ধরা যাক আমাকে কোনো একটি বিষয়ের উপর কিছু বলতে বলা হল। আমি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে এমন কিছু অসংবদ্ধ শব্দ একনাগাড়ে বলে গেলাম যাদের প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা অর্থ আছে, কারো কারো আবার প্রয়োগ ও পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে একাধিক অর্থ আছে। মোদ্দা কথায় আমার পুরো বক্তব্যে অর্থপূর্ণ শব্দসমাবেশ ঘটলেও একটিও অর্থপূর্ণ বাক্য শ্রোতাদের সামনে পরিবেশিত হল না। এ হেন অবস্থায় নিম্নোক্ত সম্ভাবনাগুলো প্রকট হয়ে ওঠে :
১) আয়োজকমন্ডলী মাইক্রোফোনের শব্দবহনকারী তারটি বিচ্ছিন্ন করে আমার মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে পারেন।
২) উপস্থিত শ্রোতৃবর্গ ধৈর্য হারিয়ে আমাকে বক্তব্যে ইতি টানতে বাধ্য করতে পারে
৩) এসব কিছু্ই না করে অত্যন্ত ভদ্র ও পরিশীলিত শ্রোতৃবৃন্দ আপন আপন অভিরুচি ও ক্ষমতা অনুসারে আমার উচ্চারিত শব্দগুলো ব্যক্তিচেতনার পাতায় ইচ্ছেমত ক্রমে সাজিয়ে নিয়ে অসংখ্য অর্থ উৎপাদনে তৃপ্ত হয়ে সভাশেষে নিজ নিজ গন্তব্য অভিমুখে রওনা দিতে পারেন।
তৃতীয় সম্ভাবনাটির পক্ষেই যদি পাল্লা ভারী হয়, তাহলে সত্যিই অনুবাদের প্রয়োজন নেই। নাহলে, সঠিক শব্দবিন্যাসে বাক্যগঠনের প্রয়োজন আছে, শ্রোতৃমণ্ডলের সঙ্গে সংযোগস্থাপন বা communication-এর প্রয়োজন আছে এবং যেহেতু এই communication-এর বাহনের নামই ভাষা, তাই এর একাধিক আরশির প্রয়োজনে গল্প-প্রবন্ধ-কবিতা সমস্ত সাহিত্যরূপেরই অনুবাদের প্রয়োজন আছে। অনুবাদ কবিতায় সম্ভব আর অনুবাদই কবিতাকে পৌঁছে দেয় এক সভ্যতা থেকে অন্য সভ্যতার অলিন্দে ।
এখন প্রশ্ন হল, অনূদিত কবিতার কাছে আমরা কতখানি প্রত্যাশা করব। Coleridge-এর মতে, একটি কবিতার সেইটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়। ধরে নেওয়া যাক, কবিতায় গরুর পালের শেষ বিকেলে ঘরে ফিরে আসার দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে। বাঙালি কবি সেই দৃশ্যে কিছু ইঙ্গিতের সাহায্যে বুনে দিয়েছেন তাঁর পরিচিত সবুজ প্রকৃতি এবং কিছু লোকায়ত ও পৌরাণিক চিত্রকল্প। উত্তর ভারতের কোনো অনুবাদক যখন তাঁর আঞ্চলিক পাঠকের জন্য কবিতাটির অনুবাদ করবেন, আমরা কতখানি নিশ্চিত হতে পারি যে গ্রামবাংলার শান্ত নিবিড় পেলবতাটুকু অবিকৃতভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছবে ? এবার এই একই কবিতা যদি পড়ে উত্তর আমেরিকার টেক্সাস প্রদেশের এক দক্ষ অনুবাদকের হাতে, যেখানে গরুর পাল দিনের শেষে খামারবাড়িতে ফিরে আসে ঘোড়ার পিঠে আসীন কাউবয়দের চাবুকের নির্দেশে, মার্কিনি পাঠক কি সক্ষম হবেন সে কবিতার রসাস্বাদনে? ঘরে ফেরা গরুর পাল, শেষ বিকেলের ম্লান আলো আর একমুঠো নাম-না-জানা ছুঁয়েও-ছুঁতে-না-পারি মনখারাপ — এটুকুই হয়তো বাঙালি, অবাঙালি আর ভিনদেশি পাঠকের মধ্যে সেতুবন্ধন হয়ে থাকবে। প্রত্যেক ধাপে বেশ কিছু বিশুদ্ধতা বিসর্জিত হল, যারা নিঃসন্দেহে কবিতা। তারপরেও যে সেতুটি তিনজন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে পারাপারের উপায় করে দিল, পাঠক কি নিশ্চিত আমরা তাকে কবিতা বললে কবিতার মর্যাদাহানি ঘটবে ?
এই প্রশ্নের উত্তরের দিকে এগোতে হলে কবির দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিবেচনা প্রয়োজন। কবির কাছে তাঁর কবিতায় উচ্চারিত (এবং অনুচ্চারিত) প্রতিটা শব্দই অমোঘ। তিনি চাইবেন তাঁর কবিতার অনুবাদ যেন মূল কবিতাটিকে অক্ষত রাখে। অথচ তিনিই যখন নিজের হাতে অনুবাদের কলম তুলে নেন, শুধু যে অনুচ্চারিতের উচ্চারণে বাধ্য হন তাই নয়, অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন অবধারিত উচ্চারণগুলোও যেন নতুন জলহাওয়ায় নতুন পোশাকের দাবিতে সোচ্চার — যে দাবি না মেটালে তারা জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশে অনিচ্ছুক। তাহলে উপায়? একটু ভাবলেই বুঝতে পারব যে ‘আক্ষরিক অনুবাদ’-এর নিকটতম ইংরেজি প্রতিশব্দ Utopia — অর্থাৎ যা কিনা আদর্শে আছে, বাস্তবে নেই ! দুটো ভাষার ছন্দের বিন্যাস, ধ্বনি ও ব্যাকরণের বিধান দ্বর্থ্যহীনভাবে ঘোষণা করে যে মূলকে ভাষান্তরিত করলেই কিছু পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী — বিশেষ্য বিশেষণে অদলবদল, শব্দের কর্তন বা সংযোজন এবং পংক্তি বা শব্দ/শব্দগুচ্ছের স্থানান্তকরণ । এটুকু হতে দেখলেই যদি কেউ ‘গেল গেল’ রব তুলে ‘কবিতার বিশুদ্ধতা রক্ষা কমিটি’ গঠনে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন, তবে বলতেই হয় যে তাঁর সাহিত্যজ্ঞান লোপ পেয়েছে, ভাষাজ্ঞান শূন্য, পাণ্ডিত্য শুকনো, আর কবিত্ব ? চরাচরব্যাপী ছিপের সাহায্যেও তাঁকে কোনোদিন বঁড়শিবিদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়নি ! এ প্রসঙ্গে আরও একটি কথা — পণ্ডিত [পড়ুন অধ্যাপক(শুধুই অধ্যাপক বা নিদেনপক্ষে কবিতা-মকশো-করা অধ্যাপক); কবি-অধ্যাপকদের কথা বলছি না] এবং শখের অনুবাদকের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি যে কবিতা বিষয়ে সবচেয়ে গ্রাহ্য মন্তব্য যেমন কবিরাই করতে পারেন, তেমনি কবিতা অনুবাদের সহজাত অধিকার তাঁদেরই। তাঁরাই চরিত্রগতভাবে কবিতা অনুবাদকের তকমাধারী কারণ নিয়ত স্বীয় ভাবনাকে ভাষায় অনুবাদের গুরুদায়িত্বটিই তাঁদের আনন্দব্রত । এই কাজে নিয়োজিত থেকেই তাঁরা জন্ম দেন এক একটি কবিতার এবং তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অসন্তোষের । তিনি যা ভেবেছেন তা ঠিকঠিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে না পারার অসন্তোষ — যার থেকে জন্ম হয় আর একটি নতুন কবিতার, প্রকৃ্ত কবি এভাবেই নিরন্তর নিজেকে নিয়োগ করেন উৎকর্ষতার সাধনায় । সুতরাং কবি যদি দ্বিতীয় ভাষাটিতেও কুশলতার স্বাক্ষর রেখে থাকেন, অনুবাদের কলমটা তাঁর হাত থেকে কেড়ে অন্য হাতে ধরিয়ে দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা থাকে কী ?
মুশকিল হল সলিটেয়ার হীরের স্বর্গাভ নীল ও সূর্যাস্ত গেরুয়া মিশ্রিত দ্যুতিটি যে জীবনে দেখেনি তার কাছে কাচকাটা হীরের বিচ্ছুরণই অলীক সৌন্দর্য্য নিয়ে হাজির হয়, এ অবস্থায় একজন প্রকৃত জহুরির প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে ওঠে। অথচ ক্রমবর্ধমান ‘দাদা’, ‘গোষ্ঠী’ ও ‘আমার টেবিল-তোমার টেবিল’ কালচারপীড়িত বাংলা সাহিত্যের উঠোনে এই জহুরি ব্যক্তিটিও দুর্লভ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছেন।
তবে একটা কথা অনস্বীকার্য — কবিতা যত উৎকৃষ্ট হয়, তত বাধাপ্রাপ্ত হয় তার অনুবাদ। একটি কবিতার প্রতিবিম্ব সে নিজেই — সে এক এবং অভিন্ন; কবির অমোঘ শব্দসমাবেশ, যার অভিঘাতে আমার মাটির ভাষা আমার স্নায়ুতন্ত্রে কমনীয় জ্বরের ঘোর এনে হাজির করে, তার কোনো অনুবাদ সম্ভব নয়। তাহলে অনুবাদে আমরা কী পাই ? পাই কবিতার ভেতরের কাহিনিটুকু, কবির মনোভাব, চিন্তার ভঙ্গি, ভাষার কুশলতা ও যেটা না বললেই নয় — তাঁর জীবনদর্শন। লাভ কী অনুবাদ করে ? আবারও বলি, আমরা লাভবান হব তখনই যখন অনুবাদের কলম কোনো কবির হাতে থাকবে। ‘বসলেই’ অনুবাদ হয় না। ভালো অনুবাদ, ভালো কবিতার মতোই কোনো একরকম প্রেরণা আশ্রিত। এর প্রেরণা জেগে ওঠে যখন কোনো ভিনদেশি কবির রচনার অনুরণন বিনা বাধায় ঢুকে পড়ে অনুবাদক কবির ভেতরবাড়িতে, কবি নির্দ্বিধায় সংরক্ত হন — রুচি, অবসর ও হৃদ্যতার এমন এক যোগাযোগ ঘটে যে অনুবাদটি হয়ে ওঠে সৃষ্টি; এমন এক নৈপুণ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুবাদক কবির আয়ত্তে আসে যা তিনি সুদে খাটালে সুরাহা মেলে তাঁর উৎকর্ষতার সাধনার পথখরচায় ।
যাক গে ! তত্ত্বকথা অনেক হল, এবার আপনাদের একটি অনুবাদ পড়াই,
The love of two stars
Ruskin Bond
Two stars fell in Love. Between them came sky
And ten moons and two suns riding high,
Before them the nebulous star-crusted Way,
The Silence of Night, the silver of Day.
A million years passed , the lovers still glowed
With the brilliance and fire and passion of old,
But one star grew restless and set off at night
With a wonderful shower of hot whilte light.
He sped to his love, with his hopes and his fears,
But missed her, alas, by a thousand light-years
****
দুটি তারার প্রেম
রাস্কিন বণ্ড
যুগল তারা পড়ল প্রেমে, দু’এর মাঝে আকাশ
দশখানা চাঁদ সূর্য দুজন করল ভারী বাতাস
সামনে ধু-ধু অযুত তারার পাথরগাঁথা পথ
দিনের রুপো, রাত মেলেছে নীরব ভবিষ্যৎ
লক্ষ বছর পেরোয় তবু চলছে জ্বলাপোড়া
সেই কবেকার আগুন আবেগ বজায় রাখে ওরা
এমন সময় প্রথম তারা কী ভেবে কে জানে
সফেদ আলোর প্রস্রবণে ছুটল দুইয়ের টানে
সবটুকু ভয় সবটা আশায় বুক বেঁধে সংরাগে
দেখল প্রিয়া নিখোঁজ হাজার আলোকবছর আগে।
Leave a reply