা চায়
শূন্যের গহ্বরে এত মৃত জলের বিভ্রম
বিভ্রমে চাতুর্য সব আরক্ত ফোয়ারা হয়ে গেলে
অকথিত উঠেছে সাইরেন সুদূরপারের মিতা টের পাও
লৌকিকে এমনই গ্রন্থি খুলে
স্বয়ম্ভূত হয়েছিলে
তোমার প্রাচীন আয়ু অলৌকিকে
পুরনো বাংলা গান হলে
মৃত্যুবীজে ফসল ফলায়
বিপর্যয় যতই ছড়াক আমি এই গ্রহান্তরে
মায়াবী ধান্যের চিরকৃষক হয়েছি আজ
স্মৃতিহীনতায় তুমি মুহূর্তকে
অমুহূর্তে রেখে গিয়েছিলে
১৫
কী বোঝো জীবন বলতে তুমি
পালঙ্কে সুস্তনী ব্যালকনিতে স্ফূরিত গোলাপ
টেবিলের দৈবীভোজ?
— কোয়ার্টারে ঝাকানো টগরের ঝোপ, জানো,
বরিষাতে ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে সাদা হয়ে যেত
আমি তার গুহ্য ছায়াটিতে সারাটি দুপুর
সঙ্গে আমারই মতন ছেলেটা আমার
দুজনেই ছয় দুজনেরই কেলাস ওয়ান
আর মৃত্যু?
— বাবার দুহাতে নানা ওষুধের শিশি
অস্থির আসছেন দ্রুত পায়ে আর আমি
ছুটতে ছুটতে গিয়ে বলছি, বাবা
ঠামা আর নেই
2 comments on “বিজয় সিংহ”
Sudip Chattopadhyay
পড়ে মুগ্ধ হলাম। অসাধারণ সব লেখা। অভূতপূর্ব দৃশ্যকল্প। একাধিকবার পড়লাম
thealoprithibi
সঙ্গে থাকবেন। ধন্যবাদ।