ছাতা হারানো
ছাতা হারানোটা আমার বরাবরের অভ্যেস। স্কুল কলেজের সময় বারবার ছাতা হারিয়ে কি বকা-ই না খেয়েছি! বাবা ছিলেন ডাক্তার। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভরা নানা জিনিসের সাথে তাঁকে মাঝেমধ্যে ছাতাও দিয়ে যেত। আর আমি সেগুলো হারিয়ে আসতাম। বাবা তাও হয়ত ক্ষমাঘেন্না করে দিতেন কিন্তু মা যেই \’ইস্ কি ভালো ছাতা\’ বলে শাপশাপান্ত শুরু করতেন বাবাকেও খেই ধরতে হতো সাথেসাথে। কিন্তু এতে আমার স্বভাবের পরিবর্তন ঘটেনি। এর থেকেও নিদারুণ বিষয়টি ছিল– কোথায় যে হারিয়েছি তাও মনে করতে পারতাম না! ফলে একটি ছাতাও ফিরে পাইনি আর! একটা সময় এমন আতঙ্ক ছড়াল যে মা আমার হাতে আর ছাতা ছাড়তেই চাইতেন না। তিনি ছেলেকে বৃষ্টিতে ভেজাতে রাজি তবু ছাতা দেবেন না!
তারপর চাকরি জীবনে আমার সাধের মফস্বল শহরটি ছেড়ে কলকাতায় এলাম। এখানে আমি একা, সাবলম্বী। কিন্তু স্বভাব যায় না মলে! ছাতা হারানোর দোষটাও গেল না! গত কয়েক বছরে বাস ট্যাক্সি মেট্রো সবেতেই একটি করে কীর্তি ছেড়ে এসেছি কিছুদিন পরপর। এদিকে ঠাণ্ডার ধাত। ভিজলেই চিত্তির! অতএব খুঁজে খুঁজে সবথেকে সস্তার ছাতাটা কেনার চেষ্টা করি এখানে ওখানে। তাতে দিনকয়েক চলে যায়। হারালেও ওই তো কটা টাকা মনে করে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে ভুলিয়ে দিই।
এভাবে দিব্যি চলছিল। হঠাৎ প্রেমে পড়লাম। মেয়েটি আমাদেরই অফিসের তবে সেকশন আলাদা, আমার সেকেন্ড ফ্লোর ওর সিক্সথ। আমি মফস্বলের সাইকেল চড়া অতি পাতি টাইপের একজন। আর সে একেবারে দক্ষিণ কলকাতার পশ্ এলাকার মেয়ে। ডাকসাইটে সুন্দরী। তবু এতজনের মাঝে আমাকে তার ভালো লাগে, আমার সাথে অফিসের পর বাদাম ভাজা খায়, হাঁটতে হাঁটতে আমরা বাবুঘাট যাই। আমি তো পুরো লাট্টু!
এদিকে অফিসে প্রতিদ্বন্দ্বীর তো অভাব নেই! \’প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে\’। তাই একটা টেনশন থাকেই। ফলে সাজ পোশাক স্টাইল সবেতেই একটা বদল আনার চেষ্টা করলাম। শুধু ছাতাটি বদলালো না। তাতেই বিপত্তি নামল একদিন। হয়েছে কী সেদিন দুজনে অফিস থেকে বেরিয়ে বাবুঘাটের দিকে যাচ্ছি, মেয়ের ইচ্ছে প্রিন্সেপঘাটে গিয়ে নৌকা চড়বে। সারাদিনের গরমের পর ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। বিকেলের রোদ্দুর ঢেকে দিয়ে আকাশে একখণ্ড কালো মেঘের দেখা দিয়েছে ততক্ষণে। আমরা হেঁটে যাচ্ছি গল্প করতে করতে। পাশ দিয়ে বয়ে চলা হুগলি নদীতে জোয়ার উঠছে সবে। বড় ভালো লাগছে সময়টা। আকাশের ভাবগতিক দেখে ও বলল– ছাতা আছে! আমি বললাম –হ্যাঁ। আমার নেই কিন্তু! ওর দুষ্টু চোখে ঝিলিক খেলে।
তারপর বৃষ্টি নামল। ক\’দিন ব্যাগে সেঁধিয়ে থাকা আমার সাম্প্রতিকতম কেনা সস্তা ছাতাটি বার করতেই হল এবার। ওমা! সেটা মাথায় খাটাতে গিয়ে দেখি একদিকের শিকটা ভেঙে ঝুলে পড়েছে। আর সাইজেও এত ছোট যে দুজনের মাথাটুকুও ভালো করে আঁটে না! কেমন একটি রাজ কাপুর নার্গিস মার্কা ভাব আসতে আসতেও আসছে না। এদিকে বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। মেয়ে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগটি দুহাতে বুকের কাছে চেপে ধরে হাঁটছে। সবুজ সালোয়ার একদিকে ভিজে জবজবে। স্বভাবতই বিরক্ত। বুঝলাম তার সব রোমান্টিসিজম ধুয়ে দিচ্ছে ঝোড়ো বৃষ্টির ছাট। একবার ভাবলাম বলি– চলো ভিজি। কিন্তু সাহস হল না। তারপর হঠাৎ সামনে একটা বাস দেখে \’চললাম\’ বলে এমন ভাবে সে চলে গেল আমি ভাঙা ছাতা হাতে বেকুবের মত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগলাম।
তাই এবার ঠিক করেছি একটি ভালো দেখে দামী ছাতা কিনবো। হারালে আবার কিনবো। কিন্তু ওই বিড়ম্বনায় আর পড়ব না। এদিকে ক\’দিন হল মেয়েটি অফিস থেকে কাজ আছে বলে আগে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমার সাথে দেখাও হচ্ছে না। তাই আমিও আজ আগে বেরিয়ে সোজা ধর্মতলার গজকুমার। অনেক খুঁজে পেতে একখানা জম্পেশ ছাতা কিনলাম সাড়ে চারশো টাকা দিয়ে। আরিব্বাস! এত দামের যে ছাতা হয় তাই তো জানতাম না! অবশ্য মনের মধ্যে আশঙ্কার মেঘ যে একেবারে ঘনিয়ে এলো না তা নয়। মাত্র কয়েকটা দিন তারপর এটাও হারিয়ে যাবে এই ভেবে বুকটা একটু মোচড় দিয়েও উঠল। কিন্তু পরমুহূর্তে ভরসা দিল সেই অমোঘ গানটি– পেয়ার হুয়া একরার হুয়া হ্যায় পেয়ার সে ফির কিঁউ ডরতা হে দিল। আহা! আগে প্রেম তারপর ছাতা তারও অনেক পরে নিশ্চয় ছাতা হারানো!
খুশি খুশি মনে গজকুমার থেকে জাস্ট বেরিয়েছি আর চোখে পড়ে গেল ম্যাডন স্ট্রিটের উল্টো ফুট দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটি। একা না! সাথে ওদের সেকশনের একটি ছেলে অনিন্দ্য। হাত ধরাধরি করে হাসতে হাসতে যাচ্ছে। আমাকে দেখতেও পেল মনে হল। ছেলেটাকেও ঠেলা মেরে দেখালো। তারপর আমাকে দেখাবার জন্যই কিনা কে জানে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে হাত জড়াজড়ি করে এগিয়ে গেল কর্পোরেশন বিল্ডিংয়ের দিকে। যাওয়ার আগে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে গেল কি!
তারপর আর কী! ছাতাটি এখন বহাল তবিয়তে আমার ঘরের দড়িতে ঝুলতে, হারায়নি আর, হারাবেও না। হারিয়ে গেছি আমিই!
One comment on “ছোটগল্প : নাফিস আনোয়ার”
Arif
জীবনে চলার পথে পাওয়া-হারানোর হিসেব মেলানো বড়ই কঠিন। হারানো সুর মেলানোর চেষ্টা না করে বরং মাথায় রাখতে হবে সেই অবিস্মরণীয় উক্তি \” যা গেছে তা গেছে\” – মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ডঃ(?) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়