ট্রামে চাপা পড়ার আগে
যে কবিতাটি মনে মনে সম্পূর্ণ করেছিলেন জীবনানন্দ,
বাড়ি ফিরে লিখবেন ভেবেছিলেন,
সেই কবিতাটি অলিখিতই থেকে গেল।
পূর্ণতা একটি ধারণামাত্র,
সম্পূর্ণ জীবন কিছু নেই।
ঢেউয়ের পরেও ঢেউ …
(ঢেউয়ের পরেও ঢেউ)
এভাবেই এক শাশ্বত পূর্ণতার খোঁজ করে চলেছেন সত্তরের অন্যতম প্রধান কবি সুজিত সরকার। তাঁর কাছে পূর্ণতা একটি ধারণামাত্র। তিনি এই চিরন্তন উপলব্ধির শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর কবিতার ভুবনকে। তিনি বিশ্বাস করেন সম্পূর্ণ জীবন বলে কিছু হয় না। যেভাবে একটি ঢেউ চলে গেলে সমুদ্রের গতিময়তা শেষ হয় না আবার একটি ঢেউ আসে। ঢেউয়ের পরে তে ঢেউ। এই নিয়েই সমুদ্রের পরিপূর্ণতা। তাই আপাতভাবে যাকে আমরা পূর্ণ বলে মনে করি তা আসলে অপূর্ণই। কবি সুজিত সরকার এভাবেই পৌঁছে যান চেতনার এক গভীর স্তরে। এক দার্শনিক উপলব্ধি তাঁর মননপ্রদেশকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কবিতার নিভৃতিতে তিনি খুঁজে পান প্রাণের আরাম, মনের শান্তি।
পোল্যান্ডের কবি রুজেভিজ লিখেছিলেন
‘গুড়ুত্বপূর্ণ অনেক কাজের মধ্যে
ভুলেই গিয়েছিলাম
মরার জন্য ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হওয়াও
জরুরি একটি কাজ।’
(দীর্ঘজীবন)
মরার জন্য ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হওয়াও যে একটি কাজ এটা হয়তো সাধারণ মানুষ বোঝেন না কিন্তু এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারেন কবি সুজিত সরকার। কারণ তিনি তাঁর সমগ্র অনুভূতি দিয়ে বিশ্বলোকের স্পন্দনের অস্তিত্ব টের পান। আর সেই অস্তিত্বের সন্ধান পেতে গেলে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে হয়।সে বড় কঠিন কাজ। যতক্ষণ আমিত্ব থাকে ততক্ষণ তা করতে পারা সম্ভব নয়। কিন্তু এই কবি তা পেরেছেন। অস্মিতাকে লুপ্ত করে তিনি পৌঁছতে পেরেছেন আমিহীনতায়। তিনি সেই শুদ্ধ চেতনার রচনাকার। তাঁর অভিযাত্রা এক অনন্ত শুদ্ধতার দিকে। তাই জীবনের প্রতি এক অগাধ ভালোবাসা পরিলক্ষিত হয় তাঁর কবিতাগুলিতে।
এখন ট্রেন টিটাগড় ছাড়লেই
আমার ভেতরে কেমন একটা টেনশন শুরু হয়।
কেবলই মনে হয়,
আজ যদি ওরা পেছন ঘুরে বসে না থাকে
যদি গামছায় মুখ ঢাকা না থাকে
যদি ঝরণাকে দেখতে পাই!
(যদি ঝরণাকে দেখতে পাই)
এইসব শান্ত সরল উচ্চারণের ভিতর ধরা থাকে মানুষের জন্য কবির এক অমোঘ উদ্বেগ। জীবনের রূঢ় বাস্তবতা তাঁকে উদ্বিগ্ন করে রাখে। তবু তিনি জীবনের উপর আলো ফেলেন। এই আলো অগাধ ভালোবাসার, অকৃত্রিম বিশ্বাসের। আর এই বিশ্বাস আর ভালোবাসা আছে বলেই তিনি জীবনের সহজ সৌন্দর্যকে খুঁজে পান। আমাদেরও খুঁজে পেতে সাহায্য করেন। কারণ জীবন তাঁর কাছে কোনও সংকীর্ণ ধারণা নয়। জীবন এক অনন্ত বিস্তারের মতো। তিনি তাকে স্পর্শ করতে পারেন।
যিনি মেষশাবককে সৃষ্টি করেছেন
তিনিই কি সৃষ্টি করেছেন বাঘ?
ব্লেকের এই জিজ্ঞাসায়
একদিন আলোড়িত হয়েছিল
আমার ছাত্রজীবন।
আজ অধ্যাপকজীবনও শেষ হয়ে এল।
মাথাভর্তি সাদা চুল।
আজ দেখি
মোবাইল-কম্ পিউটার-ল্যাপটপ ঘিরে ফেলেছে
আমাকে।
মনে পড়ছে শোভনা মুন্সির কথা-
দেবী সরস্বতীর মতো সেই নারী
ব্লেক পড়িয়েছিলেন আমাদের।
না,ব্লেকের জিজ্ঞাসার আজও কোনো উত্তর পাইনি।
(মহাজিজ্ঞাসা)
এমনই সব সহজ সরল কথার মধ্য দিয়ে তিনি জীবনের গভীরতম উপলব্ধিগুলিকে মহাজিজ্ঞাসার আকারে তুলে ধরেছেন। তিনি যে ভুবনের রূপকার সেখানে কোনো জয়-পরাজয় নেই। আছে এক গভীর চেতনার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা। যেন জগতের আনন্দযজ্ঞে তিনি সকলকে নিয়ে যেতে চান যে যজ্ঞে একদিন প্রাণের ডাক দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সেই এক অনন্ত ভুবনে আমাদের যাত্রাপথ গড়ে দেন কবি সুজিত সরকার।
Leave a reply