কতদিন হল কোথাও আড্ডা দিতে যেতে পারিনি । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন , আড্ডা সে তো জীবনভর । ভেবে দেখেছি, তাই । সেই কলেজ জীবন থেকে যে আড্ডা চলে আসছিল নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে , পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল,তাতে ছেদ পড়ল এই প্রথম । এক আধ দিনের ছেদ নয় । কয়েক মাস হয়ে গেল দেখতে দেখতে । শেষ আড্ডা দিয়েছি কবে ? বাড়িতে বসে ১২ মার্চ । কয়েকজন স্বনামধন্য কবি ও লেখক বন্ধুর সঙ্গে । প্রসঙ্গত, আমারও দেখছি, অন্তত এ ব্যাপারে , সুনীলের সঙ্গে অনেক এক- সূত্র রয়েছে । তাঁর পছন্দ ছিল আড্ডায় প্রাণখোলা কথা , হা হা হা অকারণ হাসি এবং উইট । অবশ্য ই হবে তা সাহিত্য ঘেঁষা । একটা সময় দীর্ঘ দিন ধরে প্রায় প্রত্যহ কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজের অনুরূপ সন্ধ্যাগুলির কথা ভাবতে এই মুহূর্তে খুব খারাপ লাগছে । সত্তরের দশক থেকে কবি ও লেখক বন্ধুদের সঙ্গে উদ্দেশ্যহীন সেই আড্ডায়, হয়তো কথা বলেছি কম, শুনেছি বেশি, শিক্ষিত হয়েছি আরও বেশি । উদ্দেশ্যহীন ? হয়তো তাই । হয়তো বা না । কে আর হৃদয় খুঁড়ে উদ্দেশ্য দেখে। গভীর রাতে প্রথমদিকে নিরবান্ধব মেসে , পরে নিজের বাড়িতে ফিরেছি যেন টগবগ করে । প্রতি সন্ধ্যায় বেঁচে থাকার প্রভূত রসদ ঝোলায় ভরে । যে ঝোলায় থাকতো নিত্যদিন পাওয়া কত না টাটকা পত্রিকা , কবিতার বই । সব মিলেমিশে একাকার । আনন্দ আর পুস্তক ।
কলকাতা আমাদের মত মফস্বলের যুবাদের কিছু দিতে না পারুক, শিক্ষিত করে তুলেছে অনেক । পঞ্চাশ এর দশকের আড্ডা সর্বস্ব ও হিউমারে টইটম্বুর লেখকরা যেমন নিয়মিত থাকতেন এবং জ্যান্ত করে তুলতেন ঐ সব আড্ডা, ষাট সত্তর আশি এমনকি এই সেদিনও নব্বইয়ের তরুণতম কবিরাও উপস্থিত থেকে উপভোগ করেছে সেসব দিন । আমাদেরও কোনদিন অসুবিধা হয়নি ঐ মিশ্রিত আড্ডায় দিব্যি গা ভাসিয়ে দিতে। কবিতা না লিখে, এতো কবির সঙ্গ দিনের পর দিন আমার মত আর কে পেয়েছেন, জানি না । এই সূত্রে বলে রাখা ভালো, কবিতা না পড়লে, কবি সঙ্গ না পেলে কোনো গদ্যকার এর গদ্য কখনও স্বাদু হয়ে ওঠে না । পাঠ্য হয় না । আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি এখনও পর্যন্ত যে একটু আধটু গদ্য লিখেছি, তার একটিও কবি বা কবিতা বর্জিত নয় । কবিতার জয় হয়তো সেখানেই। বা গদ্যের পরাজয় ।আমাদের সময়ের তুখোড় গদ্যকার সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তো বলেই গেছেন, শুধু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়লে লিখতে পারতাম না, জীবনানন্দ পড়ে তবেই লিখে যেতে পেরেছি !
ভাবা যায় সেই আড্ডায় এই দীর্ঘ ছেদ ! কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজ যেন কাঁদছে । ইদানিং সব দিন যেতে না পারলেও আমার কাজের ছুটির দিন সোমবার , নিয়ম করে যেতাম । ভাবলে শুধু দীর্ঘ শ্বাস । সেদিন একজন বন্ধু ফেসবুকে জানতে চাইলেন, কবে কফি হাউস খুলছে ? আমি বলি, খুললেই কি তুমি যাবে নাকি ? সে বলে , পি পি ই দৃ আর মাস্ক পরিধান করে যাব ! বলি, একবার ভিসুয়ালি ভেবে দেখো ব্যাপারটা । সে ফেসবুকে লেখে , \’ভেবে দেখছি, আর কেবলই হাসছি । \’
সব রবিবার না হলেও মাঝে মাঝেই তো যেতাম আমাদের দীর্ঘদিন এর মসৃণ চির তরুণ সবুজ পাথরের এক আড্ডায় । তাঁর বাড়ির রবিবার এর আড্ডায় যাওয়া , সে কি আজকের ? কত বছর হলো ? হিসেব করিনি । প্রথম শ্যামবাজার , পরে উল্টোডাঙ্গায় , দুয়ে মিলে সে অনেক অনেক সময় । এখন যাওয়া হয় না
এই ক\’মাসে চিঠি র বাক্সে একটাও চিঠি আসেনি। অনেক দিন পর আজ বাড়ি র নিচে নেমে দেখি বাক্সে এক টুনটুনি দিব্যি তার ক্যাম্প ফেলিয়াছে । আসেনি কতদিন যেন লিটল ম্যাগাজিন ।প্রুফ হাতে নবীন কিশোর সম্পাদক আসেনি । পড়িনা তাদের কাগজ ।।তরুণ কবির কবিতা ভরা খাম আসে না আর । এসব যে নিত্যদিনের নিত্য মুহূর্তে র সঙ্গী ছিল সব। ঝরা সময়ের কত কথকতা । এসবের সঙ্গে ই আমাদের বেড়ে ওঠা । উপভোগ করেছি এতদিন। তাতে কী হয়েছে , জিজ্ঞেস না করলেই মঙ্গল । কিছু কি হতে চেয়েছি , কোনোদিন ? কিছু না হতেও ?
কত ব ই জমে গেছে, পড়া হয়নি। কত ব ই কেনা হয়েছে , বুক সেলফ এ অবলীলায় লুকিয়ে থাকলো ,অপঠিত থেকে গেল ।ভেবেছিলাম এবার সব পড়ে ফেলবো । পড়া হলো না। ভয় পিছু তাড়া করলে যে কিছুই করা যায় না, আর একবার বুঝলাম। লেখার শাদা পাতা তো অনেক দূরের গ্রহ যেন । একটি দিন শুরু হয়, শেষ হয়ে যায় কীভাবে দ্রুত। সন্ধ্যা নামে। রাত্রি। আবার এক সকাল । ভয় তাড়া করছে।
বালক বেলা থেকে এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ভেবে এসেছি শুধু দুটো একটা গল্প লেখার কথা । একটি দুটি কবিতর ব ই পড়ার কথা ।কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন, হাতে গোনা ক\’জন লেখক বন্ধুর সাহচর্য যে এতো ভালো কাউকে রাখতে পারে, ভাবিনি। এ যেন সেই অল্প লইয়া থাকা ,আর কিছু না । আজো গণনা করা হলো না , রবীন্দ্র গান এর বিপুল সম্ভার থেকে কটি গান মাত্র শোনা হলো । কত গান যে গাওয়া হলো,শোনা হলো না ।
কত মানুষ দেখা হলো, কত প্রকৃতি মুগ্ধ করলো, পাহাড় সমুদ্রের কাছে কত না দৃশ্যে র জন্ম হলো । কত হাসি , কান্না ধরে রাখা হলো না। কত রাস্তায় হাঁটা হলো, কত রাত্রি আর কত বৃষ্টিতে ভেজা হলো ।ভোর এলো নাচতে নাচতে , তাকে কি দেখা হলো ঠিকঠাক ? সূর্যাস্ত সূর্যোদয় শুধু ক্যামেরা র বাক্সে না ধুয়ে থেকে গেল। উপভোগ হলো কৈ ?
এতদিনে ধরে ভেবে কুলকিনারা পেলাম না, দীর্ঘ এই যে ছুটি, কখনও কি এভাবে ভোগ করেছি ? সেই যে শৈশবের নানা রঙের দিনগুলি থেকে আজ পর্যন্ত ।এই যে চুপ করে এবং চুপ করে ই বসে থাকা।
কবে শেষ হবে এই বসে থাকা ?
9 comments on “গদ্য : প্রশান্ত মাজী”
Chandranath Seth
মনকেমন ঘিরে ধরল। স্মৃতি জাগানিয়া, আহা !
পার্থপ্রতিম মজুমদার।
This comment has been removed by the author.
পার্থপ্রতিম মজুমদার।
স্বাদু গদ্য…ভাল লাগল প্রশান্তদা…
Unknown
ধন্যবাদ পার্থ। কবিতা র খবর কি ?
পার্থপ্রতিম মজুমদার।
চলছে টুকটাক।
পার্থপ্রতিম মজুমদার।
প্রশান্তদা বলছেন?
Unknown
হাঁ। পার্থ। কেমন আছো ?
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
কী ভালো লিখলেন প্রশান্ত দা ! এমন প্রসাদগুণ আছে আপনার লেখায়, যে একবার শুরু করলে ছাড়া যায় না । আর কী এক জাদুমন্ত্রে আপনি আপনার আনন্দ বিষাদ পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারেন । যেন কিছুই নয় এমন একটা শৈলী । কিন্তু যাঁরা পড়েন , তাঁরা জানেন , এ অনেক কিছু ! ইচ্ছে করলেই এমন গদ্য লেখা যায় না ।
পার্থপ্রতিম মজুমদার।
ভাল দাদা।সাবধানে থাকবেন।