১.
আমার কোন পার্বত্য পিতা নেই।
সুবিশাল বক্ষ হতে বয়ে আসেনা স্তন্যবারি ;
ঐরাবত দন্তে ভাঙে না গুহামুখ,
অনুন্নত সখী আর দেহাতি বন্ধুর ভালোবাসায়-
ভাসতে ভাসতে
একদিন হয়ে উঠি নদী।
নাম ভ্রমে লিঙ্গ হারাই ,নামেই কিই বা আসে যায় !
জননী আমি,আমিই প্রকৃতি,
মধ্য ভূমে একদিন
আমিই হরগৌরী।
২.
জানকির পিণ্ডদানে
চোরা খুনিদের ভাগ্য খুলে গ্যাছে।
ক্ষত ত্বকে জাহ্নু শরীর জ্বলে যায়,
বুদ্ধ আমি নটরাজ হয়ে
দুরন্ত ঘূর্ণিতে
লন্ডভন্ড করি শরীর কনায়।
এমন সময়ে
ঘুম ভেঙে বুলবুলি শিস দেয়,
দিগন্ত জুড়ে শান্তির বাতাস বয়ে আসে,
ভেরিঘোষ নামে ধর্মঘোষে
আমিও সব ভুলে
জলশব্দে গান গেয়ে উঠি।
৩.
কলস কোলে গৃহস্থ বউ আসে না আর।
দৃশ্যমান পাঁজরের জ্বালায়
একাকী দীর্ঘ, শূন্য দিন পার হয়।
ভীষণ এক বিশ্বামিত্র রাগে
রোক-র কথা মনে হয়,দুধভরিয়া-র কথা মনে হয় ।
জলতরঙ্গে জলকেলি, সে এক সূদূর অতীত।
উলুশব্দে স্মৃতিপটে ছেদ,
চটাই জুড়ে মনসার বাল্যক্রিড়া চলে
বিবাহ শেষে উল্লাস,কল্পবাসর
আবেগের ভারে সূর্য উধাও,
আকাশ ক্রমশ ভার হতে হতে হালকা হয়ে আসে
ছুটন্ত বাতাসও চুপিসাড়ে কথা কয়
উৎসব মুখরিত দিন ,নিত্যকাজে ছেদ
আজ তবে কাজ নয় শরীর ভেজানো দিন।
৪.
বৎসরান্তে সাপ-মায়ের স্নান আজ।
কূল জুড়ে উল্লাসিত দেহাতি মানুষ
আনন্দ নাচে শরীর ভেজায়,
মহুয়ার গন্ধে বাতাস রঙীন হয়।
কোলাহল বলে ওঠে
আজ কোন ঘুম নয়, আনন্দ যাপন।
এ কূলেও শুধু উল্লাস,
স্বস্তির ধারাপথে চাষীর বক্ষ ফুলে ঢাক।
অপেক্ষা শেষে মেদিনী হবে ঋতুমতী,
লাঙলের ফলা ফুড়ে
দিকে দিকে জন্ম নিবে জানকী।
আমারও আজ অনন্দদিন,
কুমাসির থেকে জলপর্বি এসেছে
বক্ষপ্রসারে আমিও তাই
টুকরো খানি আনন্দেই মাতি।
৫.
অতঃপর রাঢ়ভূমে নেমে এসেছে
বৃন্দাবনের ইন্দ্রবারি।
রক্তবীজ বুকে নিয়ে
আমিও তাই বেরিয়ে পড়ি।
সমস্ত পথে সন্তান চুমি,
বন্ধুকূলের ভালোবাসা
বক্ষে প্রসারে ধারন করি ;
মিছে নয়, আজ আমি আনন্দ গর্ভিনী।
ক্ষতের উপর ইচ্ছাধীন প্রলেপ মাখি,
সন্তানকে দিই রাশি রাশি মাটি।
শিবনৃত্য আমিও জানি।
জানি সমস্ত বাধা ভেঙে,বাঁধ ভেঙে –
প্রলয় হুংকারে ছুটে যেতে।
দর্শক জানে,রক্ষকও জানে সব,
গর্ভবতী হলে
আমি আসলে মোহময়ী
আমিই আসলে প্রকৃত সুন্দর।
৬.
জিমূতবাহন পূজা শেষে
দল বেঁধে গৃহস্থ নারী আসে।
প্রতিকী শেয়ালে নব্য যুবক শিশু হই,
আদি যানে ফেরিঘাটে ভীড়,
দশমাসের কারা ভেঙে
কূলে বাড়ে আমাদের বনমালী।
হাঁটুজলের ভালোবসায়
বন্ধুকূল জানায় বিদায় ।
বেহুলাও আর ভাসবে না ভেলা
কোথাই বা রাখি মীনসন্তান !
পার্থর অজ্ঞাত বাসে সাথি হোক তবে ।
কূল জুড়ে এখনও ঢাকের বাদ্যি বাজে,
নিস্তরঙ্গ বুকে,
আদি ডিহরের কোল ঘেঁষে
বৃক্ষ বোধনেই
রাজার অকাল বোধন ধেয়ে আসে ।
৭.
চাষীর ব্যাস্ততায় কোলাহল বেড়ে ওঠে,
গৃহস্থ বউ ব্যাস্ত মাড়ুলি কাজে
যুদ্ধ শেষে রাজা বাড়ি ফেরে,
দিকে দিকে দীপ জ্বলে ওঠে ।
প্রেতলোকে কোলাহল ভাসে,
নিদ্রা ছুটে চলে শূন্য মাঠের পাশ ঘেঁষে।
অনুরাগে আর আনন্দ নেই;
শরীর ও কাশ ক্রমশঃ বিবর্ণ হয়ে আসে।
বিদায় পালা সাঙ্গ হলে
বসন্তপুরের কোল ঘেঁষে
অকাল বয়সে
আমার মাথুর নেমে আসে।
৮.
পরিত্যাক্ত আবর্জনায় কূল ভরে গ্যাছে,
নব্য শিকারী ফাঁদ পাতছে এদিক ওদিক।
অভিশাপে ইম্বল মরে না,
অগস্ত্য গিলে না বাতাপি শরীর ।
অসহায় সীমাপথে তাই বয়ে চলি
শীর্ণ শরীরে ছোট্ট সাঁকোয় প্রবেশ করি
আশায় রচি যাই আদিম বুদবুদ।
দিকে দিকে নবান্নের ঘ্রাণ ভাসে
যন্ত্রনার মোচড়ে শরীর বক্র হয়ে যায়।
রাত্রিবিদ্ধ যুবক যন্ত্রনার গল্প শোনায়
চুপিসাড়ে শুনি সব
আশাহত রূপ তাই বিবর্ণ হতে হতে
নলের ব্যাথায়
কুয়াসা চাদর
খানিক ছলকে ছলকে ওঠে ।
৯.
রবি শস্যের সময় হয়ে এলো,
কৃষকের ঘুম নেই ।
সমগ্র ঘুম কোলে নিয়ে
শ্বাপদকুল বাসা বেঁধেছে কুম্ভকর্ণ।
দূর হতে তুষুগান ভেসে আসে
মোহময় শুনে ফেলি
ঘন ঘোর কুয়াসায়
ঢেকে ফেলি নগ্ন চিতাগ্নি।
বন্ধন খুঁজে নিতে আসে ভগ্ন সংসার,
কূলে জুড়ে তাই চুলা জ্বলে
রন্ধন গন্ধে ছুটে যায় অস্বস্তির শৃগাল।
সরন্যুপুত্রও চলে যায় আদি মরনের শেষে,
কুঞ্জপুরের উত্তর হতে তখনই
দেবলোকের শীতল বাতাস ধেয়ে আসে।
১০.
শোকগাথায় যেদিন রাত্রি রচনা হলো,
সেদিন হতেই অভিশাপ।
অভিশাপ ভাঙে না কোনওবা ভগীরথ ;
জীবকুল তাই ভাতৃকুলের কামনা জানায় ।
কামনার ভারে দীর্ঘরাত্রি পার হয়,
দিকে দিকে নব্যআলো জ্বলে
জাগরিত ক্লান্তি কূলে এসে
উল্লাস হয়ে আছড়ে পড়ে ।
মুখরিত তুষুগানে মেড়াঘর পুড়ে যায়
মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে ভেলা যায় বহুদূর
অজয় ফেরা মানুষের থেকে
শুনে নেয় এ মাটির আউল, বাউল।
১১.
দিগন্ত জুড়ে ছোট ছোট সন্তান হেসেছে
ছোট ছোট ফুলে,
সুগন্ধির মনোহরে তাই বসে আছি,
স্বর্গোদ্যান নেমেছে পার্থিব এই কূলে।
বারি হীন বিবর্ণ শরীর
জ্যোৎস্না ভালোবাসে
আলিঙ্গনে চুম্বন ছড়ায়
অন্তঃস্থ শরীর রঙীন হয়ে আসে।
প্রতারণায় হলিকা জ্বলে,
প্রকৃতি জুড়ে পলাশ,মান্দার
অনন্ত রঙে রাধিকা রেঙে হাসে
মধুবন-জুড়ে কুহুডাকে
বসন্ত জেগে ওঠে।
১২.
সংজ্ঞা ছেড়েছে ছায়া শরীর
বুক জ্বলে খাক,
দেবশিল্পী এবার না হয়
শরীর ভাঙো জামাতার।
বৈশাখী ছেড়ে প্রলয় হুংকারে,
গাজনের বাদ্যে নাচে একাকী কৃষ্ণ কাল,
একাকিত্ব
গ্রাস করে আসে পারাবার।
শুষ্ক শরীর বারেবার ভেঙে যায়
বন্দরে ভিড়ে না কোনওবা জলযান,
অভিশপ্ত ভষ্মদেশে
শিলাই শুধু একাকী অপেক্ষায়।
ব্যোম হতে নেমে আসছে
মহা মিলনের পারিজাত,
আবার তবে নাম হারাই,
আবার তবে বিদায়
বিদায়,এ চির বিদায়।
2 comments on “কবিতা : সন্তু কর”
অংশুমান কর্মকার
দারুন দারুন
Jayanta Chattopadhyay
দারুণ লেখা!