কৌটোর ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে
এখন কৌটোর ভেতরে লুকিয়ে রাখছি নিজেকে। হীরের নাকছাবি যেন।একটু পরপর কৌটোর মুখ খুলে দেখছি ঠিকঠাক আছি কিনা। তোমার মরালগ্রীবা থেকেও এখন সরে যাচ্ছে আমার চোখ; ভয়ে, অপ্রেমে। এখন পত্রমোচী গাছের পাতার মতো ঝরে পড়ছে সম্পর্কের চুম্বকাবেশ। তোমাকে মনে হচ্ছে এক ছদ্মবেশী আমাজনি।
দূরে থাকো, দূরে থাকো! ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না!
কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে।নির্দামামা-নিরায়ুধ। কিন্তু কোনো রক্ত ঝরছে না। কেউ সাইরেন বাজাচ্ছে না, কেউ তাক করছে না কালাশনিকভ। তবু প্রত্যেক ঘরের কোণে কোণে কুরুক্ষেত্র। কশেরুকা আর মগজের ভেতর আততায়ী ঘুরছে; তাকে দেখা যাচ্ছে না ; কিন্তু তার ভয়ে জারকাঁটা দিচ্ছে সারা গায়ে। কেননা সে নেই তবু আছে।
\’নাই-আর-আছি\’র মাঝখানেই তার রুদ্রপ্রতাপ। যা মহামহিম সেকান্দর আর নেবুশাদনেজারের সম্মিলিত প্রতাপের অধিক। কেউ দেখতে পাচ্ছে না তার চেহারা, তার চাকু, তার রণরক্তেভেজা কৌপীন।
আমাদের হাসির ভেতর, আমাদের গোলাপের ভেতর আলগোছে সে মিশিয়ে দিচ্ছে তার কালকূট; আমাদের রক্তে, কার্পাসের ভেতর তার আবছায়া তার ছায়া। তাতে থুবড়ে পড়ছে আমাদের গান আর কলরব।
কৌটোর ভেতর থেকে গলা বাড়িয়ে পরস্পরের নাম ধরে ডেকে উঠবার আগেই সেই অদৃশ্য, কদমছাঁট-আততায়ীর ক্রূর হাসির নিচে ঝরে পড়ছি আমরা।
পত্রমোচী গাছের পাতার মতো
অন্তিম চুম্বনহীন
অবজ্ঞাত
একা
আর নিঃসহায় !
এক হাতে ফুল ও মরিচা
অন্য হাতে মৃত কৃকলাস ;
তোমার দুয়ারে রোজ ছায়া হয়ে, উবু হয়ে আসি।
নদীর খাঁড়ির কাছে দলছুট বসে
কয়েকটি শিশুমেঘ, পরিশ্রান্ত-ক্ষীণতনু মেঘ
নিজেদের নাট-বল্টু খোলে আর জোড়া দিয়ে চলে।
হাই তোলে। ঘড়ি দ্যাখে। হোসপাইপে হালকা মরিচা
ঘষে ঘষে তুলে ফেলে তারা ;
আর একটু দূরে বসে
একটি কিশোরী-মেঘ ভাইটির জামা
ধীরে ধীরে রিফু করে ভাসমান সেলাই মেশিনে।
অপলক চোখ মেলে
শান্ত হয়ে দ্যাখে গোল চাঁদ !
ধীরগামী, স্বচ্ছতোয়া এইসব নদীর কিনারে
কোলে নিয়ে মৃত কৃকলাস
সপ্তপর্ণ গাছ বেয়ে একা আমি,
দমে দমে উঠব শিখরে। তবু যদি
রেখে আসা যায় ওকে, চুপে,
শূন্যে শয্যা পেতে হাওয়ার রোদনে।
খাঁড়ির আড়ালে বসে এভাবেই
ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলের মদ তুমি পেয়ে যাবে
ইতিহাস-বইয়ের পাতায়।
দশ পায়ে নাচি
সামনে খুঁজি তাকে, পেছনে তাকাই
ঘুমের পোশাক গায়ে, দশ পায়ে নাচি
কোথায় সে? যখন সূর্য-পূজারির ঘরে
জ্বলে উঠছে উপমা, আগুন?
ঘোড়া ফেলে দিচ্ছে আমাকে আর তার জিন;
তবু বাতাস এক ঘোড়া।
সে ছুটছে আমাকে নিয়ে!
রাত্রির উপসংহার এলিয়ে পড়ছে মোরগঝুঁটিতে
তার শিরদাঁড়া বেয়ে নামছে রক্তঘন চিৎকারের নদী
তখন কোথায় সে ?
কোন গাঢ় কুয়োর অতলে তার শব ?
নেকাবঢাকা কোন শরবনে গিয়ে তাকে খুঁজি !
পথের ক্লান্তিহেতু গ’লে যাচ্ছে খুর
আমার ঘোড়ার ;
আমার হৃদয় আজ ঝুলছে অনেক ডালে ডালে
ঘুম পালিয়ে যাচ্ছে এক জানালা থেকে
আরেক জানালায়
ঘোড়া ফেলে দিচ্ছে আমাকে আর তার জিন
—এক চিৎকারের নদী থেকে আরেক চিৎকারের নদীতে!
আততায়ী
আমি জানি, আমার প্রস্থানপথ হয়ে থাকবে
শয়তানের পুরীষে আবিল !
স্বপ্নের ভেতরে গিয়ে জিরোবার ছল করে ডাকলে তোমাকে
কান দু’টি ভরে উঠবে প্রতিধ্বনিময় কা-কা রবে ;
অথবা, আমার স্বর শুষে নেবে খর মরুবালি ;
ঘুমের অশক্ত ডাল ভেঙে যাবে
চোখ দুটি খসে পড়বে নগরের নর্দমার পাঁকে
আমাকে ঘুমন্ত দেখে কালো দাঁড়কাক
অবসিডিয়ান নাইফের মতো তার ঠোঁটজোড়া নিয়ে
আমার মুখের দিকে ঝুঁকে র’বে, চেয়ে র’বে চুপ ;
—সারারাত বসে থাকবে শান্ত হয়ে বুকের ওপরে।
আমি এর কিছু জানবো না।
নোঙ্গরের পাশে
নোঙ্গরের পাশে তুমি, মনে হলো, ফেলেছ নোঙ্গর
সূর্য থেকে দূরতম পশ্চিমের এলানো বিকেলে;
বিষণ্ন ও একা ছিলে
ডুবন্ত জাহাজ থেকে জেগে ওঠা বুদ্বুদের মতো
রাত্রি এখানে তবে, অগোচরে, হয়েছে গোচর?
6 comments on “কবিতা : জুয়েল মাজহার”
শুভাশিস মণ্ডল
অসামান্য গুচ্ছ । কবিকে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানাই ।
Unknown
খুব ভালো লাগলো। চমৎকার!
সঞ্জনা
আনন্দ পেলাম পড়তে গিয়ে।
jewel mazhar
ধন্যবাদ
jewel mazhar
ধন্যবাদ
jewel mazhar
ধন্যবাদ