ছোটোবেলা থেকেই রমজান মাসকে ঘিরে আমার আলাদা একটা ভালোলাগা কাজ করতো। পুরো বছর জুড়ে অন্য কোনো মাস ছিল না, যে মাসের জন্য বছর ধরে অপেক্ষা করতাম। এই ভালোলাগার নির্দিষ্ট কোনো কারণ আজো খুঁজে পাইনি। শেষরাতে খাবার খেয়ে দিনভর রোজা থেকে সন্ধ্যায় ইফতারির জন্য যেই একটা উদগ্রীব চিত্ত কাজ করতো, সেটাও ভালোলাগার অন্যতম একটা কারণ হতে পারে। তবে উদযাপনের মাস তো বটেই। বাঙালি হিন্দুরা যেরকম দুর্গাপুজোর জন্য অপেক্ষা করে থাকে, উত্তরভারতীয় হিন্দুরা যেরকম দিওয়ালির জন্য অপেক্ষা করে থাকে, খ্রিস্টানরা যেরকম ডিসেম্বর মাসের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আপামর মুসলমানরা সেরকমই রমজান মাসের অপেক্ষায় থাকে বছরভর। তবে আমার কাছে রমজান মানে অন্যান্যদের মতন উৎসব, আনন্দ বা রেস্তোঁরায় খেতে যাওয়া নয়। দল বানিয়ে ইফতারও নয়। সেরকম পরিবেশে বড়ো হইনি আমি। আর ছোটো থেকেই পরিবার কেন্দ্রিক অন্তর্মুখী আমি ইফতার, সেহরিও পরিবারের সঙ্গে আস্বাদনেই তৃপ্তি অনুভব করেছি। আমার কাছে রমজানের আটপৌরে যাপনই অনেক বেশি আকর্ষণের ছিলো। মাদ্রাসায় পড়তাম বলে, এই সময়টায় দীর্ঘ ছুটি পেতাম। মায়ের কাছে লেপ্টে থাকার সুযোগ পেতাম বেশি বেশি করে। সব মিলিয়ে তাই অন্যরকম এক ভালোলাগা এই মাসটাকে জুড়ে।
উদাসী ও অন্তর্মুখী আমার বাবা জুত করে সংসার চালাতে পারেননি কোনোদিন। পাঁচবোন আর এক ভাইয়ের সংসার তাই মাকেই মুখে রক্ত তুলে টানতে হয়েছে। সেইসব অভাব অনটন, পরিশ্রমের মাঝে রমজান মাস আসত এক অদ্ভুত আনন্দ নিয়ে। ওই যে, সারা পরিবার একসাথে ইফতারি করা, একসাথে সেহরি করা, মা আমাদের সামনে বসে, সাথে বসে খাচ্ছেন, এগুলো সবই মনের অবচেতনে আলাদা সুখ, আলাদা শান্তিই এনে দিত।
খুব ছোটবেলা হতেই আমি রমজানের রোজা থাকতাম। মা কড়াভাবে নিষেধ করতো। বলত, এত অল্প বয়সে রোজা থাকতে হয় না- শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে- এরকম নানা কথায় আমার বিরত করতে চাইত। তবুও আমি রোজা থাকতাম। সবার মতো আমারও চারটে হাত-পা আছে, আমিও সমান খাই, এসব ভেবে ভেবে রোজা থাকার সিদ্ধান্ত অটল হতো। এছাড়াও ভোরে উঠে সকলের সাথে সেহরি খাবার মজা ত ছিলোই। তবে রোজা রাখার পিছনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা যিনি ছিলেন, তিনি হলেন আমার মা। নিষেধাজ্ঞা জারি করা সত্ত্বেও তাকে দেখেই দিনভর উপোস করবার সাহস পেতাম আমি। ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা অবধি হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও মা যদি রোজা থাকতে পারে, তবে সারাদিন শুয়ে-বসে কাটানো আমার রোজা থাকতে বাধা কোথায়- এই ছিলো আমার মূলমন্ত্র। অজ্ঞাতসারেই মা আমাকে রোজা রাখার সাহস জুগিয়েছিলেন।
শেষরাতের রান্নার জন্য রাত একটা-দেড়টার দিকেই উঠে পড়তে হতো। আমার ছোটবেলায় বাংলাদেশের গ্রামে এরকম ঘরে ঘরে ফোন ছিলো না। আর মা-জেঠিরা ফোনের ব্যবহারও জানতো না। অথচ তারা তাদের পরিকল্পনামাফিক ঠিকই ঘুম থেকে জাগতে পারতো। আসলে পাড়া-প্রতিবেশী একে অন্যের জন্য পরিপূরক ছিলো এই মাসটায়। কখনো আমরা আগে জাগলে, শেষরাতের অন্ধকারে হাতে কুপি নিয়ে চাচি-জেঠিদের ঘরে গিয়ে দরজায় আঘাত করে তাদের জাগাতাম। \’চাচি উডেন, রানবেন না? সময় শেষ হইয়া গেলো তো।\’ মুখ থেকে এই বাক্যটা বেরোতেই ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ আসতো।
অথবা আমরা যেদিন জাগতাম না, সেদিন চাচি এসে মাকে ডেকে তুলে দিয়ে যেতো।
মা একাই উঠতেন। চাল ধুয়ে মাটির উনুনে ভাত বসাতেন। তরকারি কেটেকুটে রান্না করতেন। আমরা এদিকে ঘুমোতাম। মায়ের সে নিয়ে কস্মিনকালেও কোনো অভিযোগ-অভিমান জন্মায়নি। উল্টো আমরা এভাবে প্রাণভরে ঘুমোলেই যেন উনি তৃপ্তি পেতেন।
রান্নাবান্নার শেষ হয়ে এলে থালাবাটির টিং-টং শব্দে ঘুম ভেঙে যেতো। উঠে দেখতাম রান্না ঘর থেকে ন্যাকড়া দিয়ে ধরে ধরে মা খাবারদাবারের হাঁড়িপাতিল সব ঘরে আনছেন। আমি উঠেছি দেখলেই-\’বোতলে ছাই আছে। যা,দাঁত মাইজা আয়।\’ বলতেন।
রোজা থাকতাম বলে মায়ের যত্ন-আত্তিটা বিশেষভাবে বেড়ে যেতো। ধরে ধরে কোলের বাচ্চাদের মতো করে খাবার খাওয়াতো। সারাদিন উপোস থাকবো বলে পুরো দিনের খাবার এই একবেলাতেই খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো। শেষরাতের সেহরিতে আম, দুধ, কলা, আখের গুড়ের শরবত- এসব খাইয়ে পেট ফুলিয়ে দিতো। খাবার খাওয়ার পর আর নড়বার ক্ষমতা থাকতো না।
এমন মোগলসুলভ আহারের পর ভোরে যেই ঘুম দিতাম, সে ঘুম ভাঙতো প্রায় বেলা ন\’টা-দশটার পর। চোখ কচলে উঠে দেখতাম বোনেরা এখনো কেউ ঘুমে, তো কেউ জেগে বিছানায় বসে আছে। মা আশেপাশে নেই। মুখ ধুতে কলপাড়ে গিয়ে দেখতাম মা সেখানে বসে এঁটো থালাবাসনগুলো ধুচ্ছেন।
ধোয়া শেষ হলে সেসব নিয়ে রোদে শুকোতে দিতেন। তারপর বিকেলে রান্নার জন্য গাছের ডাল-পাতা সংগ্রহ করতেন। বিকেল হতেই কাজের পাহাড় ভেঙে পড়তো যেন। নানান রকমের মশলা বাটা, শিলনোড়ায় ডাল বেটে বড়া বানানো, ছোলা সেদ্ধ করা, আলুর চপ-বেগুনী বানানো; তবুও মায়ের ক্লান্তি ছিলো না। অনায়াসে গরম উনুনের ধারে বসে সব করে যেতেন হাসিমুখে।
ইফতারের বেলায়, শরবতের গ্লাসটা সবার আগে আমার দিকে এগিয়ে দিতেন। এটা ওটা এনে আমার ইফতারের পাতে তুলে দিতেন। মা কি খাচ্ছেন তার খেয়াল সেই বয়সে করা হয়নি। আসলে স্বার্থপর আমরা, নিজেদের ভোগসুখ সম্পূর্ণ হলেই ভুলে যাই জগতের বাকিদের কথা, এমনকি প্রিয়জনদের কথাও। তাই মাকেও যে আমাদের উচিত বসিয়ে খাওয়ানো, বা মা সঠিকভাবে খাচ্ছেন কিনা, সেইটে ভাবার মতন সংবেদনশীলতা গড়ে ওঠেনি কোনোদিনই।
এই বেখেয়ালে বেখেয়ালেই কখন যেন অজান্তেই আমার মা আর আগেরমতো রইলো না। শরীরে-মনে আগেরমতো জোর নেই তার। বুকটা ভেঙে গিয়ে কেমন যেন বেঁকে গেছে খানিকটা। পিঠটা কেমন ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। চোখমুখ স্ফীত হয়ে গেছে।
মা আর রাঁধতে পারেন না পুরোনো দিনের মতো। সব দেখিয়ে দেন,বোন রাঁধে। ভোররাতে সবাই খেতে বসি, মা রুগ্ন শরীরে বিছানায় সোজা হয়ে পড়ে থাকেন। রোজা থাকা হয় না তার। জরাজীর্ণ শরীর নিয়ে হাসপাতালে ছুটোছুটি করতে করতেই হাঁপিয়ে উঠলেন ভেতরে ভেতরে। এরকম এক রমজান মাসের দশ তারিখে মা চলে গেলেন না-ফেরার দেশে।
আমাদের রমজান ছিলো একান্ত পারিবারিক। রমজানের শেষে ইদের দিন সকাল সকাল নমাজ পড়ে এসেই খাওয়াদাওয়া নিয়ে পড়তাম। বড় বিবাহিত বোনেরা তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে এসে পড়তেন। সকলে মিলে আনন্দে কেটে যেত দিন দুই। এখনও রমজান আসে। আমরা মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করি। সারাজীবনই রমজান আসবে। নিয়ে আসবে মায়ের চলে যাবার দিন। এখনও ইফতারি করি, সেহরি করি। এখন বরং আয়োজনের সঙ্গে করি। ফাইভস্টার হোটেলে করি। কিন্তু মায়ের মতন অমন করে মুখের কাছে আর কেই বা খাবার তুলে দেবে! মায়ের মতন অমন করে আর কেই বা ঘুম পাড়িয়ে রেখে রান্না করে মুখের কাছে তুলে ধরবে খাবার!!
মা আর রমজান তাই আমার কাছে সমার্থক। পবিত্র মাস আর আমার পবিত্রা মা। পরকালের চিন্তা ছাপিয়ে উঠে খুঁজে বেড়াই মায়ের আদর, মায়ের স্পর্শ। আমার মা আর ইসলামের পবিত্রতম রমজান মাস তাই আমার কাছে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
Leave a reply