পাখিটি অচিন,একতারা হাতে উড়ে উড়ে আসে
শিশু মনসুর খেলা করে ওই তারে
তার মুখ দেখা যায়,তার মায়ের
হাসি দেখা যায়।বহু আকাশক্ষয়ের তীব্র
অনটনের ভিতর
আমার আনন্দজীবন দেখা যায়
এ একতারা লালনের,এ পাখি ছেঁউরিয়ার
ফকিরডাঙ্গাতেও সেই একই পাখি
শিশু মনসুর,একতারা তার মা ও আমি
( পাখিটি অচিন )
অচিনপুরের আনন্দজীবনের খোঁজে তিনি প্রায় সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন অথচ তাঁর খোঁজ পেলেন এই বাংলার খুব কম কবি সাহিত্যিক।কলকাতা থেকে বহুদূরে বীরভূমের এক উষর প্রান্তরে বসে করে গেলেন তাঁর নিজস্ব কাব্যসাধনা যা একপ্রকার জীবনসাধনাও বটে।কলকাতার কোনো নামী কাগজে তিনি কখনো লিখলেন না।অথচ তাঁর কবিতা,তাঁর গদ্য,তাঁর গান আজকে সম্মানের সঙ্গে প্রকাশিত হচ্ছে এবং গীত হচ্ছে।যা প্রতিটি বীরভূমবাসীর মনে এক অকৃত্রিম গর্বের সঞ্চার করে।সেই অচিনপুরের বাসিন্দা হলেন কবি লিয়াকত আলি।
তাঁর প্রথম গদ্য বাউল ও বিদেশিনী প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক চন্ডীদাস পত্রিকায়। এই গদ্যটিই তাঁকে বীরভূমের সুধী সমাজে জায়গা করে দেয়।তাঁর মনের গহন কোনে যে বাউল সম্পর্কিত ধ্যানধারণা জন্মেছিল এখান থেকে তার পরিচয় পাওয়া যায়।তিনি অচিন পাখি নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন।তিনি প্রায় তিনশোর কাছাকাছি বাউলাঙ্গের গান রচনা করেছেন।যা আজকে ফকিরডাঙার বাউলদের কাছে বিশেষ সম্পদ।এই আপনভোলা আত্মসাধক কখনও নিজেকে নিয়ে ভাবেননি।বড় কাগজে লেখার জন্য কখনও লালায়িত হননি।তিনি নিজের মতো করে বেঁচেছেন এবং নিজের মতো করে লিখেছেন।তাঁর জীবনযাপনের মধ্যে সেই সুফি- বাউলের প্রভাব যথেষ্ট রেখাপাত করেছে।সৃষ্টিতত্ত্ব ও দেহতত্ত্বই ছিল তাঁর লেখার মূল বিষয়বস্তু।জেলার বাইরে তিনি সেভাবে কোনো সম্মান না পেলেও তাঁর লেখনীতে ছিল এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক আত্মবিশ্লেষণ।
আমাকে আনন্দ সাগরে নিয়ে চলো,
শাস্ত্রছুট চাঁদের ভিতর
হে বিপ্লবিনী ,তুমি মরমিয়া গান গাও
প্রেমের মুখাবয়ব তোমার মুখে,মেঘে মেঘে চুল
নাচো তুমি,মর্ত্যনৃত্যে ভাবের ভূষণ
বাঁশির উপলব্ধিতে,একান্তই বাঁশের ভারতীয় বাঁশি
তাতে আঙ্গুলছোঁয়ায় গোটা জগত বেজে ওঠে
আনন্দধ্বনির গভীরে ঐ হাহাকাররাশি কার
আওয়াজটা আমারই তো,অশ্রু ও আনন্দের
স্থূল ভেদাভেদে
(আমাকে আনন্দসাগরে)
তাঁর জীবনবোধ প্রান্তরের মতো বিস্তৃত আর অফুরান প্রীতিময়।প্রেম তাঁর অনিবার্য প্রকৃতি।তিনি এক অর্থে নিজেকেই খুঁজেছেন সেই অমলিন প্রেমের ভিতর।সেই তথাকথিত বিদেশিনির সত্তা কি তাঁর সত্তা নয়!তাঁর ভাবের গভীরতা এত প্রথিত যে তাঁর কবিতাগুলি অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো চিরবহমান।কোনো প্রকার ভোগবাদ তাঁকে কখনো গ্রস্ত করতে পারেনি।তিনি আপনভোলা পথিকের মতো পথ চলেছেন আর মানুষের সঙ্গে মিশেছেন এক নিখাদ হৃদয়বত্তার সঙ্গে।এই বিশ্বচরাচর,প্রকৃতির এমন উদাত্ত আহ্বান তিনি শুনেছেন ফকির বাউলের মতো।কারণ তাঁর যাপন ঘিরে কোনো ভণিতা ছিল না।ছিল শুধু আদি ও বিশুদ্ধ প্রেম।একদিকে তিনি যেমন আউল বাউলদের সঙ্গ করেছেন অন্যদিকে তেমনি কথা বলেছেন গ্রামবাংলার আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ানো পাখিদের সঙ্গে।তাদের শিসের মর্ম তিনি যেন উপলব্ধি করেছেন শিশুর মতো।তাই তাঁর কবিতাগুলিও অত্যন্ত সরল।তাদের ভেতর এক মরমিয়া সুর যেন বেজে চলে সারাক্ষণ।
ছেঁউরিয়া আশ্রমে এলে মনে হয়
লালন ফকির হাতের চিমটে আকাশে তুলে
অমাবস্যাকে শাসন করছে
এখানে জীবনকে বহুদূর প্রশস্ত দেখা যায়
ধোওয়া অন্তর নিয়ে নিজেকে দেখি
তোমাকেও দেখি
মধুর আনন্দে পৃথিবীর কোলে চড়ে
হাসতে হাসতে ঘুরছে চাঁদ
সেই চন্দ্রজ্যোৎস্নার ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে
আমি মূর্ছা যাচ্ছি
আর ধাপে ধাপে তুমি জেগে উঠেছো
হেসে উঠছো
(ছেঁউরিয়া আশ্রমে এলে)
এই তুমি হতে পারে প্রেমিকা হতে পারে বিশ্বচরাচর যার কাছে কবি শিখেছেন জীবনের গান।আবার চন্দ্র জ্যোৎস্নায় বিগলিত হতে হতে
তিনি সেই গান গেয়ে উঠছেন।নিবেদন করছেন তাঁর আরাধ্যকে আর গাইতে গাইতে মূর্ছা যাচ্ছেন ।তখন হেসে উঠছে প্রকৃতি যেমন অমোঘ নিয়মে সে শুধু চলমান থাকে।আমরা তার প্রতিক্রিয়াগুলোকে অনুধাবন করার চেষ্টা করি মাত্র।কিন্তু সে অনন্ত রহস্যের আধার।সে এই ক্ষীণ প্রচেষ্টা দেখে কেবলই হাসতে থাকে।
লালনের ভাবধারাকে তিনি আত্মস্থ করেছেন।মানুষরতনকে জায়গা দিয়েছেন সবার উপরে।মানুষ হলো সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে মহান সৃষ্টি।সেই মানুষের সঙ্গে সঙ্গেই সৃষ্টির যাবতীয় উপাদান তাঁর কবিতায় আসে সাবলীলভাবে।মাটি,জল,আকাশ,চাঁদ,পাখি সব এসে ধরা দেয় অধরার মাঝে।রূপ আর অরূপের যে খেলা এই সংসারে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে তিনি তাকে যেন প্রত্যক্ষ করতে পারেন।এভাবেই তিনি নির্ণয় করে চলেন সৃষ্টির যাবতীয় সমাধান যা আমাদেরকে অন্যতর এক বোধির জগতে নিয়ে যায়।তাঁর প্রত্যেকটি কবিতাই আমাদের মর্মকে ভেদ করার ক্ষমতা রাখে।তাঁর কবিতায় চিত্রকল্পের ব্যবহার অসাধারণ।
অজয়ের গেরুয়াতীরে এক জ্যোৎস্নার বৈষ্ণবী শুয়ে আছে
দাড়িচুলের জটলার ভিতর আর কে ঐ বাউল
আমি নাকি
নিজেকে এভাবে চিনতে বড় সাধ হয়
হাতে একতারা নেই,হাড় টান করে বাঁধা স্নায়ুগুচ্ছ
বাজাই না,তবু বাজে
জ্যোৎস্নার বৈষ্ণবী শোনে বুঝি
উৎকীর্ণ শিহরিত বাতাসশব্দ হু হু বয়ে যায়
(অজয়ের গেরুয়াতীরে )
এও কি এক আত্মঅন্বেষণ নয় যা কেবল কবিকে তাড়িত করে।যেখানে তিনি দাড়িচুলের জটলার ভিতর নিজেকেই দেখতে পান।তাঁর নিজেকে চিনতে বড় সাধ হয়।এই তো প্রকৃত সাধকের পরিচয়।আর কবি যখন সাধক সত্তায় উন্নীত হন তখন তাঁর কবিতা নিরাভরণ হয়ে পড়ে।শব্দের ভার তখন আর কবিতার কোনও ক্ষতি করতে পারে না।কবিতা তখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে।এক দিব্যানুভূতি জেগে ওঠে মনের গোপন কানাচে।শরীর তখন আর শরীর থাকে না।দেহ থেকে দেহাতীতে উত্তীর্ণ হয় জ্যোৎস্নার রীতিনীতি।কবি সেই প্রেম সেই সেই যাপন প্রত্যক্ষ করেন।
জাতির হৃদয়ে তুমি প্রেমের শিলান্যাস করে গেছো
আক্রান্ত খঞ্জনীর পাশে তুমি চন্ডীদাস ছাড়া আর কে
মন্দির মসজিদের মতো ইটপাথরের খাঁচা নয়
সহজ বংশীধ্বনির মতো
নীড়ের থেকেও নীড় \’আয়নামহল\’
যেখানে গড়ে উঠলো লালনের নৃত্যঅপরূপ
একতারা উঁচানো হাত ধরে
(জাতির হৃদয়ে তুমি)
সেই কোন কালে আদিকবি বলে গেছেন —-\”সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই\”। এরচেয়ে সত্য ও শুদ্ধ উচ্চারণ মানবজীবনে আর কী থাকতে পারে।কবি লিয়াকতও বলছেন মন্দির মসজিদ হলো ইটপাথরের খাঁচা।সেখানেই একমাত্র দেবতা থাকেন না।দেবতার অধিষ্ঠান মানবহৃদয়ে।কবি সেই সত্য বলিষ্ঠতার সঙ্গে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।কারণ তিনি যে লালনের দীক্ষিত।যে লালন বলতে পারে—-জাতের কী রূপ আমি দেখলাম না এই নজরে \’ এইভাবেই কবি সমস্ত ভেদাভেদের উর্দ্ধে এক বিশ্বমানবতার কথা বলতে চেয়েছেন।মানবপ্রীতির বন্ধনই একমাত্র আমাদের আক্রান্ত পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে।কবি নিজেও সেই পথের অনুগামী।তিনি চেয়েছেন বাঙালীকে এক অখণ্ড জাতিসত্তা হিসাবে দেখতে।তাঁর দৃষ্টি অভেদ ও আনন্দময়।তিনি জানেন প্রতিটি মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হলো সেই আনন্দময় সত্তার সঙ্গে লীন হয়ে যাওয়া।
তাঁর কবিতায় একটা আশ্চর্য বিষয় লক্ষ্য করা যায় যে তিনি দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বহনকারী শব্দকে একত্রিত করে সম্পূর্ণ অন্য অর্থবাহী একটি শব্দ তৈরি করেন। যেমন সাধনালম্পট, পিরিতিবাগান,পেখমবাদাম,তমসাপুষ্প, আনন্দজীবন,চন্দ্রজ্যোৎস্না,গেরুয়াতীর, আকাশক্ষয়,গোবিন্দকদম প্রভৃতি।এইসব শব্দবন্ধ তাঁর কবিতায় একটা অন্য মাত্রা যোগ করে যা তাঁর একান্ত নিজস্ব।তাঁর প্রেম ঠিক প্রেম নয়।তা হলো পিরিতি।তাঁর দেহবাদ শেষ পর্যন্ত দেহাতীতে উত্তীর্ণ।কোনও আরোপিত বোধ তাঁর মধ্যে কাজ করেনি কখনো।তাই তাঁর কবিতা ছিল মাটির কাছাকাছি।কখনো কখনো পরাবাস্তবকে আশ্রয় করতেন তবে তা অলীক ছিল না। তিনি চৈতন্যের এক বিস্তৃত পরিধি রচনা করেন অনায়াসে।সেখানে চরাচর প্রেমিকার মতো। এক ঐশীলোকের আলো এসে তাকে আলোকিত করে। স্বপ্নে তিনি জ্যোৎস্নালোকিত এক প্রান্তরে বসবাস করেন।সেখানে চন্দ্রাহত রাতে দুধসাদা পরিরা এসে তাঁর কবরের পাশে বসে আজো যেন গান শোনায়।তখন কবরের মধ্যে বসেও তিনি গান লেখেন স্বপ্নাদিষ্টের মতো।কেননা লিয়াকত আলির মতো কবিদের মৃত্যু হয় না কখনো।
জন্ম ১৯৫২ সালে বীরভূমের এক প্রত্যন্ত গ্রাম কাঁকরতলা থানার বাতাসপুরে।পিতা:শওকত আলি,মাতা:আমিনা বিবি।প্রথাগত শিক্ষাতেও তিনি খুব বেশিদূর অগ্রসর হননি।তাঁর লেখা প্রথম কবিতা \”তার চিঠি \”।তাঁর রচিত
কাব্যগ্রন্থগুলি হলো– ঘাম অশ্রু রক্ত,অচিন পাখি (২০০১),ঝর্ণাজল অশ্রুই তো,ধূলিকণা জোনাকি।\”পাখি আমার মর্ম পাখি\” নামে দুটি খণ্ডে গানের সংকলন গ্রন্থ আছে।\’অন্য এক\’ ও \’অচিন পাখি\’ নামে দুটি পত্রিকা তিনি একদা সম্পাদনাও করেছেন।যদিও সেগুলি বেশিদিন প্রকাশিত হয়নি।
২০১৭ এর ১২ নভেম্বর নিঃশব্দে চলে গেলেন আনন্দজীবনের খোঁজে।
2 comments on “প্রবন্ধ : অনিমেষ মণ্ডল”
দেবাশিস ঘোষ
অনিমেষ মন্ডলের এই সুন্দর প্রবন্ধ পাঠ করে কবি লিয়াকত আলীর কবিতার সঙ্গে পরিচয় হল। লিয়াকত আলীর কবিতা খুব সহজিয়া পথের তবে তা কবিতা হয়ে উঠেছে। খুব সুন্দর লাগল।
ALOPRITHIBI BLOG
ধন্যবাদ