কথাটা হচ্ছিলো কোহেন-কে নিয়ে। সেই রহস্যময়ী জিগ্যেস করলেন, “হুইচ ওয়ান’স ইয়োর ফেভারিট কোহেন? ফেমাস ব্লু রেনকোট? হ্যালেলুইয়া? সো লং ম্যারিয়ান? ফেয়ারওয়েল ভ্যালেন্টিনা? কোনটা? যদি আজকেই ঠিক একটু পরেই যদি আমরা দুজনেই ঢলে পড়ি মৃত্যুর মুখে, শেষবারের মত শুনতে চাইলে কোনটা শুনবো, আমরা?” আসলে কোহেনের সব-সব গান বড়ো প্রিয়, সব গান-ই আসলে আমার। শ্রীজাত’র একটা প্রিয়তম লাইন একটু পালটে আমার বলতে ইচ্ছে করে, “আজ থেকে সব মিথ্যে কথা তোমার হলো, যেমন আমার সব কান্না-ই লেনার্ড কোহেন”। ভাবতে ভাবতে দেখলাম, বহুদূরের একটা ব্যালকনিতে আলো জ্বলে উঠলো এক মুহূর্তের জন্য, অস্পষ্ট সেই সিলুয়েটের মধ্যে দিয়ে যেন ভেসে এলো কোহেনের সেই গান, ‘আ থাউজ্যান্ড কিসেস ডীপ’। এই অবুঝ, অবাধ্য অন্ধকারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় কেমন হওয়া উচিত আমাদের শোক উদযাপন, এই যে বিস্তীর্ণ রঙ্গমঞ্চে ঠেলে উঠিয়ে দিয়েছে একটি মৃত্যুর দৃশ্যে, একটি দিগন্তব্যাপী শ্মশানের ব্যাকড্রপে, কই সংলাপ বলে দেয়নি তো কেউ? রিহার্সালে ডাক দেয়নি তো বন্ধুরা? এই সব সময়ে ফিরে যাই কোহেনের কাছে। মনে হয় ঘুম আর ক্যাপসুলের রাংতার মাঝের সেই স্পেসে যেন আমার সবটুকু ক্লেদ ধুয়ে যাচ্ছে কোহেনের মন্দ্রস্বরে। অথচ কি সাংঘাতিক পরিহাস ভাগ্যের, কোহেনের পরিচয় হয়ে গেছিলো যেন তিনি শুধুই দুঃখের গান গেয়েছেন। নিজের জীবনীকার সিলভি সাইমন্সকে কোহেন বলেছিলেন, “People were saying I was ‘depressing a generation’ and ‘they should give away razor blades with Leonard Cohen albums because it’s music to slit your wrists by’.
সেই কোহেন যিনি শিখিয়েছেন থেমে যেতে নেই, শিখিয়েছেন যে সব অন্ধকারের উৎসে একটু হলেও উৎসারিত আলোর সূত্র থাকে। কোহেনের ‘অ্যান্থেম’ তাই হয়ে ওঠে আমাদের-ও অন্ধকারের অ্যান্থেম।
“Ring the bells that still can ring
Forget your perfect offering
There is a crack, a crack in everything
That’s how the light gets in”
কবি-ই ছিলেন কোহেন। বস্তুতঃ তার সারাটা জীবন লিখে গেছেন অজস্র কবিতা, যত না গান তার থেকে কিছু বেশীই। শিল্পীজীবনের শুরুয়াত-ও কবি হিসেবেই। কলেজের চৌকাঠ ডিঙোতে না ডিঙোতেই দুটি বইঃ ‘লেট আস কম্পেয়ার মাইথোলজিস’ আর ‘দ্য স্পাইস বুক অফ আর্থ’ – সুমন যে বইয়ের বাংলায় নাম দিয়েছেন “পৃথিবীর মশলার কৌটো”। অল্পদিন পরেই প্রকাশিত হলো উপন্যাস, ‘দ্য ফেভারিট গেম’ আর ‘বিউটিফুল লুজারস’। ফেভারিট গেমের গল্প আত্মজৈবনিক, এক কিশোর নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে লেখার মধ্যে দিয়ে যেন, কোহেন যেন হাতড়ে বেড়াচ্ছেন অন্ধকারে একটি আয়না। কিন্তু সাফল্যের মুখ দেখেনি কোনোটিই। কানাডা ছেড়ে চলে এসেছেন আমেরিকায়, ঠিক করেছেন কবিতা নয়, গান-ই লিখবেন তিনি, অ্যান্ডি ওয়ারহলের দলে নাম লিখিয়ে ঘুরতে ঘুরতেই লিখে ফেলেছেন সেই অবিস্মরণীয় গান ‘সুজ্যান’, গান বলবো, না কবিতা, না নেহাত-ই খাপছাড়া গদ্য?
“And just when you mean to tell her that you have no love to give her
Then she gets you on her wavelength
And she lets the river answer that you’ve always been her lover
And you want to travel with her, and you want to travel blind
And then you know that she will trust you
For you’ve touched her perfect body with your mind”
ভাগ্যের ফেরেই আলাপ হয়ে গেলো জুডি কলিন্সের সাথে, মন্ট্রিয়লের এক বান্ধবী নিয়ে এলেন ‘দুর্বোধ্য সব গান-কবিতা’ লেখে সেই ছেলেটাকে। কোহেন এসেই বললেন ‘আমি গানও গাইতে পারি না, গিটার-ও না, সত্যি বলতে এইটা গান কি না তাই জানি না’, বলে শুনিয়েছিলেন ‘সুজ্যান’, জুডির জহুরির চোখ চিনতে ভুল করেনি কোহেনের জাদু। কলিন্স কভার গেয়েছিলেন গানটির, সেই শুরু ‘সুজ্যানের’ জনপ্রিয়তার। সেই প্রথম একদিন জুডির ডাকে স্টেজে উঠলেন কোহেন, এতো বড়ো দর্শক কোনোদিন দেখেননি আগে লেওনার্ড। সুজ্যান গাইছেন কোহেন, পাগল হয়ে উঠেছে দর্শক, হঠাৎ মাঝপথে গান থামিয়ে নেমে এলেন কোহেন। দর্শকদের চিৎকারের মাঝে জুডি বললেন, ‘আবার ওঠো স্টেজে, আমিও গাইবো তোমার সঙ্গে’। সেইদিন মঞ্চে, মঞ্চের বাইরে মাটিতে, পাগল দর্শকের দল চিৎকার করে নিউ-ইয়র্কের আকাশ-বাতাসের ভরে দিয়েছিলো কোহেনের সেই প্রেমের ও প্রেমহীনতার ইশতেহার, আকাশের গায়ে লেখা হয়ে গেলো, “They are leaning out for love and they will lean that way forever, while Suzanne holds the mirror”। সত্যিই তো সুজ্যান। ভালোবাসার থেকে, প্রেমের থেকে ক্রমাগত দূরে অপচয়ের দিকে, অবিশ্বাসের দিকেই ঝুঁকে রয়েছি আমরা?
‘সুজ্যান’ যে বিপ্লব এনেছিলো সেই ষাটের দশকের শেষে, তা চলেছে তার পরের ষাট বছরের-ও বেশী। অল্প বয়সের কোহেন যেন সেক্সপীয়রের নিঃসঙ্গ, ভাগ্যতাড়িত যুবরাজ, স্বগতোক্তির মতো গান গেয়ে চলেছেন নিজের মনে। স্লোগানধর্মী গণসংগীত নয়, আত্মার ভিতরঘরের-ও ভিতরে ঢুকে পড়ছেন তিনি। উত্তাল সেই সত্তরের দশক – বিপ্লব তখন রাস্তাঘাট ছাড়িয়ে ড্রেসিং রুমে ঢুকে পড়েছে বব ডিলান, জোয়ান বায়েজের হাত ধরে, পালটে দেওয়ার স্বপ্ন শুধু সারিডনের চেয়ে শস্তাই নয়, সে যেন তখন আভাঁ-গার্দ ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। একদিকে ডিলানের ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’ তাকে এনে দিয়েছে ‘প্রফেটে’র মুকুট অন্যদিকে সেই ডিলানের বিপুল খ্যাতি, বিলাসবহুল জীবনকে মানুষ প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন বিভ্রান্ত, সুযোগসন্ধানী স্টান্ট বলে। এই প্রকান্ড কলরবের মাঝেও শান্ত কোহেন লিখে যাচ্ছেন তার ব্যালাড। প্রাতিষ্ঠানিকতার মোহে নিজেকে বিকিয়ে না দিয়ে, মিছিলের সামনের সারিতে উজ্জ্বল না হয়েও ঘোষণা করেছেন তার শান্ত অথচ কী তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ। নব্বইয়ের শুরুতে মুক্তি পেলো ‘দ্য ফিউচার’, কোহেন যেন এই গানে ভবিষ্যতদ্রষ্টা, ফিউচারের টাইটল ট্র্যাক শুরুই হচ্ছে,
“Give me back my broken night
My mirrored room, my secret life
It’s lonely here”
এই তিরিশ বছর পরে মনে হয় প্রত্যেকটা কথা পর্দার উপর জ্বলন্ত অক্ষরে লিখে রাখা এক ভয়ঙ্কর সত্যি। না হলে কেউ লেখে, “I’ve seen the future, brother, It is murder”? কোহেনকে চাক্ষুষ দেখা হলো না এ জন্মে, এ এক বড়ো আক্ষেপ। এক বন্ধুনি যে দেখেছে তাঁকে, বলেছিলো, স্টেজে উঠলেন কোহেন। ষাট বছরের বৃদ্ধ প্রেমিক কোহেন, ডার্ক কফির মত, বিগত জন্মের প্রেমের মতো, গভীর রাতলাগা কণ্ঠস্বর, তবু বয়সে ভারে গলা অল্প কাঁপে উঁচু তারে। কোহেন গাইছেন না, শুধু আস্তে আস্তে আবৃত্তি করছেন,
“My mirrored twin, my next of kin, I’d know you in my sleep
And who but you would take me in, a thousand kisses deep
I loved you when you opened like a lily to the heat
You see I’m just another snowman, standing in the rain and sleet”
কী জাদু, কী মায়া, কী সম্মোহন সেই কথায় – এক হলভর্তি লোক যেন সেই মুহুর্তে প্রেমে পড়ে গেলো সেই বৃদ্ধ ভালোবাসার জাদুকরের। এইসব শুনতে শুনতে মনে হয় হ্যাঁ সেই ভিড়ে আমিও ছিলাম, ছিলাম না? মনে হয় আমরা যারা কাছে আসবো বলে দূরে পালাতে চেয়েছি, কোহেন তাদের একান্ত ঈশ্বর। মনে হয়, শুধু আমাদের জন্যেই একটা অবুঝ চোরাগলির ঠিকানা রেখে গেছেন তিনি।
শুধুই আমাদের জন্যে? হয়তো না, হয়তো সব অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পরে, ওই দূরের একটা বাড়ির কংকালের গায়ে যে টিমটিমে আলো জ্বলে, আর প্রেমহীন নিস্তব্ধ ছাদে একা-একা দোল খায় যে আধপোড়া সিগারেট, তাদের জন্যেও। কোহেনের কবিতা নিয়ে কখনো সাহস হলে লিখবো অনেক কিছু। যদিও শেষ হবে না জানি, যদিও সাহস হবে না জানি। তবে একটু যখন লিখেই ফেলেছি ঝোঁকের মাথায়, একটা চিঠি দিয়ে শেষ করি… এই চিঠিটা লেখা ম্যারিয়ান-কে, আজীবন যাকে ভালোবেসেছেন, যিনি মিউজ ছিলেন (মিউজের বাংলা কি, ফয়েজ?), সেই ম্যারিয়ান, So long marianne-এর ম্যারিয়ান।
“Well Marianne it’s come to this time when we are really so old and our bodies are falling apart and I think I will follow you very soon. Know that I am so close behind you that if you stretch out your hand, I think you can reach mine. And you know that I’ve always loved you for your beauty and your wisdom, but I don’t need to say anything more about that because you know all about that. But now, I just want to wish you a very good journey. Goodbye old friend. Endless love, see you down the road.”
চিঠিটা যবে লেখা, সেই ২০১৬তেই রেনবো ব্রিজ পেরিয়ে দৃশ্যের ওপারে চলে যান কোহেন। মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে শুনতে এইটুকুও যদি ভালো বেসে যেতে পারি আমার ম্যারিয়ান-দের, তার বেশী আর কেই বা কী চায়? তবুও কোহেনের ‘অন্তিম মূল্য’ যেন শুধু ‘আশা আর প্রেমে’ই। যতই অন্ধকার গাঢ় হোক, যতই রাস্তা হোক দীর্ঘ বিচ্ছেদের মত অবুঝ, যতোই দুঃস্বপ্নতাড়িত মানুষ হারিয়ে ফেলুক পথ, কোহেন কবি বলেছেন না, ‘it’s written that we’ll meet’? সেই দিনটার অপেক্ষায় এই রাত্রিনদী পেরিয়ে যাবো কোহেনের হাত ধরে, আসুন।
পুনশ্চ : লেখাটা উৎসর্গ সেই বন্ধুটিকে, যে আলাপ করিয়েছিলো কোহেনের সাথে কোনো একদিন বয়েজ হোস্টেলের ঘরে, আর যার সাথে একদিন একটুকরো আগুন শেয়ার করে নেবো বলে যাহক-নাহক করে কাটিয়ে দিচ্ছি এই উচ্ছিষ্ট জীবন।
সূত্র
- https://timesmachine.nytimes.com/timesmachine/1995/10/11/issue.html
- https://www.cbc.ca/radio/asithappens/as-it-happens-friday-edition-1.3847360/he-was-totally-unlike-anybody-else-judy-collins-remembers-leonard-cohen-1.3847364
- https://theconversation.com/listening-to-songs-of-leonard-cohen-singing-sadness-to-sadness-in-these-anxious-times-142661
Leave a reply