এক
তুমি ভিজছিলে একা ।
শঙ্কিত কুহুধ্বনি , আঁচড়ের কর্কশ সা রে গা —-
শুনেছি সেসব আমি জেগে বসে থেকে ,
তোমার উদার গৃহে , প্রত্নভারাতুর ।
পালকের তলাকার ক্ষত বৃষ্টি সত্ত্বেও
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল ।
এবং কিছু এফোঁড় ওফোঁড় করা ব্যক্তিগত ,
উপমারহিত একটি সর্পাকার লাঠি ,
আজও ধরে রেখেছি ।
দেখ, বুড়ো গাধা , খোঁড়া বেজি, কিউবিক
ট্রান্সজেন্ডার একদা আমারও
পরম বন্ধু ছিল ।
শোনো গর্বিত সবুজ লতা , পীত টক ফল ,
নিশিদিন মনে রেখেছি সে-বন্ধুতা ।
তবু কোনও সংকেত ছাড়াই ফাল্গুনে
সেবার বর্ষা নেমেছিল ।
বিশ্বাস কর ,
উনিশশো সাতষট্টির শীত , সোমবার ,
ঝলমলে সকাল —- হে মাধব ,
সম্যক উড়ানভ্রষ্ট , সংক্ষুব্ধ
আমার জন্ম হল !
তারপর তুমি জানো সব ।
রোদ ও বৃষ্টির খেলা । পাখিদের ভাগবত
অজানা কাহিনি ।
দুই
দৈববলে পাখি ওড়ে ।
এর মধ্যে বায়ু, চরাচর ও শরীরবিজ্ঞানের কোনও
খেল নিশ্চিতই নেই জেনো ।
পাখি উড়তে চায় জেনে দেবতারা উড়তে দিলেন
তাকে ডানা আর তিরবিদ্ধ চোখ ।
কালস্রোত থেকে
অমরতা ছোঁ মেরে তুলবার জন্য বাঁকানো নখ ।
সেই থেকে কেবল একটি ডিমের জন্য
উষ্ণতার খোঁজে তাকে হাজার হাজার মাইল
পথ দিক ঠিক রেখে
উড়ে যেতে হয় গ্রীষ্মমণ্ডলে । ফিরে আসতে হয় ।
মাটিতে মানুষ থাকে , প্রজাতন্ত্রে
যারা স্তন্যপায়ী ও মাংসাশী একই সঙ্গে :
সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত চেনে, তীরন্দাজ, ধীর ও নিপুণ ।
তাই তির ছোটে অহরহ
উড়ে চলা একাগ্র যাত্রায় ।
খুন আকাশে ছিটকে
লাল-গোলাপি-নীল-হালকা শোকসাদা আলো
একসঙ্গে মেশে ।
নরম সুপক্ক মাংস ছাড়া অগ্নি
কিছুতে সন্তুষ্ট হন না ।
পরিযায়ী পাখিরা অমর ,
তম্বুরা বাজিয়ে গান ভৈরবী ।
ভক্ষণপর্বে স্রোত প্রকৃতই স্থির হয়ে থাকে ।
তিন
ভুল , তুমি দুধ- হলুদের সার , স্বাস্থ্যকর
অনিবার্য পেয়।
জীবনের বিপরীতে , সত্যের ও মৃত্যুর বিপরীতে
তুমি পাখিদের সর্দার, ঝাঁক বেঁধে
সংগীত রচনা কর , একটানা বিষণ্ন কোরাস ।
আবার একাকী
তুমিই শ্যামা রক্ষিতার মতো অপাঙ্গে কটাক্ষ করে আওড় ভাসিয়ে টেনে আনো পতঙ্গের ঝাঁক; আগুনের লেলিহান পটে
উড়ে এসে তারা ঝাঁপ দেয়,
সহর্ষ ও উত্তরাধুনিক !
জীবনকে ভালোবেসে মৃত্যুর প্রতি
এই করুণ আগ্রহ তৈরি করে তারা ।
যদি ইচ্ছা করি
তোমার সঙ্গে খেলে নিতে পারি কি আমিও
এক হাত লুডো ?
অথবা চোখের \’পরে ঠোঁট রেখে শুষে নিতে পারি ওই দ্রাক্ষাগন্ধ ? স্বাধীনতা ? মধু ?
ছুঁতে পারি টগর ঝোপের নিচে শুয়ে শুয়ে
দু ডানা বাড়িয়ে
তোমাকে পাবার অধিকার ?
ভুল , তুমি মৃতদের অধরোষ্ঠে লেগে থাকা
শাশ্বত জীবনের লালা , জীবনের বিপরীতে
ঘন বনে একনিষ্ঠ
ছড়ার ছন্দে চলা শান্ত গাছ অপ্রতিরোধ্য হাঁস।
চার
উড়তে উড়তে মালা
ঘুরিয়ে ছুঁড়েছি কখন নিচের দিকে ।
সুকুমারীকে প্রেম নিবেদন করেছি ।
বটের ছায়ার তলে দাঁড়িয়ে ঊষায়
সে কি দেখেছে পাখির অনুরাগ ?
শুনেছে পক্ষবিধুনন ?
সন্ধ্যায় হর্ষে ও উদ্বেগে জরজর সে কি টের পেয়েছে
হাওয়ায় ঝরছে পালকেরা ?
নিঃসাড় মস্তিষ্কের খাঁজে গেঁথে থাকা
অবুঝ শকুন্ত-মায়া পড়িয়ে নিয়েছে তাকে
উড়ানের বাংলা ভাষা ? ঋতু ও অন্বয় ?
সুকুমারী , চল এইবেলা উড়ে যাই
অন্ধকার বনের ভিতর , প্রস্ফুরিত চন্দ্রতটে
রূপকথা জন্ম নিতে পারে । দেখ,
আলো নিভে আসছে অকালে , ছায়া পড়ছে
শান্তির নদীতে মিষ্টি জলে ।
তোমার উন্মনা কালো চুলের সঙ্গে কথা বলছে
আমার ক্লান্ত রুখু ডানা !
হাতিগুলি
আসামের দেহিং পাটকাই বৃষ্টিবনে যক্ষেরা
কয়লা খুঁজে পেয়েছে । তাই সেখানে হাতিদের
পেট্রল হয়ে যেতে হবে হবে ।
মাটি কাদা হবে । আকাশ আগুন ফুলে লাল ।
আর হাতিগুলি প্রণামের ঢঙে শুঁড় তুলে
বৃক্ষ-বীরুৎ-গুল্মদের সেলাম জানিয়ে
অকস্মাৎ ধীরে নেমে যাবে
পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে ।
তুমি এমন কোনও শব্দই পাবেনা
যা সুরেলা নয় বা
যা হাহাকারসমন্বিত ।
আমরা উত্তর রাঢ়ে বসে, মফস্বলে
জৈষ্ঠের অপ্রত্যাশিত
নিম্নচাপে শীত শীত খবরকাগজ পড়ে
পরে সবই জানতে পারব । সবই বুঝতে পারব ।
খুনেড়া ভাগোয়া-সবুজ-সাদা
অক্ষরে অক্ষরে লেখা হবে
হাতিদের বুদ্ধি ,স্মৃতি ও মানুষের প্রতি
তাদের বিশ্বাসের উলঙ্গ ও অদ্ভুত কাহিনি ।
One comment on “কবিতা : শুভাশিস মণ্ডল”
রণজিৎ অধিকারী
পাখিদের অজানা কাহিনির দুই তিন সংখ্যক কবিতা ও হাতিগুলি তিনটি আশ্চর্য ক্ষমতার কবিতা। প্রণাম কবিকে। বিশ্বাস জন্মে যে এমন কবিতা আমিও একদিন লিখতে পারব কোনোদিন।