মাঘী পূর্ণিমা
বাড়িত যান ছার,রাইতের শ্মশানে কামডা কি আফনের?
কাঠকয়লা রঙের ব্যানা ডোম ধমকালে
হা হা করে হাসতেন মধুবাবু স্যার
আর ধোঁয়ার কুন্ডলী থেকে মৃতদেহগুলি
বহতা জলের মতো মিশে যেত স্রোতে
বালুঘড়ি ধরে আর একটু এগোলে
গিরিখাত চাপা হয়ে আসে
খাদের নীলচে ডানায় ছায়াদের নিখোঁজ সংবাদ
জোছনার সরু বল্লমে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে
ঘুমোচ্ছে বরফ যুগের থেকে
তলায় পোড়া মাটির মানচিত্র
হাজার বছরের প্রাকপৃথিবী
ষোড়শ শতকের মুদ্রণবিদ্যাজানা রাত
ঘুম ভেঙে হাড় ও পাথরের অক্ষর সাজায়
ঠোঁটে কালো কফির দাগ,তামাকুর ধোঁয়া…
ফাটা ঘিলু পুড়ে ওঠে যেই,
জোড়া খুন দেখার ছবি জ্বলে ওঠে শীতকালে
ভৌতবিজ্ঞান পড়াতেন,দলাদলি জানেন না
নিজের সন্তান ছাড়া খুন হতে দ্যাখেননি আগে
গলাচেপা অন্ধকারে এঁটো বাসনের মতো চাঁদ উঠে এলে
জরায়ুর মুখে ভ্রূণ নাম ধরে তাই ডাকে উন্মাদ
রক্তের দলা ভেবে আলোর দুদিকে টান দেয়
শূন্যের চারপাশে ঘোরে আর গোঙায় যখন,
জাতিস্মর সন্নেসী মনে হয় তাকে
মাঘী পূর্ণিমায় একা হাতে চিতা জ্বেলে দ্যান
ধোঁয়া ওড়ে ষোড়শ শতকের
মৃতদেহগুলি সরু হতে হতে মিশে যায় ধোঁয়ায়
মিলনীর মাঠে শুধু কাঠ হয়ে পড়ে থাকেন
পাগল মধুবাবু স্যার।
ভাঙা কাঠপোল ও পুরোনো সিনেমা
মনে হয় রাস্তা হারিয়ে ফ্যালে রাত,
নাম্বার গুলিয়ে ফেলে চেঁচায়
অপদার্থ!একটা কাজও যদি ঠিক করে..
আর কাঁচ ভাঙার শব্দে আছড়ে পড়ে ঘুম
দ্যাখে লাল সরু আঁকা বাঁকা স্বপ্ন এগোচ্ছে।
অথচ রাত্রি জানে,ঝুলন্ত ব্রিজ
টানটান হয় কিভাবে
কিভাবে পুরোনো দৃশ্যে ফিরে আসে ট্রেন
ট্রেন থেকে নেমে কলোনি পাড়ার হাওয়া এসে
ওল্টায় তারে মেলা জামাকাপড়ের দিন
মিলনী হল থেকে অচেনা দুজন এসে
কাঠপোলে ঝুঁকে দ্যাখে, জল কত দূর।
নির্জন বাদামের গল্পে কিভাবে ঘেমে ওঠে আঙুল
ভেবে ভেবে কাঠের ব্রিজ মুখ কালো করে থাকে
পাড় থেকে হেঁটে আসা জোছনা, তারওতো আঁধার হয়
শিশিরে হাত রেখে সেও মাপে জল …
জানিতো কি হয় এরপর
ফ্ল্যাশব্যাকে ঢুকে যায় কাহিনীচিত্র
শব্দ হয় জোর আর চাপা রাগে ফেটে পড়ে কাঁচের বাসন
শাদা চাদরে এগিয়ে আসে স্বপ্ন
আঁকাবাঁকা,লাল ..আমাদের যৌথ স্বপ্নদাগ
ইদানিং…
রুমাল
কিছুদিন একসঙ্গেই ছিল তারা
রুমাল ও জামাকাপড়ের কথাই বলছিলাম
লিনেনের এক টুকরো ভাঁজে, সময়ের এদিক ওদিক
সেলাইখোলা আটপৌরে দিন…
ডাকবাক্স থেকে উড়ে গেছে চিঠিরাও
নীল পালকের খাম আতরের গন্ধ ভেবে
বাসা বাঁধে স্টেশন বাড়িতে,কার্নিশে যার
সবুজ লন্ঠন ঝুলিয়ে নিরালা স্টেশনমাস্টার পড়ে নিচ্ছে
সিল্কের সুতোর শেষ কাজ
চৌকোনা কাপড়ে নাম লেখা মনখারাপ
তারাদের এমব্রয়ডারি রাত্রির চারপাশ ঘিরে
আলোর এপাশে নিহতদের তালিকা
যে সব রুমাল প্লাটফর্মে বিদায় জানাচ্ছিল
সাবধানে যেও…না…যেওনা।ফেরো,ফিরে এসো।
না ফেরার পরবর্তী মোহে বাতিল টিকেট ও রেলপথ
থেমে আছে ধানজমির পাশে।
মুছে ফেলার মুহূর্ত থেকে একটু দূরেই পড়ে আছে
বেওয়ারিশ রুমাল।নামের অক্ষরে রাত টুপ টুপ ঝরে…
অ-সুখ
কথা বল গানের অন্ধকার
বেড়াতে যাওয়ার মত পাহাড়ের অচেনা ছবি
বল ঠিক কোনখানে কুয়াশার রঙে মিশে আছে টিলা
যেখানে নেমে আসছে আজকের রোদ আর
উঠে যাচ্ছে গত বছরেরর হাওয়া
হাওয়ারা কি প্রেম শিখে নেয় ? ফটো ওঠার আগে
রিহার্সেল দেয় ঠিকঠাক হাসির? বাতিল হারমোনিয়ামের
লুকোনো অভিমান মনে পড়ে যায় না?
তাহলে দুপুরের জলে ডুবে থাকা এই বাড়ি
হলুদ দাগ থেকে পিছলে পড়ে যে কাঁচের প্লেট,
হঠাৎই হেসে ওঠো তুমি,খাবার টেবিলে বাবার কথা শুনে
পুরোনো বন্দিশের ছায়ায় বসে চুল বাঁধো যত্ন করে,
অসুখ কি এরকম মা?…
ডালপালার নিঃসঙ্গ
আসলে ঘুম আসে না
ধারালো কুকরির মতো জেগে থাকে চোখের শাদা
সর ওঠা পুকুরের জলে চাঁদ নেমে গেলে
তোর গা থেকে ব্যঙের ছাতার মতো আবছা আলো আসে
এ পর্যন্ত সম্ভাবনার মধ্যে চমকে উঠি আমি
মিশে যাস যদি বরফ বরফ ওই অন্ধকারে!
অতদূর ইস্কুলবাড়ি থেকে হাঁফাতে হাঁফাতে তোর ঢেঙামাথা আর আকাশের গায়ে ঠেকা তোর ঢেঙা মাথা খুঁজে খুঁজে
আলপথে এতো ঘুম,ঘুমের ভেতরে ছেঁড়া স্বপ্ন,
স্বপ্নের মাথা ফুঁড়ে অচেনা ভিটেবাড়ি…
বসতিহীন তবু ঘুরে মরি তোর দিকে
অথচ হাওয়া শুনতে পেতাম
ডালপালার যেসব ভুল ও নিঃসঙ্গ আমাকে হতবাক করে
স্বপ্নর ভার মাথায় করে গুঙিয়ে উঠি,আলো হয় না কেন?
অন্ধকার টানেলে শুধু ঝনঝন করে কারশেড
কাঠগুড়োমাখা জ্যান্ত বরফকল থেকে শাদা পাতা ঝরে
ঘুমের রাস্তা জুড়ে শুধু শাদা আর শূন্য
আমি ভুলে গেছিলাম, আমি ভুলে যাই
তুই আর আমি একই ছাইরঙ আলোর ভেতর
বেড়ে উঠি,ক্ষয়ে যাই রাত্রিসম্ভব পান্ডুলিপির মতো
ঘুমে ও স্বপ্নে আসলেতো জেগে থাকি আমরা…
কাগজ ফুলের বন
ফুরফুরে পাতাল কোঁড়ের মতো মন
ফিকে রঙ গুমোর ফুটেছে খুব তার
সেতো জানে মহুল বোঁটায় তার বিস্টি লেগে গেলে
ময়ূরের ঘোর লাগে নাচের পালকে
সাপের স্বপন দেখে আর
অসুক বিসুকও নাকি এসে যায়
জ্বরভর্তি মাথা নিয়ে ছাল ওঠা ঠোঁট গোঙায় তখন
নীল মশারির নীচে আধোডোবা মায়া মাছ ঘোরাফেরা করে
ভেজা আতপের গন্ধে ম ম করে শঙ্খের বন
আর কচি ডাল পেঁচিয়ে ধরে হাওয়া
কাগজ ফুলের গাছে শুধু হাওয়া ওঠে নামে
খসখসে অন্ধকার খুঁড়ে আমলকি জল খুঁজে পেলে
ভোর ভোর জ্বর ছেড়ে যায়
মরা খোলসের মতো একা একা মন পড়ে থাকে
4 comments on “কবিতা : মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া”
Unknown
প্রতিটি কবিতাই চমৎকার। মাঘী পূর্ণিমা, রুমাল অসামান্য
ছায়ারোদ
কবি মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া তাঁর কবিতায় হাড় ও পাথরের ভিতরে ছাইরঙা বোধের স্থিতিতে বৈচিত্র্য স্থাপন করেছেন।
Debjani Basu
প্রথম কবিতাটি ছাড়া অন্য সব কবিতা সুন্দর ও সংহতিপূর্ণ
SOUMANA DASGUPTA.
প্রতিটি কবিতাই খুব ভালো লাগল মণিদীপা।