ধুস পাঁইসা জীবন
গনগইন্যা দুপুরে পায়ের তলে ছুটু হইয়ে যায় লিজের ছাওয়া। তেজি বাতাস লেতাড়ে আসে। টুকু সুয়াস্তি পায় না চারি।শালুকচুয়া গেরামট ইখন লিশট হইয়ে পইড়ে আছে একা ,দুখী লোকের পারা। ঢের দূরে জামগাছতলে গামছা বিছ্যাইঁ তাস খেলে চাইর পাঁচজন ছিলা ছকরা।উয়ারা খেলায় এতটাই মাইতে আছে যে ফিরেও দেইখবেক নাই চারিকে। ঝলা খাইটে জইড় গাছের ছায়ায় শুইয়ে আছে লবণ। উয়ার নাক ডাকার শব্দে চারি বুঝে দুনিয়ায় ই লকটার লে সুখি কেউ নাই।
অন্যদিন হইলে গলা খাকারি দিত –‘ উঠ, কালঅ বকনাটা আইজ আসে নাই পাল থাইকে। লোকটা রাগী আর গোঁয়ার। কাঁচা ঘুম ভাইঙলে খেঁকসাই উঠে রোজ।তবু চারি ছাড়ান দেয় না।কিন্তুক আইজকের দিনট তেমন লয়।
আইজ তার কাজ কাম নাই।সকাল সকাল রাঁইধে চালসিজা খাইয়ে লিয়েছে মিয়া মরদে।তা বাদেও যে টুকু পইড়ে ছিল হাড়িতে সিট ইখন পান্তা।সাঁঝবেলি আমানি চটকাই খাইয়ে লিলেই একা মানুষের রাইত কাবার। সুয্যি উইঠলে আরঅ একট দিন।
মরদ লোকের সুয়াংই আসল।ছুটু মুটু লোকের ঘরে ই ছাড়া আর আছে ট কি? ধানের কুচুড়ি নাই,জমি জিরেত নাই।ব্যাঙ্ক ত হুরুতে থাক কড়চেও একশ টাকা নাই।কতবার লবণকে বইলেছে চারি- দেখ, ভগবান তুমাকে সুয়াং দিয়েছে, টুকু গতর খাটাইলে হামদের কনহ অভাব নাই থাইকবেক। লবণ শুনে নাই উল্টা তাকেই উগরে দিয়েছে দশ কথা।
– মিয়ালক মিয়ালকের পারা থাকবি।পসাইলে রইবি না পসাইলে দেইখে লিবি নিজের রাস্তা।
কুথায় যাবেক চারি? বাপ বিহা দিয়ে খালাস।মা বইলেছে- উয়ার মাথাটা টুকু গরম বটে , বুইঝে শুইনে চলবি।
বুইঝে শুইনে চলার কি আছে? ছিলাপিলা নাই, কনহ পিছুটান নাই।লিজের সুয়াং খাটাই লিজে খাও মরদকে খাওয়াও।লোকটা না লাগে হোমে, না যজ্ঞিতে।কতবার ভাইবেছে সাঙা কইরে পালাই গেলে ই ধুস পাইসা জীবনের থাইক্যে সে বাঁচে। দশ দশ ট বছর জলের উপর দিয়ে ভাইসতে ভাইসতে চইলে গেল চইখের ছামুতে। ভাব ভালবাসা উসব বইয়ে লিখা থাকে। জীবনের নামতায় যা থাকে তা হইল্য- সকাল সকাল চালসিজা খাইয়ে কাজে বারহাই যাও। সারাদিন খাইটে খুইটে রোজগার কইরে ঘরে ফিরলেও নিস্তার নাই। হাঁস মুরগির যতন কর, ছাগল ছেড়িদের খাওয়াও। কালঅ বকনাটাকে ঘাস কাইটে দাও। ভাতারের মদের পয়সা দাও, না দিলে গাইল বাখান খিস্তি খেউড় চোদ্দ চুয়াড়ি। চারিও চুপ কইরে থাকে না । যা মুখে আসে বইল্যে দেয়. – লিগগুন্যা সাপের কুলার পারা ফণা, মুরাদ আছে মিয়াছিলাকে দু’মুঠা ভাত দিয়ার। তর মতন গতরকুড়্যা মরদ থাইকল কি না থাইকল্ আমার হুটুডুম্বা।
লবণও খেঁকাই উঠে – তর মুরাদ আমার জানা আছে।কদ্দুর আর যাবি ক্যাকলাশের দোড় বাদাড়গড়া।
চারি জানে একদিন তাকে যাইত্যেই হবেক, নাইলে মান থাকে না ইজ্জত থাকে না। লবন ভাইবেই লিয়েছে তার যাওয়ার জায়গা নাই।
আইজ লোকটা বুইঝবেক সব মিছা। জামতলায় চইরে বেড়াচ্ছে যে পাঁঠি ছাগলটা, তাকে ঘরে আন্যে ঝলা খাইটের খুরায় বাঁইধল চারি।তিন মাস গাভীন। আর কমাস পরই ছা হবেক। কুখড়িগুলোকও খুয়াড়ে দিল সকাল সকাল। ইসব না কইরে রাইখলে ঘরের লকটা কি পাইরবেক সামহালতে? ফাঁপরে পইড়ে যাবেক। কালঅ বকনাট দূরে কুথাও আছে, থাক।
আটপোরা শাড়িটা ছাইড়ে নতুন শাড়ি পরার ইচ্ছা ছিল চারির। পইরল নাই।পাছে কেউ বুইঝে ফেলে তার হালচাল। মুখে টুকু সাবান মাইখলে হইত। ঘামে ব্যাজব্যাজে হইয়ে আছে সারা গা। থাক সাবান খরচ কইরে আর কাজ নাই। তারে মেলা আধভিজা গামছাটা তুইলে লিল চারি। তারপর কমল সায়রের দিকে হাইটতে লাইগল বাঁধ যাওয়ার লছনায়।
লোকটার দিকে আরেকবার ভাইলে দেইখল চারি। শান্তিতে নাক ডাইকছে। ই শান্তিটুকু লিয়েই থাকুক। কমল সায়র লয় সে সজা হাইটতে লাইগল নাক বরাবর।
রাস্তা কি কম। এক কোরোশ পথ।
বাঁধডহরের কাছে তার লাইগে পথ ভাইলে আছে লেদু। দু সাল আগে গাজনের মেলায় তার সংগে দেখা হইয়েছিল তখনই কাঁচুমাচু কইরে বইলেছিল – চারু কদ্দিন আর ঝুইলে থাইকব বল।দুবছর হইল বউট মইরে গেছে। তুই একট বিহিত কর ইবার। নাইলে আমার জীবন যে দামুদরের জলে ভাইসে যাবেক।
– তুমি বইললে কত মিয়া বিহা কইরবেক।
– আমি ত তকেই চাই চারি।
চারির পায়ের তলের মাটি থরথর কইরে কাঁইপেছিল।আমার ত সংসার আছে।
সবই জানি চারি, তুর দিকে ভাইল্যে থাইকলে ভিতরট দেইখতে পাই। ছাইড় বাইড় কইরে আমার সঙ্গেই চ।
লেদু একট স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় লেবার। মাস গেলে মাইনা পায়। গেল বছরও ফুরফুর কইরে সিগ্রেট ফুইকতে ফুইকতে বলেছিল – শুধু তোর লাইগে ফি বছর গাজনের মেলায় আসি চারি।এখনও তোর লাইগে বুকের ভিতর টা আনচান করে। আমার হাতট ধর । চারি ধরে নাই বইলেছিল টুকু ভাবি। ভাইবতে ভাইবতে দুটা গাজন গেল। ফির দেখা ইবছর।
লেদু কি সত্যিই তাকে ভালবাসে? না কি সবই ভালবাসার আলকাপ। চারি বুইঝতে লারে। তবু যখন হাতট ধইরেছিল তখন কি রকম শিরশির করছিল সারা শরীর। ই শিরশিরানি কি ভাব ভালবাসার ? ন কি শরীরের ভিতরে যে আগুন থাকে তার কাঁপন। চারি জানে নাই ইসব।তবু লকটা দু বছর তার লাইগে দাঁড়াই আছে কিসের লাইগে ? ইট কি মিছা?
কি আছে তুর বল। ভাব ভালবাসা কিছু পালি জীবনে?লেদু শুধায়।
চারির মুখে রা সরে না ।ভিতরের হাহাকার যেন উদোম হইয়ে গেইছে তার।
একট শিকড়।
মরা গাছের আবার শিকড় কিসের? উয়ার ত ছাওয়াতল নাই।
মাথার আধভিজা গামছাটা শুকাই গেইছে কখন চারি ঠাওর কইরতে পারে নাই
ভিজা গামছাটার মতন কেউ একজন তার মাথার উপর হাত রাখুক শুধু। সব তাপ উত্তাপ চুইষে লেক। ইয়ার লে বেশি কিছু তার চাওয়ার নাই। হাঁইটতে হাঁইটতে তাতা বালিতে পুইড়ে যায় পা।
শরীর লয় বুকের উথালপাতাল তাকে ঘরছাড়া কইরেছে আইজ।
বাঁধডহরের কাছে দাড়াই আছে লেদু। একটা ভটভটি লিয়ে আইসেছে আইজ। অবিকল কিষ্ট ঠাকুরের পারা লাইগছে তাকে। ঠটের সিগ্রেট যেন বাঁশি
– কন সকাল থাইকে তর লাইগে ভাইল্যে ভাইল্যে চইখ খিয়াই গেল।
অত ভালঅ কেনে? কি আছে আমার?
কি আছে তা ত জানি না। মায়া। ছাওয়াতল। শান্তি।
ইস ।কী কথা তুমার। শরমে মইরে যাই
চাপ ভটভটিতে। নতুন কিনেছি তুর লাইগেই।
চারি ভাইল্যে থাকে দুরের দিকে। শালুকচুয়া গাঁ। মরা মাটি। জল নাই, কাদা নাই। কিছু নাই তার সেখানে শুধু এক ধুস পাঁইসা জীবন । সব ফেইল্যে দিয়ে আইসেছে আইজ। সেই দশ বছরের রাইতকথা।শহরের দিকে যাওয়ার লাইগে পা বাড়ায় সে। পা সরে না। একটা কালঅ বকনা বাছুর তার ছামুতে। অবিকল তার হারানি। তার চইখে রো। করুণ গলায় সে ডাইকে উঠে – হাম্বা।
কিচ কিচ কইরে উঠে একপাল মুরগি। পুইমাচায় বাসা বাঁইধেছে একট টুনটুনি তাকে পস্ট দেইখতে পায় সে। কেউ ডাকে- বাসিভাতগুলা কুথায় রাইখেছিস চারি।পিয়াজ আর সইপরা মাইখে খাইতম। তুই ত জানিস তুই না থাইকলে আমি কানা। বাইকের আয়নায় একট মুখ দেইখতে পায় সে। চারি লয়, পাঠশালায় তিন কেলাস পড়া চারুলতাও লয় দেইখতে পায় শালুকচুয়া গাঁয়ের বৌটা কাঁইদছে। লেদু বলে -কি হইল উঠ।
শাড়ির আঁচলে চইখ মুছে চারি। ঘর ছাড়া অত সজা লয়।
One comment on “ছোটগল্প : বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়”
SOUMANA DASGUPTA.
এই লেখায় মাটির গন্ধ লেগে আছে। খুব ভালো, খুবই ভালো।